মনোজাল I তুলনা তাণ্ডব
তুলনা-সংস্কৃতি। ছড়িয়ে পড়ার দায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের। চাই সচেতনতা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্রমশ জনপ্রিয়তা নানাভাবে বর্তমান প্রজন্মের একটি বড় অংশের মানসিক চাপের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বজুড়ে চিত্র একই। পাশাপাশি সামাজিক গবেষকেরা ধারণা করছেন, সোশ্যাল মিডিয়া তুলনা-সংস্কৃতি নামক নতুন একটি মানসিক রোগের জন্ম দিয়েছে। যার প্রভাব ভয়ংকর। ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী এ রোগে ভুগছেন। ভার্চুয়াল বন্ধুর সুন্দর চেহারা, দামি ও সুখী জীবন দেখে তৈরি হয় ঈর্ষা, আর সেখান থেকেই জন্ম এ মনোরোগের। ফেসবুক বন্ধুর কাল্পনিক শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কিংবা তার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে স্নায়ুজনিত উত্তেজনার শিকার হন তারা। কাল্পনিক বলার কারণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় যিনি যেভাবে চান, নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। তার জীবন বা চেহারা আসলেই এত সুন্দর কি না, এর কোনো প্রমাণ থাকে না। কিন্তু স্বভাবজাত কারণেই মানুষ অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে এবং শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মনে মনে হেরে গিয়ে হতাশ হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সৌন্দর্যপিয়াসী তরুণীদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি। তারা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে প্রচুর সময় কাটান এবং অন্যকে দেখে একধরনের তুলনা-সংস্কৃতির জালে আটকা পড়েন।
গবেষকদের ধারণা, এই অ্যাপগুলো প্রতিকূল মনস্তাত্ত্বিক ফল এবং দুর্বল চেহারা-সম্পর্কিত আত্ম-উপলব্ধিতে অবদান রাখে, আবার একই সঙ্গে ঈর্ষা প্রভাবক হিসেবেও কাজ করে। অমুক এ রকম সুন্দর, সুতরাং আমাকেও তেমন সুন্দর হতে হবে, সেভাবে ছবি পোস্ট করতে হবে, যাতে অনেক লাইক পাওয়া যায়, বন্ধুসংখ্যা বাড়ে, প্রশংসার স্তুতিতে ভরে যায় কমেন্ট বক্স। না পাওয়া গেলেই অস্থিরতা, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া থেকে শুরু করে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রযুক্তির উত্থানের ফলে যে কেউ তার চেহারাকে ম্যানিপুলেট করার ক্ষমতা রাখেন। ফিল্টার ত্বককে মসৃণ করা থেকে শরীরের অপূর্ণতাগুলো দূর করে, কোমরকে পাতলা করে এবং সৌন্দর্যের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আকার কমিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। যে যত দক্ষভাবে ব্যাপারটি করতে পারেন, তার সফলতা তত বেশি। আর এই এয়ারব্রাশ করা ফটোশুটের কল্যাণে সাধারণ মস্তিষ্কে অস্থিরতা তৈরি হয়। সেখান থেকেই উন্মেষ ঘটে তুলনা-সংস্কৃতির।
‘সামাজিক তুলনা তত্ত্ব’ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি তার অগ্রগতি মূল্যায়ন করার জন্য গাড়ি চালান এবং উদ্দেশ্যমূলক মানগুলোর অনুপস্থিতিতে তিনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, তা জানতে অন্যদের সঙ্গে নিজের তুলনা করেন। তুলনামূলক বিচারে নারী বা তরুণীরা এ প্রবণতার জালে বেশি আটকা পড়ার মূল কারণ, তারা সামাজিক গণমাধ্যমগুলোকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নেন। নিজ সৌন্দর্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগেন বলেই অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেন। সেই তুলনার তালিকায় কসমেটিক সার্জারি করা তারকারাও বাদ নেই।
মজার ব্যাপার হলো, অনেক ইউজারই সম্পাদিত ছবি ধরতে পারেন না। পরিসংখ্যান বলে, ৬০ শতাংশ মানুষ হয়তো সম্পাদিত ছবি চেনার ক্ষমতা রাখেন। ফলে বেশির ভাগ তরুণীই ঝলমলে সেসব ছবি দেখে হীনম্মন্যতার শিকার হন, মানসিক অস্থিরতার কবলে পড়েন। ব্যাপারটা এত বেড়েছে, ইদানীং এসব কারসাজি করা মুখ ও ফিগার নিয়ে ইনস্টাগ্রামে প্রকাশবিষয়ক বিধিনিষেধ বাধ্যতামূলক করা উচিত কি না, সেই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, এতে দুর্বল মস্তিষ্কে সৌন্দর্যের একটি বিকৃত অনুভূতি তৈরি হয়, বিশেষত যারা মানসিক দুর্বলতায় ভোগেন, তাদের ক্ষেত্রে। গবেষকেরা দেখেছেন, সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া সৌন্দর্যের একটি আদর্শ চিত্র সাধারণ নারীদের শরীরের চিত্রের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
কসমেটিক সার্জারির বিশ্বব্যাপী উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে এই সোশ্যাল কমপ্যারিজন বা সামাজিক তুলনা। পাশাপাশি বেড়েছে নিজেকে সুন্দর করে তোলার জন্য নানা রকম ক্ষতিকর কসমেটিকসের ব্যবহার। যেভাবেই হোক, আমাকে ওর চেয়ে বা ওর মতো সুন্দর হতে হবে। আসলে, ভার্চুয়াল সমাজে গ্রহণযোগ্যতা এবং সামাজিক সম্মতির স্বার্থে জীবন হুমকিপূর্ণ নানা রকম সৌন্দর্য প্রবণতায় অংশ নিতে তারা রীতিমতো বাধ্য হন; যা একসময় মানসিক সুস্থতাকে প্রভাবিত করে। ফেসকাটের নানা পরিবর্তন থেকে শুরু করে আকর্ষণীয় ফিগার তৈরি করতে বদ্ধপরিকর এসব সৌন্দর্যপিয়াসী নারী জেনে বা না জেনে এমন সব কাজ করেন, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হন নিজেরাই। পরিসংখ্যান বলে, ৬০ শতাংশ ব্যবহারকারী, ভার্চুয়াল সৌন্দর্যবিশ্বে নিজেকে তুলনা করে সম্পর্ক কিংবা সামাজিক সম্মান হারানোর মতো বিভিন্ন আশঙ্কায় ভোগেন। আর তার অভিশাপ চক্রাকারে ঘুরতে থাকে জীবনের নানা স্তরে। শুধু ব্যক্তিজীবনেই নয়, নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তার পারিবারিক জীবনেও। এমনকি এই আবেগে ভেসে যাওয়া মানুষ যখন কাঙ্ক্ষিত ফল পান না, তার মনের চিত্র পরিবর্তিত হয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে।
২০২০ সালে ‘ইনস্টাগ্রাম বনাম বাস্তবতা’ নামক এক গবেষণায় গবেষকেরা এ-সংক্রান্ত ‘বাস্তব’ চিত্র পর্যবেক্ষণ করেছেন। সেখানে বেরিয়ে এসেছে শিউরে ওঠার মতো তথ্য। দেখা গেছে, আদর্শ ছবি হিসেবে চিহ্নিত জনপ্রিয় বা ভাইরাল বেশির ভাগ ছবিই আসলে নানাভাবে ফিল্টার করা, যা বহু নারীর অসন্তোষের কারণ হয়ে ছিল। তারা না বুঝেই একটা মিথ্যার পেছনে ছুটেছেন অন্ধের মতো। সে কারণে আজকাল বলা হচ্ছে, যেভাবেই হোক এই সামাজিক তুলনা প্রক্রিয়ার গতি রোধ করা দরকার। যদিও অস্বীকার করার উপায় নেই, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব বিকাশের মাধ্যম হলেও অন্যের বিষয়ে অকারণ উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়। এর মোহনীয় অথচ নেতিবাচক প্রভাবে আমরা বিভ্রান্তির জালে জড়িয়ে পড়ি, যা বিশেষ করে আমাদের সুস্থ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এ ফাঁদে আটকা পড়ে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার আশায় বাস্তবতাকে লুকিয়ে আমরা অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়াতে নিজেকে উপস্থাপন করি মিথ্যাভাবে। একসময় সেই মিথ্যাকে বাস্তব মনে করে যে দেয়াল তৈরি হয়, তা যখন ভেঙে পড়ে, তখনই ঘিরে ধরে হতাশা। তাই যেভাবেই হোক, এই সৌন্দর্য-তুলনা থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে অ্যাকসেপ্ট করা চাই। মনোবিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর এই সামাজিক তুলনায় জড়িত হওয়ার ঝুঁকি কমাতে নিজের বাস্তবতাকে মন খুলে গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রত্যেক মানুষেই বিদ্যমান শক্তি এবং দুর্বলতার মিশ্রণ। কেউ পারফেক্ট নন। তারপরেও কাউকে যদি পারফেক্ট মনে হয়, তাকে অনুসরণ না করে বরং নিজের ইমপারফেকশনকে ভালোবাসতে শেখাটা জরুরি। তাতেই জটিলতা কমবে, জীবন হবে সুন্দর।
রায়া ফাতিমা
মডেল: মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস