এডিটর’স কলাম I সাইবার সতর্কতা
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার মানে নেই; বরং ‘চিকিৎসা’র প্রয়োজনের মুখোমুখি হওয়ার আগে ‘সতর্কতা’ই শ্রেয়, এ ক্ষেত্রেও
‘চিকিৎসার চেয়ে সতর্কতা শ্রেয়’—এলিজাবেথান-জেকোবিয়ান যুগের শ্রেষ্ঠতম আইনজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত ব্রিটিশ রাজনীতিক ও বিচারক এডওয়ার্ড কোকের [১৫৫২-১৬৩৪] এই উক্তি জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আক্ষরিক অর্থে বিশ্লেষণ করলে তা বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যদি ‘চিকিৎসা’ শব্দটির সূত্র ধরে আমরা শারীরিক অসুস্থতার প্রসঙ্গ তুলি, সে ক্ষেত্রে শরীরে আবাস গড়া কোনো রোগ সারিয়ে তোলার বন্দোবস্ত রাখার প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিতভাবেই রয়েছে; তবে সেই রোগের জন্য অপেক্ষা না করে ‘সতর্ক’ থাকা বেশি জরুরি, যেন রোগটি আমাদের সহজে আক্রান্ত করার সুযোগ না পায়। কেননা, রোগ যা-ই হোক, তার নেতিবাচক প্রভাব শরীরে পড়ে। সেরে উঠলেও থেকে যায় ধকল। অন্যদিকে, প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করে যদি নিজেদের সুস্থ রাখতে পারি, তাহলে জীবনযাপন তুলনামূলক মসৃণ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এ কথা যেকোনো বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন মানুষেরই সম্ভবত কম-বেশি জানা। তাই আক্ষরিক বিশ্লেষণের পরত পেরিয়ে যাওয়া যাক একটু গভীরে। আমরা যে সময়কালে জীবন কাটাচ্ছি, তাতে সর্বক্ষেত্রেই জড়িয়ে রয়েছে প্রযুক্তির অবাক করা বিকাশ। চাই কিংবা না চাই, প্রযুক্তির এমন উন্নয়ন আমাদের জীবনকে এক শতক আগের মানুষের জীবনাচার থেকে বহুলাংশে পাল্টে দিয়েছে। পরিণত করেছে সাইবার যুগের বাসিন্দায়। আর এই বিকাশের অন্যতম হাতিয়ার সোশ্যাল মিডিয়া। পরস্পর যোগাযোগের প্রশ্নে মুহূর্তেই পৃথিবীর নানা প্রান্তের, নানা সংস্কৃতির, নানা ভাষার মানুষদের বেঁধে দিয়েছে একই সুতোয়। তাই বর্তমান জীবনযাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্বকে অস্বীকার করার উপায় নেই বললেই চলে। তবে এ যে শুধু সুফলই এনেছে, এর কোনো বিড়ম্বনা নেই, সে কথা বলা যাবে না। কোনো বিচক্ষণ মানুষ বলবেও না তা। আর লৈঙ্গিক বিচারে এর নেতিবাচক প্রভাবের শিকার নারীরাই বেশি হয়ে থাকেন, সে কথাও আন্দাজ করার জন্য খুব বেশি বুদ্ধিমান হওয়ার দরকার পড়ে না। তাই বলে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করার মানে নেই; বরং ‘চিকিৎসা’র প্রয়োজনের মুখোমুখি হওয়ার আগে ‘সতর্কতা’ই শ্রেয়, এ ক্ষেত্রেও।
দুই
বলা হয়ে থাকে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। সোশ্যাল মিডিয়া এমন এক আদিগন্ত ভার্চুয়াল ময়দান, যার ব্যবহারকারীরা সবাই কম-বেশি যে যার মতো স্বাধীন। এ স্বাধীনতার ভুল ব্যাখ্যা, ভুল প্রয়োগ জন্ম দেয় সাইবার ক্রাইমের মতো জঘন্য ঘটনার। সেই সব ক্রাইমের শিকার পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি হয়ে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে এমন সব অপরাধের শাস্তিও হয়, তবে তা এখনো বিরল দৃষ্টান্ত। তাই এই ভার্চুয়াল ময়দানে নিজ সুরক্ষার দেয়াল নিজেরই গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে, যেন কোনো ভাচুর্য়াল রোগ বা সাইবার ক্রাইম সহসা আক্রান্ত করতে না পারে আপনাকে।
তিন
সোশ্যাল মিডিয়ায় কী পোস্ট করা উচিত আর কী অনুচিত, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। মতানৈক্যও রয়েছে অনেক। তবে বিশেষজ্ঞরা কিছু ব্যাপারে মোটামুটি একমত। চলুন, এমন কিছু প্রসঙ্গ জানা যাক। একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য, যেমন ফোন নম্বর ও বাসার ঠিকানা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট না করাই শ্রেয়। কেননা, এর সূত্র ধরে যেকোনো মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে বাজে কোনো অভিজ্ঞতা, এমনকি ভয়ানক বিপদ। নির্দিষ্ট কোনো মুহূর্তে কোথায় অবস্থান করছেন, সে তথ্যও না হয় না-ই জানা থাক আপামর নেটিজেনের। হয়তো কোথাও ভ্রমণে গিয়ে, কোনো রেস্তোরাঁয় কিংবা পার্টিতে অংশ নিয়ে, কিংবা কোনো আউটিংয়ে দারুণ উপভোগ করছেন আপনি। দারুণ সব ছবি তোলা, ভিডিও করা হলো। সবার সঙ্গে তা ভাগাভাগি করার ইচ্ছা করছে খুব। এমন লোভ সংবরণ করুন। কে জানে এমন পোস্টের অপেক্ষাতেই ওত পেতে রয়েছে কি না কোনো আততায়ী! একান্ত ব্যক্তিগত ছবি কিংবা ভিডিও প্রকাশের ব্যাপারেও থাকা চাই সতর্ক। অন্যথায় জীবন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ। এ রকম ভূরি ভূরি উদাহরণ তো আমরা নিত্যদিন দেখতে পাচ্ছি। তবু এ ধরনের তথ্য কিংবা পোস্ট যদি একান্তই প্রকাশ করতে হয়, সে ক্ষেত্রেও রয়েছে উপায়। প্রতিটি স্বীকৃত সোশ্যাল মিডিয়ার সেটিংসেই রয়েছে প্রাইভেসির ব্যবস্থা। তাই আশ্রয় নিন সেই টুলের। পাবলিক পোস্ট না দিয়ে, কোন তথ্য, কোন ছবি বা ভিডিও কে কে দেখতে পারবে, নির্ধারণ করে দিন। তাহলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকা যাবে।
চার
অতি সতর্ক জীবনযাপনের পরও শরীরে আচমকা হানা দিতে পারে কোনো রোগ। তার জন্য রয়েছে চিকিৎসাব্যবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রেও তাই। যদি কোনোভাবে আক্রান্ত হন সাইবার ক্রাইমের, জানি এমন মুহূর্ত সামলানো সহজ নয়, বিশেষত নারীরা অনেক ক্ষেত্রেই ভীষণ ভেঙে পড়েন, তবু রাখুন মনোবল। সহায়তা নিন সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় ভিকটিমের পক্ষে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয় না। তাই তার পরিবার-পরিজনেরও চাই এগিয়ে আসা। কেউ যখন আক্রান্ত, বিশেষত সাইবার ক্রাইমে, তখন ভিকটিমকেই দোষারোপ করার এক অনগ্রসর মানসিকতা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সমাজে। এই মানসিকতার উত্তরণ ঘটানো চাই। যদি ভিকটিমের কোনো দোষও থাকে, তার পরিজন বা বন্ধুবান্ধব হিসেবে তাকে সামলিয়ে ওঠার সময় দিন। কেননা, রোগাক্রান্ত কাউকে রোগ প্রসঙ্গ টেনে চাপ দিয়ে আরও অসুস্থ করে তোলা নিশ্চয় কোনো কাজের কথা নয়।
পাঁচ
আমাদের যাপিত জীবনে প্রযুক্তি যত ইতিবাচক সহায়ক টুল হাজির করেছে ও করছে, সেগুলো ব্যবহারের অধিকার আমরা জন্মগতভাবেই রাখি। অকারণ আতঙ্কিত হয়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া কোনো যথাযোগ্য সমাধান নয়। এতে সময়ের নিজস্ব মর্মোদ্ধারের পথ রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। আপনি পিছিয়ে পড়তে পারেন অনেকটুকু। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতায় যেমন আহ্বান করেছেন, ‘ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,/ এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা’। আপনারও পাখা গুটিয়ে না রেখে, সোশ্যাল মিডিয়ার মুক্ত আকাশে বিচরণের রয়েছে অধিকার। তবে সেই বিচরণ হোক যথেষ্ট সতর্কতায়।