টেকসহি I গ্রিন কসমেটিকস
ছোট্ট উদ্যোগ থেকে শুরু। ক্রমাগত বাড়ছে চাহিদা। জায়গা করে নিচ্ছে বাজারে। পরিবেশ রক্ষার বার্তা নিয়ে
দিন যত যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে তত বেশি আলোচনা হচ্ছে। এই জলবায়ু পরিবর্তনে প্রসাধনীরও বড় প্রভাব রয়েছে। প্রসাধনী তৈরিতে ব্যবহৃত নানা রাসায়নিক উপাদান, প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবেশ। তা ছাড়া অনেক দিন ধরেই গবেষকেরা রাসায়নিকের উচ্চ মাত্রার ক্ষতিকর দিক প্রকাশ করেছেন। তাই সম্ভাব্য এসব স্বাস্থ্যগত বিপদ ঠেকাতে সচেতন সৌন্দর্যপ্রেমীরা প্রাকৃতিক বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছেন। ইদানীং প্রসাধনীর বাজারে গেলে কিছু পণ্যের লেবেলে ‘ক্লিন’, ‘ন্যাচারাল’ ‘সাসটেইনেবল’ শব্দগুলো হরদম চোখে পড়ে। সাধারণত পুনর্ব্যবহারযোগ্য, বায়োডিগ্রেডেবল উপকরণ দিয়ে প্যাকেজ করা নন-টক্সিক প্রসাধনীকেই ‘গ্রিন কসমেটিকস’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
গ্রিন কসমেটিকস আসলে কী? কোনো প্রসাধনীর গায়ে শব্দটি লেখা দেখলে মানুষ স্বাভাবিকভাবেই পণ্যটিকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে ধরে নেবে। তবে এ ধরনের পণ্যের সংজ্ঞা আরেকটু স্পষ্ট হলে সবার জন্য বুঝতে সুবিধা হতে পারে। সাধারণত, পরিবেশবান্ধব ফর্মুলেশন বা প্যাকেজিং মেথড ব্যবহার করে তৈরি পণ্য বোঝানো হয় এ শব্দ দিয়ে। প্রসাধনী শিল্পের ক্ষেত্রে, যেসব পণ্য পুনর্ব্যবহারযোগ্য কাঁচামাল থেকে তৈরি করা হয়, সেগুলোকে গ্রিন কিংবা সাসটেইনেবল পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। প্রাকৃতিক ওলিওকেমিক্যাল উৎস ব্যবহার করে নামীদামি ব্র্যান্ডগুলোতে ব্যবহৃত নানা বিষাক্ত উপাদান এড়াতে পারে সাসটেইনেবল প্রসাধনী। পাম, নারকেল, আর্গান কিংবা অ্যাভোকাডোর মতো প্রাকৃতিক তেলকে এ ক্ষেত্রে রাসায়নিক সারফ্যাকটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
কৃত্রিম প্রসাধনীতে সচরাচর ব্যবহৃত এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলো কখনোই গ্রিন কসমেটিক পণ্যে থাকবে না। আর যদি পণ্যের লেবেলে এসব উপাদানের উপস্থিতি থাকে, তাহলে বুঝে নিতে হবে, সেটি আসল গ্রিন কসমেটিক পণ্য নয়। এই তালিকায় প্রথমেই আছে বিএইচএ এবং বিএইচটি। এ দুটি উপাদান সিনথেটিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা মূলত প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহৃত লিপস্টিক ও ময়শ্চারাইজিং ক্রিমে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে এগুলোর। ইউরোপীয় কমিশনের সূত্র থেকে জানা যায়, বিএইচএ এবং বিএইচটি মানবদেহের অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্রের কার্যক্রম (এন্ডোক্রাইন সিস্টেম) ব্যাহত করে। প্রসাধনীতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর উপাদানের মধ্যে এরপরেই রয়েছে কয়লার টার রঞ্জক। প্রসাধনীর লেবেলে কয়লার টার রঞ্জকগুলোকে পি-ফেনাইলেনডিয়ামাইন বা ‘সিআই’ রং হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এরপরই থাকে পাঁচ ডিজিটের একটি নম্বর। এ ধরনের রঞ্জক আসলে পেট্রোকেমিক্যালের মিশ্রণ, যা মানুষের দেহে ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে। ক্ষতিকর পদার্থের তালিকায় এরপরই আসে অ্যালুমিনিয়ামের নাম। সাধারণত অ্যান্টিপারস্পির্যান্টে (ঘাম কমাতে ব্যবহৃত) অ্যালুমিনিয়ামের উপস্থিতি থাকে। এই অ্যালুমিনিয়াম মানুষের আন্ডারআর্ম টিস্যুর মাধ্যমে শরীরে ঢোকে এবং ঘর্মগ্রন্থিগুলো বন্ধ করে দেয়। স্তন ক্যানসার ও অস্টিওপোরোসিসের মতো রোগের কারণ হতে পারে এটি।
এবার দেখা যাক গ্রিন কসমেটিকসে কী ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়। নারকেল ফ্যাটি অ্যাসিড, স্টিয়ারিক অ্যাসিড এবং অলিক অ্যাসিডের মতো প্রাকৃতিক ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো লুব্রিকেন্ট, আঠালো পদার্থ কিংবা রিলিজ এজেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়; পাশাপাশি ইমালসিফায়ার হিসেবেও কাজ করে। সাবান, সিরামিক পাউডার, লোশন ও ক্রিমের মতো পণ্যে ব্যবহার করা হয় এসব উপাদান। প্রাকৃতিক আরেকটি উপাদান ক্যাস্টর অয়েল। অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি ও ব্যথা উপশমকারী প্রোপার্টি যুক্ত এই তেল মূলত চুলের প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়। তা ছাড়া জ্যামাইকান ব্ল্যাক ক্যাস্টর অয়েলের মতো উপাদানগুলো মাথার ত্বক পরিষ্কার করতেও বেশ কার্যকর।
এ তো গেল মৃদু উপাদানের কথা। ফেস ক্রিম, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার, সানস্ক্রিন, লিকুইড সাবান, মেকআপ রিমুভারের মতো কিছু প্রসাধনী প্রিজারভেটিভ ছাড়া ব্যবহার উপযোগী থাকে না। গ্রিন কসমেটিকসে প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করা হয় ডিএমডিএম হাইডানটোইন নামক হ্যালোজেনমুক্ত শক্তিশালী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট।
বেশ কিছুদিন ধরেই ক্রেতাদের অনেকে ঝুঁকছেন গ্রিন কসমেটিকসের দিকে। সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবের ভয়াবহতা ও পরিবেশ রক্ষায় এগিয়ে আসা মানুষগুলো বাজারে থাকা নামীদামি ব্র্যান্ডের পণ্যের জায়গায় বেছে নিচ্ছেন এ ধরনের সাসটেইনেবল পণ্য। কিছুদিন পরপরই সমুদ্রতীরে প্লাস্টিকের স্তূপ জমা হওয়ার খবর পাই আমরা। তা ছাড়া তেল ও কার্বনের মতো বিষাক্ত পদার্থ সমুদ্রের পানিতে মেশার ফলে প্রায়ই মৃত প্রাণীও ভেসে আসতে দেখা যায় তীরে। তা ছাড়া এসব পণ্যের প্যাকেজিংয়ে যেসব প্লাস্টিক ব্যবহৃত হয়, সেগুলো পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধু পরিবেশ বাঁচাতে নয়, নিজের ত্বক বাঁচাতেও কার্যকর গ্রিন কসমেটিকস। প্রচলিত প্রসাধনীতে ব্যবহৃত অনেক পেট্রোকেমিক্যাল পরিবেশের পাশাপাশি আমাদের দেহের জন্যও ক্ষতিকর। প্রাকৃতিক এবং ওলিওকেমিক্যাল সমৃদ্ধ উপাদানে ত্বকে জ্বালাপোড়া বা অ্যালার্জির প্রতিক্রিয়া হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে। সিনথেটিক, বিষাক্ত রাসায়নিক কিংবা কৃত্রিম রং বাদ দিয়ে ভেষজ উদ্ভিদ ও প্রাণীদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া উপাদান নিয়ে তৈরি হয় সাসটেইনেবল পণ্যগুলো। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় গ্লিসারিনের কথা। পাম অয়েলের একটি প্রাকৃতিক উপজাত গ্লিসারিন। রংবিহীন, নন-টক্সিক এ পদার্থ তরল সাবান, ফার্মাসিউটিক্যালস ও প্রসাধনীতে ব্যবহৃত হয়। পানি ধারণক্ষমতার জন্য এটি একটি চমৎকার ময়শ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে, সেই সঙ্গে দেহে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়াও ফেলে না।
গ্রিন কসমেটিকসের উপকারিতা দীর্ঘমেয়াদি। বিভিন্ন পেট্রোকেমিক্যাল যুক্ত প্রসাধনী খুব দ্রুত ত্বকে কাজ করতে পারলেও এসবের প্রভাব স্বল্পমেয়াদি। উল্টো এ ধরনের প্রসাধনী আমাদের দেহ ও পরিবেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। কৃত্রিম প্রসাধনী ব্যবহারে বছরের পর বছর মাথাব্যথা, চোখের ক্ষতি, ব্রণ, হরমোনের ভারসাম্যহীনতা ও অকালবার্ধক্যের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। এমনকি কিছু উপাদান ক্যানসার সৃষ্টিকারী কোষ তৈরিতেও ভূমিকা রাখে।
গ্রিন কসমেটিকসের চাহিদা বাড়লেও এখনো সেগুলো বাজারে কৃত্রিম প্রসাধনীর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার অবস্থানে পৌঁছায়নি। তবে মানতেই হবে, পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব পণ্যের সংখ্যা ও চাহিদা আরও বাড়বে। ক্রেতা ও রিটেইল বিক্রেতাদের কাছে প্রাকৃতিক বা সাসটেইনেবল উপাদানসমৃদ্ধ প্রসাধনীর চাহিদা বৃদ্ধির কারণে গ্রিন কসমেটিকসের বাজার বার্ষিক ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে জানা যায় অ্যাকমে হার্ডেস্টি থেকে। এই বৃদ্ধির হার বিশ্বব্যাপী পার্সোনাল কেয়ার এবং প্রসাধনী শিল্পের বার্ষিক বৃদ্ধিকে ছাড়িয়ে গেছে, সামগ্রিকভাবে যার বর্তমান বার্ষিক বৃদ্ধি ৫ শতাংশ। ২০২৫ সালের মধ্যে অরগানিক বিউটির বাজার ২৫ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তা ছাড়া পার্সোনাল কেয়ার শিল্পের প্রসাধনী উৎপাদনকারীরা পেট্রোকেমিক্যাল থেকে দূরে সরে যাওয়ায় ওলিওকেমিক্যাল বাজার বেড়ে চলেছে। আবার এই ওলিওকেমিক্যালের প্রধান উপাদান ফ্যাটি অ্যাসিড, যা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর। বর্তমান চিত্র থেকেই স্পষ্ট, পরিবেশ বাঁচানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস হিসেবে গ্রিন কসমেটিকসের যে ছোট্ট উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তা অচিরেই প্রসাধনী বাজারে জায়গা করে নেয়ার দারুন সম্ভাবনা রাখে।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: সংগ্রহ