এডিটর’স কলাম I আত্মশুদ্ধির আহ্বান
মনের গোপন গহিনে কখনো জ্ঞাতসারে, আবার কখনো অজ্ঞাতে জমা হতে থাকে ছোট-বড় নানা নোংরা ভাবনা
আত্মশুদ্ধি। আরবিতে তাযকিয়াতুন নাফস। সংক্ষেপে তাযকিয়াহ। আভিধানিক অর্থ নিজেকে সংশোধন ও পরিশুদ্ধ করা। ইসলামের পরিভাষায়, যেকোনো ধরনের অনৈসলামিক কথা ও কর্মকাণ্ড থেকে নিজের অন্তরকে মুক্ত ও নির্মল রাখা। সহজ কথায়, সব ধরনের পাপ, পঙ্কিলতা, অনৈতিক ভাবনা ও কাজ থেকে নিজের মনকে বিশুদ্ধ করে তোলা। ‘বুখারি ও মুসলিম’ শরিফে বর্ণিত রয়েছে, মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘জেনে রেখো, শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড রয়েছে। তা যদি সংশোধিত হয়ে যায়, তাহলে গোটা শরীরই সংশোধিত হয়। আর তা কলুষিত হলে গোটা শরীরই কলুষিত হয়ে যায়। মনে রেখো, তা হলো কাল্ব বা অন্তর।’ পবিত্র রমজান মাস ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য আত্মশুদ্ধির এক দারুণ উপলক্ষ।
দুই
মানুষ মূলত শরীর ও মনের সমন্বয়ে গড়া। শরীর দৃশ্যমান; মন অদৃশ্য, তবে বিরাজমান। জীবনের চলতি পথে প্রতিনিয়ত নানা কারণে কলুষিত হয় শরীর। সরলভাবে ভাবলে, নানা ধূলি ও আবর্জনার প্রলেপ পড়ে আমাদের শরীরের বাহ্যিক কাঠামোর ওপর। তা থেকে মুক্তি পেতে যেকোনো সচেতন মানুষই নিয়মিত গ্রহণ করে পরিচ্ছন্নতার আশ্রয়। পানি, সাবান, শ্যাম্পু … কত কীই-না আমরা ব্যবহার করি শরীরকে বিশুদ্ধতা এনে দিতে। অন্যদিকে, ত্বকের আড়ালে থাকা যত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, সেগুলোও আক্রান্ত হয় নানা সময়ে নানা রোগে। তা সারিয়ে তুলতে দ্বারস্থ হই চিকিৎসকের। গ্রহণ করি ওষুধ-পথ্য। একইভাবে অন্তরকে সারিয়ে তোলারও ব্যাপার রয়েছে। অন্তরেও বাসা বাঁধে অসুখ। তার জন্য হয়তো ছুটে যাই কোনো মনোচিকিৎসকের কাছে। কিন্তু আমাদের যে ভাবনা জগৎ, যেখানে সব মানুষই নিজের মতো কম-বেশি স্বাধীন, সেই স্বাধীনতাকে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ ও সুপথে ব্যবহার করি আমরা? মনের গোপন গহিনে কখনো জ্ঞাতসারে, আবার কখনো অজ্ঞাতে জমা হতে থাকে ছোট-বড় নানা নোংরা ভাবনা। আর তা আমাদের অনেক সময় ঠেলে দেয় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দিকে। সেই সব ভাবনা থেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করে তুলতে না পারলে একদিকে যেমন নিজের ও অন্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠব, অন্যদিকে রেহাই পাব না আল্লাহর দরবারেও। তাই মানুষ হিসেবে আত্মশুদ্ধি ছাড়া পরিত্রাণ নেই আমাদের।
তিন
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার ইবাদতের জন্য। ইবাদতের পূর্বশর্ত পবিত্রতা। তাই ইবাদতের জন্যও আমাদের দেহ ও মনকে কালিমামুক্ত রাখা বাঞ্ছনীয়। আর তা লাভ করা সম্ভব আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে। তা ছাড়া আত্মশুদ্ধি মানুষের মধ্যে বিকাশ ঘটায় মানবিক ও নৈতিক গুণাবলির। তাতে সমাজে বিরাজ করে শান্তি-শৃঙ্খলা। তাই একজন সামাজিক মানুষ হিসেবেও আত্মশুদ্ধি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে তার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করেছে, সে-ই সফল; এবং যে তার আত্মাকে কলুষিত করেছে, সে-ই ব্যর্থ’ [সুরা: শামস]।
চার
ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাজ্ঞ আলেমরা আত্মশুদ্ধি লাভের তিনটি প্রধান ও সহজ উপায় বর্ণনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে শুরুতেই জোর দেওয়া হয়েছে জাগতিক মোহ ত্যাগ করার ওপর। জানা কথা, মরণশীল জেনেও দুনিয়ার প্রতি মোহ মানুষের ভেতর সহজাতভাবে রয়ে যায়। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘বৃদ্ধদের অন্তর দুটি বিষয়ে তরুণ থেকে যায়—জাগতিক জীবনের ভালোবাসা এবং দীর্ঘ আশা’ [সহিহ বুখারি]। এই অবস্থা থেকে মানুষ সহজে বেরিয়ে আসতে পারে না। আর তা অনেক সময় তাদের ঠেলে দেয় নানা পাপকর্মে। মহানবী (সা.) আরও বলেছেন, ‘দুনিয়ার মোহ হলো সব পাপের মূল’ [সুনানে বায়হাকি]। আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য সবার আগে ত্যাগ করা চাই জাগতিক মোহ। এমন মোহ ত্যাগ করতে পারলে মানুষের মন আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে, জাগতিক জীবনে প্রবঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া যায় এবং দুনিয়ার পেছনে ছোটার অনর্থক অস্থিরতা ও যাতনা থেকে পাওয়া যায় মুক্তি। আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য দুনিয়া এবং এর প্রকৃতিকে সঠিক রূপে জানার ওপরও জোর দিয়েছেন আলেমরা। কেননা, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে দুনিয়া ও জীবনকে জানতে-বুঝতে পারলে মানুষের মনে পঙ্কিলতা সহজে জায়গা করে নিতে পারে না। প্রাজ্ঞ আলেমরা আরও জোর দিয়েছেন পার্থিব জীবনের ব্যাপারে দীর্ঘ আশা ত্যাগ করার ওপর। কেননা, অন্যথায় পাপ বাসা বাঁধার সুযোগ পায়। সহজ কথায়, ধর্মীয় বিধান মেনে জীবনযাপন করা, সব সময় আল্লাহকে স্মরণ ও ভয় করা, খারাপ কাজের শাস্তি সম্পর্কে জানা এবং তা স্মরণে রাখা, গুনাহ পরিত্যাগ করা, কবর ও জাহান্নামের কথা মনে রাখা, আখেরাত স্মরণে রাখার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি লাভ করা সম্ভব।
পাঁচ
আত্মশুদ্ধি একজন মানুষকে সত্যিকারের মানুষে পরিণত করে। অন্যথায় নিজের জীবন যেমন হয়ে উঠতে পারে দুর্বিষহ, অন্যদের ওপরও পড়তে পারে তার নেতিবাচক প্রভাব।
জীবন সুন্দর হোক সবার। শুদ্ধ হোক অন্তর।