skip to Main Content

টেকসহি I কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশন

পুরো ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি তো বটেই, পরিবেশের জন্য সমান কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে এই তত্ত্ব। কনসেপ্ট নতুন, তবে কার্যকারিতার ফল মিলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যে

ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। মূল উদ্দেশ্য মানুষ এবং মানুষের জীবনযাপনকে সুন্দর করে উপস্থাপনে কাজ করা। কিন্তু এই সৃজনশীল শিল্প যে বিধ্বংসী রূপও নিতে পারে, সে কথা কি জানা আছে? কারণ, কার্বন ডাই-অক্সাইড। জরিপে মিলেছে, পৃথিবীতে এর মোট উৎপাদনের ১০ শতাংশ দায় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির। ভালোর থেকে খারাপের পাল্লাই ভারী এই উপাদানে। কিন্তু একে সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে চলা সম্ভব নয় এখনই। প্রিয় পৃথিবী তাই ভুগছে খুব!
শিল্পের কারণে পরিবেশের যত ক্ষতি হয়, সেগুলোর মধ্যে বড় একটি অংশের দায় ফ্যাশনশিল্পের। দূষণে দায়ীদের তালিকা মোতাবেক এর স্থান দুই নম্বরে। তবে আশার কথা হচ্ছে, পরিবেশদূষণ রোধে সচেতন এখন বিশ্ব। ফ্যাশন দুনিয়ার মানুষও তাই ভাবতে বসেছেন কার্বন নেগেটিভিটি নিয়ে। পরিবেশের ক্ষতির শক্তিশালী কারণ কার্বন। তীব্র শক্তি নিয়ে ভর করে বিভিন্ন উপাদানে। তারপর ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির নানা পণ্যের মাধ্যমে মিশে যায় পানি, বাতাস আর মাটির সঙ্গে। ক্ষতিকর প্রভাবে নিঃস্ব-রিক্ত করতে শুরু করে পৃথিবীকে।
কপ ২১ মোতাবেক পরিবেশের ভালোর জন্য কিছু নীতিমালা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর দাপ্তরিক নাম প্যারিস চুক্তি। সেখানে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা কমিয়ে আনার জন্য নেওয়া হবে কার্যকর পদক্ষেপ। পরিকল্পনা করে সামলানো হবে পরিবেশদূষণের পাল্লা।
কীভাবে দূষণ
ফ্যাশনশিল্পে পণ্য উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানি দরকার পড়ে। গ্লোবাল ফ্যাশন অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে জানা যায়, ২০১৫ সালে টেক্সটাইল এবং ক্লদিং ইন্ডাস্ট্রি ৭৯ বিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ব্যবহার করেছে। এখানেই শেষ নয়, ১ হাজার ৭১৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করেছে। তৈরি করেছে ৯২ মিলিয়ন টন বর্জ্য। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ২০৩০ সাল অবধি এই দূষণ আরও বাড়বে। হতে পারে, পরিবেশদূষণের ৫০ শতাংশের দায় নিতে হবে ফ্যাশনশিল্পকে।

কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশন কী
চিত্তাকর্ষক ধারণা এটি। কোনো ফ্যাশন ব্র্যান্ড যদি কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশন ব্র্যান্ড হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়, তাহলে পণ্য উৎপাদনের কার্যক্রমে যে কার্বন নিঃসরিত হয়, তার থেকে বেশি পরিমাণ কার্বন পরিবেশ থেকে শোষণ করতে হবে সেই ব্র্যান্ডকে। এটাই কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশনের মূল তত্ত্ব। এ জন্য বিভিন্ন রকম কার্যক্রমের পরিকল্পনা করার সুযোগ পাবে ব্র্যান্ডটির পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার কর্তাব্যক্তিরা। তবে সব কটি পরিকল্পনাই হতে হবে কার্যকর। পরিবেশের ভালোর কথা ভেবে নিতে হবে পদক্ষেপ।
বিশ্বব্যাপী মানুষ এখন টেকসই তত্ত্ব নিয়ে সচেতন। পরিবেশ বিপর্যয় আর মহামারি সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পৃথিবীকে আগলে রাখতে হবে মায়ায়। নয়তো অবহেলায় রুদ্র রূপ ধারণ করলে সামলানো বড় মুশকিল। কিছুটা অসম্ভবও বলা যায়। তাই দূষণের মাত্রা বুঝে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ভাবনা চলমান কর্তাব্যক্তিদের মস্তিষ্কে। কার্বন নেগেটিভিটি মূলত পরিবেশের জন্য পজিটিভ। তাই ব্র্যান্ডগুলো বিভিন্ন রকম উদ্যোগ নিচ্ছে পদক্ষেপ কার্যকর করার জন্য। এগুলোর মধ্যে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ ধরনের পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে আগ্রহী হতে দেখা যাচ্ছে বেশ কিছু ব্র্যান্ডকে। আবার টেকসই তত্ত্বও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তাই ফ্যাব্রিকের পুনঃপুন ব্যবহারেও আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশ কিছু ব্র্যান্ড।
কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশন ব্র্যান্ড
শিপ ইংকের সহ-উদ্যোক্তা এডজার্ডের বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায় অন্তর্জালে। তিনি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেন ২০১৯ সালে। শিপ ইংকের দাবি, এটি সম্পূর্ণ কার্বন নেগেটিভ। বিশ্বে এ ধরনের ব্র্যান্ড হিসেবে তারাই প্রথম দাবিদার। জানা যায়, জেকিউ মেরিনো উল ব্যবহার করে সোয়েটার তৈরি করে ব্র্যান্ডটি। ফাইনেস্ট কোয়ালিটির এই উল পুনর্ব্যবহার সম্ভব বলে দাবি এই ফ্যাশন লেবেলের। ‘রিজেনারেটিভ ফারমিং’ প্রক্রিয়া মেনে চলে শিপ ইংক। সেই সঙ্গে লাভের ৫ শতাংশ বিনিয়োগের জন্যও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা মোট তিনটি প্রজেক্টের জন্য খরচ করা হয়। যার মধ্যে থাকে রিসার্চ প্রজেক্ট। কৃষি, ক্লাইমেট রেসিজমের মতো সেক্টর যেগুলো সরাসরি এ শিল্প দিয়ে বিরূপভাবে প্রভাবিত হয়েছে, তাদের কল্যাণে। নতুন এই ধারণা টেকসই করতে শিপ ইংক আরও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে ইউনিভার্সিটি অব ক্যান্টারবারি এবং ইউনিভার্সিটি অব কলেজ লন্ডনের সঙ্গে চুক্তি। এই দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে শিপ ইংক কাজ করবে। বিশ্ববিদ্যালয় দুটির কর্তৃপক্ষ ব্র্যান্ডটির কার্বন ফুটপ্রিন্ট পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে, এই ব্র্যান্ডকে কার্বন নেগেটিভ বলার অফিশিয়াল সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে কি না।
লন্ডন ব্র্যান্ডের উদ্যোক্তা জেনিয়া বিন তার ব্র্যান্ডকে কার্বন নেগেটিভ বলে থাকেন। কেন? উত্তর মিলছে ইন্টারনেট ঘেঁটে। জেনিয়া তার ব্র্যান্ড বিন লন্ডনের মাধ্যমে পরিচালিত একটি গবেষণায় জানতে পারেন, ফ্যাব্রিক উৎপাদনের সময়ই ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি থেকে মূলত কার্বন উৎপাদিত হয়ে থাকে। তাই বারবার তৈরি না করে বরং একাধিকবার ব্যবহারের উপযোগী ফ্যাব্রিক দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয় ব্র্যান্ডটির জন্য। এমনকি ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করা হয় বেশ কিছু উপাদান। তারপরে রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। জেনিয়ার মত, এই পুনর্ব্যবহার প্রক্রিয়ায় তার ব্র্যান্ড ৮৬ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে পেরেছে।
ড্যানিশ ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘গানি’ ইউনাইটেড ন্যাশনের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল ২০১৯-এর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কাজ করে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, উৎপাদনে কার্বন নিঃসরণ কমানো।
ওমেন রিটেইল ব্র্যান্ড বেব শুরু হয়েছিল নিকা ও লায়েলা নামের দুই বোনের হাত ধরে। সানফ্রান্সিসকোর রুবি ল্যাবরেটরির কর্ণধারও তারা। এই ল্যাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড ব্যবহার করে তৈরি করা হয় সেলুলোজ টেক্সটাইল। বেব কর্তৃপক্ষ জানায়, তারা কার্বন নেগেটিভ ভিসকস রিপ্লেসমেন্টে সক্ষম। এটি পরিবেশের জন্য ইতিবাচক এবং গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, প্রচলিত পদ্ধতিতে যেভাবে ভিসকস তৈরি করা হয়, সেখানে কার্বন উৎপাদন এবং নিঃসরণের পরিমাণ বেশি মাত্রায় হয়ে থাকে। এতে পরিবেশ দূষিত হয়। বেব ৪.৫ মিলিয়ন ডলার বাজেট রেখেছে কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশনের বিষয়ে গবেষণা ও উন্নয়নের উদ্দেশ্যে।
কেন প্রয়োজন
কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশন এই শিল্পের জন্য একটি স্বপ্ন। ব্র্যান্ডকে কার্বন নেগেটিভ করতে হলে যা যা করা যেতে পারে, সেগুলোর মধ্যে আছে গ্রিনহাউস গ্যাস ব্যবহার না করে পণ্য উৎপাদন, যতটুকু কার্বন নিঃসরিত হয়েছে, তার থেকে বেশি পরিমাণে কার্বন শোষণ করে নেওয়ার পরিকল্পনাসহ আরও অনেক কিছু। কার্বন নেগেটিভ ফ্যাশনের প্রচলন সম্ভব করতে হলে বাঁধাধরা নিয়মকানুনের বাইরে গিয়ে বেশ কিছু আধুনিকায়ন প্রয়োজন। এর সঙ্গে দরকার সচেতনতা, তবেই সম্ভব হবে ডিকার্বনাইজেশন।
ফ্যাশন ফর গুড অ্যান্ড অ্যাপারেল ইম্প্যাক্ট ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে জানা যায়, কার্বন নেগেটিভ উপাদানগুলোকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে গণ্য করে পরিকল্পনা সাজালে পরিবেশ রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম কৃষি কার্যক্রম পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, বাজার বুঝে উৎপাদন, বর্জ্যরে পরিমাণ কমানো, এবং ‘এন্ড-অব-লাইফ ম্যানেজমেন্ট’ অর্থাৎ পণ্য ব্যবহারের মেয়াদ শেষ হলে সে ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তার খসড়া তৈরি করা। যেকোনো পণ্য ব্যবস্থাপনা একটা নির্দিষ্ট সময় পরে আর ব্যবহার উপযোগী থাকে না। পরিণত হয় আবর্জনায়। কোম্পানি যখন প্রডাক্ট তৈরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় এবং তৈরি করে, পণ্যের লাইফ টাইম সম্পর্কে অবহিত থেকে পরবর্তী পদক্ষেপগুলোরও পরিকল্পনা থাকা আবশ্যক। জানতে হবে পণ্যের লাইফ টাইম শেষ হয়ে গেলে সেটি কোথায় যাবে।
ডিকার্বনাইজেশনের মাধ্যমে প্রকৃতি হয়ে উঠবে সতেজ। ক্রেতারা তাই ক্রমেই ক্লজেটে কার্বন নেগেটিভ ব্র্যান্ডের পোশাকের সংখ্যা বাড়াতে পারে। নিরাপদ রাখতে পারে প্রিয় পৃথিবীকে।

i সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top