মনোযতন I পিটিএসডি প্রেত!
পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা, দুর্ঘটনা জীবন বিষিয়ে তোলার মতো প্রভাব ফেলতে পারে। সামলানোর উপায়? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা
বয়ে চলা জীবনে সুখের হাত ধরে আসে দুঃখ। এই সুখ-দুঃখের সঙ্গে জীবন ভাগাভাগি করে বেঁচে থাকি আমরা। পাড়ি দিই জীবনের অলিগলি থেকে মহাসড়ক। কখনো স্বেচ্ছায়, কখনো অবচেতনে সামলে চলি ধাক্কা। এতে কখনো ভালোবাসা আয় আয় বলে ইশারা করে, কখনো আবার চোখ রাঙায়। তবু জানি, ‘মন্দ-ভালোয় মিশায়-বানায় রঙ তামাশার ঘর; আমাদের এই আজব দুনিয়া ভর’।
চলার পথে রাজ্যের বাধা মাড়ায় জীবন নামের নদী। আর তা ডিঙাতে না পারলে থুবড়ে পড়তে হয়। এই থুবড়ে পড়াতে নেই সার্থকতা। বয়সের সঙ্গে জীবনের গতি বাড়তে থাকে। ঠিক থার্মোমিটারের পারদের মতো। বৃদ্ধি পায় জীবনস্রোতের বাঁকে বাঁকে মোকাবিলা করা বাধার সংখ্যাও। এই বাধাগুলো কখনো কখনো তীব্র মানসিক চাপ সৃষ্টি করে জীবনে। কখনো আবার আপনাকে দাঁড় করিয়ে দেয় মৃত্যুকূপের পাড়ে। যদিও এসব বাধা বা বিপর্যয়ের জন্য কোনোভাবেই নিজেকে দায়ী করতে পারেন না সব সময়। তবু এর ফল আপনাকে কুরে কুরে খায়। আরেকটু পরিষ্কার করে বললে, বন্যা, ভূমিকম্প, ভবনধস, বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড, দুর্ঘটনা, ধর্ষণ, হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধ, প্রচণ্ড শারীরিক নির্যাতনের মতো অসংখ্য সমস্যা আপনাকে-আমাকে টেনে নিয়ে যায় এক ভয়াবহ রোগের দিকে। চলার পথে কখনো সড়ক দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলে কিংবা খুব কাছ থেকে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা দেখলেও এই রোগ আপনার ভেতর বাসা বাঁধতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার [পিটিএসডি]।
আপনি হাঁটছেন এই পথে?
চলার পথে এমন সমস্যার মুখোমুখি আমরা যে কেউ হতে পারি। তাই বলে সবাই কি এই পথে হাঁটে? চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, সাধারণত গুরুতর মানসিক আঘাত পাওয়ার কয়েক মিনিট বা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তীব্র মানসিক চাপের লক্ষণগুলো দেখা দেয় এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেগুলো কমতে থাকে। এভাবে দুই থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে একেবারে কমে আসে। আর এই সমস্যাকে বলে অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার [এএসডি]। তার মানে, মানসিক আঘাত পাওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে যেকোনো সময় শুরু হয়ে লক্ষণগুলো যদি এক মাসের মধ্যেই কমে যায়, তখন এটি এএসডি। আর মানসিক আঘাত থেকে তৈরি মানসিক চাপের লক্ষণগুলো এক মাসের বেশি সময় ধরে বহাল থাকলে তা পরিণত হয় পিটিএসডিতে। যদি তা-ই হয়, তখনই ধরে নেবেন, আপনি এই পথেই আছেন। মানে, হতে হবে চিকিৎসকের মুখোমুখি। সাধারণত মানসিক আঘাত পাওয়ার প্রথম তিন মাসের মধ্যেই এটি দেখা দেয়। তবে কয়েক বছর পরেও শুরু হতে পারে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই কিংবা মূল দুর্ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এমন কোনো শব্দ, ছবি, কথা বা বর্ণের মাধ্যমেও তা আপনার ভেতর এই রোগের লক্ষণগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারে।
সহজে কাবু যারা
ট্রমা তৈরি করার মতো ঘটনা অনেকে একসঙ্গে দেখলেও সবাই এই রোগে আক্রান্ত হন না। আবার আক্রান্ত হলেও একই ঘটনা সবাইকে সমান কাবু করে না। গবেষণা থেকে জানা যায়, সাধারণত নারী, শিশু ও বয়স্ক—যাদের আগে মানসিক চাপের ইতিহাস আছে কিংবা যাদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা কম অথবা যাদের আগে বিষণ্নতা বা উদ্বেগজনিত রোগের ইতিহাস আছে, কিংবা সামাজিক সহায়তা ও বুদ্ধিবৃত্তি কম এবং যাদের বংশে এই রোগের ধারা রয়েছে, তাদের পিটিএসডিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
লক্ষণে চোখ
একেক মানুষের স্নায়ুতন্ত্র এবং চাপ সহ্য করার ক্ষমতা একেক রকম হওয়ার কারণে মানসিক আঘাত পরবর্তী মনোরোগের লক্ষণগুলোও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তবে পিটিএসডি নির্ণয়ের জন্য, একজন ব্যক্তিকে কমপক্ষে এক মাস পর্যবেক্ষণে রাখতে হয়। এ সময়ে তার মধ্যে বিশেষ কিছু উপসর্গ দেখা দেয় কি না, তা খেয়াল রাখা চাই; যেমন—
বারবার দুর্ঘটনার কথা মনে পড়া।
ফ্ল্যাশব্যাক। এটি খুবই ভয়াবহ একটি বিষয়। এতে একধরনের তীব্র মানসিক চাপ রোগীর মনোজগৎ এতটাই বিপর্যস্ত করে তোলে, তার কাছে ঘটনার সময়ের অনুভূতি খুব জীবন্ত মনে হয়। শুধু তা-ই নয়, রোগীর মনে হতে থাকে ঘটনাটি আবারও ঘটছে; তাই ঘটনার সময় যেমন আচরণ করেছিলেন, তেমন আচরণ করতে থাকেন।
ঘটনাটি নিয়ে অথবা অন্য কোনো ভয়ংকর বিষয়ে দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকা।
দুর্ঘটনার কথা মনে হতেই বুক ধড়ফড় করা, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, বমিভাব, ঘাম দেওয়া, মাংসপেশিতে টান অনুভব করার মতো তীব্র শারীরিক প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়া।
অন্যদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা এবং দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়—এমন আলাপচারিতা, ব্যক্তি, বস্তু, কাজ, স্থান, চিন্তা ও অনুভূতি এড়িয়ে চলা।
দুর্ঘটনার খণ্ডচিত্র স্মৃতিতে ধারণ করা এবং কিছু বিষয় মনে করতে না পারা।
জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা এবং অন্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করা।
স্বাভাবিক জীবনযাপনে অনাগ্রহ, বিয়ে না করা, চাকরি না করাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক ভাবনা জেগে ওঠা।
অনিয়মিত ঘুম, খিটখিটে মেজাজ, হুটহাট রেগে যাওয়া।
অল্পতেই চমকে ওঠা; আবার সব সময় অতি সতর্ক থাকা।
আগ্রাসী মনোভাব, বেপরোয়া আচরণ, নিজের ক্ষতির চেষ্টা করা।
নেতিবাচক ভাবনা এবং আবেগীয় পরিবর্তনের পাশাপাশি অপরাধবোধে ভোগা কিংবা নিজেকে দোষী ভাবা, লাঞ্ছিত বোধ করা।
বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা, প্রতারিত বোধ করা, মনোযোগে সমস্যা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, হতাশা ও নৈরাশ্য দেখা দেওয়া।
শিশুদের ক্ষেত্রে
বড়দের তুলনায় শিশুদের লক্ষণে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন—
বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ভয়।
আগের শেখা কাজগুলো ভুলে যাওয়া।
ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা।
দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়—এমন নতুন কিছুর প্রতি ভয় তৈরি হওয়া। ভূত-প্রেত কিংবা রাক্ষসের ভয়ও হতে পারে!
খেলা, ছবি আঁকা কিংবা গল্প বলাসহ বিভিন্নভাবে দুর্ঘটনার বিষয় প্রকাশ করা।
কোনো কারণ ছাড়াই শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা অনুভব করা।
খিটখিটে মেজাজ, আগ্রাসী আচরণ করা।
সমাধানের রাস্তা
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজিস্ট হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সাধারণত রোগীর মানসিক চাপের লক্ষণ, কারণ, সময়কাল, তীব্রতা ও অতীতে মানসিক আঘাত পাওয়ার ইতিহাস, বংশগত ইতিহাস, পূর্বে মানসিক রোগের ইতিহাস, শারীরিক রোগের ইতিহাস এবং মানসিক ও শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিশদ মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করতে হয়। এরপর আক্রান্ত ব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে চিকিৎসা পরিকল্পনা করা হয়। সাইকোথেরাপি, ওষুধ অথবা উভয়ের সমন্বয়ে মূল চিকিৎসা দেওয়া হয়। যেহেতু মানসিক আঘাতের কারণ, ব্যক্তিবিশেষের অভিজ্ঞতা এবং পরিণতি ভিন্ন হয়, তাই রোগের লক্ষণ এবং রোগীর প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা পদ্ধতিও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে।’
এই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য থাকে লক্ষণগুলো কমানো, সমস্যা মোকাবিলায় দক্ষ হতে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। এ ছাড়া সাইকোথেরাপির মাঝে ট্রমা ফোকাসড কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি ইএমডিআর বা আই মুভমেন্ট ডিসেনসিটাইজেশন অ্যান্ড রিপ্রসেসিং বেশ কার্যকর। আরও আছে—
কগনিটিভ প্রসেসিং থেরাপি: এর মাধ্যমে দুর্ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নিজের এবং অন্যদের সম্পর্কে রোগীর নেতিবাচক চিন্তা—যেগুলো তার আচরণকে প্রভাবিত এবং দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করছে, সেগুলোকে শনাক্ত ও সংশোধন করা হয়। এই থেরাপি প্রতি সপ্তাহে এক থেকে দেড় ঘণ্টা করে মোট ১২ সপ্তাহ ধরে প্রয়োগ করতে হয়।
প্রোলং এক্সপোজার থেরাপি: রোগীর সঙ্গে কথা বলে তার মানসিক আঘাত সম্পর্কে বিস্তারিত জানা এবং ভয়ের উৎস খুঁজে বের করা হয়। তারপর তাকে ধাপে ধাপে ভয়ের উৎসগুলো মোকাবিলা করে ভয়কে জয় করতে শেখানো হয়।
এ ছাড়া প্রগ্রেসিভ মাসকিউলার রিলাক্সেশন, ব্রিদিং রিলাক্সেশন ইত্যাদি ব্যায়াম খুব কার্যকর।
অন্যদিকে, ওষুধের মাঝে সারট্রালিন এবং পেরোক্সেটিন এফডিএ অনুমোদিত। এগুলো পিটিএসডি রোগীর বিষণ্নতা, উদ্বেগ, রাগ ইত্যাদি কমাতে সাহায্য করে। তা ছাড়া রোগীর নিদ্রাহীনতা, অস্থিরতা, সন্দেহপ্রবণতা ইত্যাদি কমাতে কিছু অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধ কার্যকর। ঘুমের সমস্যা দূর এবং রোগীকে প্রশান্ত করতে বেঞ্জোডায়াজেপাইন ব্যবহার করা যায়; তবে সেগুলোতে নির্ভরশীল হওয়ার ঝুঁকি থাকে। অবশ্য সাইকোথেরাপি শুরু করার আগে কিংবা চলাকালে ওষুধ গ্রহণ করলে চিকিৎসা বেশি কার্যকর হয়। এ ছাড়া রোগী কিংবা দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিকে সংকটাবস্থা থেকে নিরাপদ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার পর পিটিএসডির সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা শুরু করা উচিত। মাদকাসক্তি, বিষণ্নতা, আত্মহত্যার প্রবণতা, প্যানিক ডিজঅর্ডার ইত্যাদি থাকলে গুরুত্ব দিয়ে সেগুলোর চিকিৎসাও করতে হবে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো চিকিৎসা চালানো যাবে না।
চিকিৎসায় সতর্কতা
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমুর মতে, অনেকেই রোগীর কাছ থেকে তথ্য বের করতে বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, কোনোভাবেই রোগীর কষ্টকর অভিজ্ঞতার কথা জানতে তাকে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। রোগীর প্রতি সহমর্মী হতে হবে; তার অনুভূতির প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। রক্ষা করতে হবে সব ধরনের গোপনীয়তা। এমন কোনো কথা বলা কিংবা কাজ করা যাবে না, যাতে রোগী আবার আঘাত পান।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস সম্ভবত নিজের জীবনে চোখ রেখেই বলে গেছেন, ‘নিজেকে জানো’। আর কঠিন সিদ্ধান্তের সময় যা মেনে চলতে হয়, তা হলো—নিজেকে প্রশ্ন করা। নিজের ভেতরের সত্তাকে জাগিয়ে তুলুন। প্রশ্ন করুন। দেখবেন বিবেক আপনাকে চমৎকার সম্ভাবনার কথা, সমস্যা সমাধানের উপায় বাতলে দিচ্ছে। এটা সত্যিই কাজ করে। একবার চেষ্টা করে দেখুন, প্রচণ্ড আঘাত থেকে আপনার যে মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে, এ অবস্থা থেকেও ফিরে আসতে পারবেন। এর জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, সঠিক চিকিৎসা ও সেবা। এসবই আপনাকে আবারও দাঁড় করিয়ে দেবে রঙিন দুনিয়ায়!
ছবি: ইন্টারনেট