মনোজাল I সুগন্ধ প্রতাপ
ঘ্রাণের টানে ফিরে আসে হারানো অতীত। করে তোলে নস্টালজিয়ায় ঘোরগ্রস্ত। কী তার কারণ?
রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। হঠাৎ কোনো গন্ধ পেয়ে চমকে উঠলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে শুরু করলেন উৎস। কেন? এ গন্ধ আপনাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পরিচিত কোনো মানুষের কথা। মনে হচ্ছে, তিনি হয়তো আশপাশেই। কেননা, নিয়মিত এই পারফিউম গায়ে মাখতেন তিনি। সেই গন্ধে তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছেন। কিংবা গন্ধ আপনাকে মনে করিয়ে দিতে পারে এমন কোনো স্মৃতি যেটি আনন্দ, বিষাদ, ভালোবাসা, কষ্ট—যেকোনো কিছুর হতে পারে। হয় না?
আমরা কম-বেশি সবাই কোনো না কোনো সময় এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। ছোটবেলায় পাওয়া মায়ের শরীরের গন্ধ সারা জীবনেও ভোলা অসম্ভব। কারণ, ঘ্রাণ আমাদের মেজাজ, একাগ্রতা, স্মৃতি ও আবেগকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। ‘পারফিউম’ মুভিটি দেখেছেন? কিংবা পারফিউমকে বেইজ করে বানানো নেটফ্লিক্সের অসাধারণ ড্রামা সিরিজগুলো। যারা দেখেছেন, নিশ্চয়ই জানেন, ঘ্রাণ কী রকম অবিশ্বাস্যভাবে শক্তিশালী। যেকোনো পরিচিত ঘ্রাণ আমাদের অবিলম্বে ঘনিষ্ঠতা, আনন্দ কিংবা হতাশার সময়ে ফিরিয়ে নিতে জাদুকরি ভূমিকা রাখতে পারে।
আসলে, ড্রেসিং টেবিলে সাজানো পারফিউমের কাচের বোতলগুলো শুধু শরীরকে সুগন্ধময় করে তুলেই ক্ষান্ত হয় না; মাঝে মাঝে রীতিমতো টাইম ক্যাপসুল হয়ে ওঠে!
আমাদের বিবেকের গভীরে মুহূর্তের জন্য আবেগ জাগিয়ে তোলে। হাসায়, কাঁদায়; পরিবেশ করে তোলে মোহময়। পারফিউমের এই ম্যাজিক্যাল পাওয়ার নিয়ে তাই গবেষণার শেষ নেই। রোজই বের হয়ে আসছে চমৎকার সব তথ্য। যেমন ঘ্রাণ স্মৃতি ধরে রাখে। যদিও আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের প্রতিটি স্মৃতি ধরে রাখা এবং তা পুনর্গঠনে অবদান রাখে; তবে এ ব্যাপারে সুগন্ধগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ড. সিলভিয়া অ্যালাভা ‘গন্ধ ও আবেগ’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেছেন। তাতে দেখা গেছে, মানুষ তাদের গন্ধের ৩৫ শতাংশ মনে রাখেন; অন্যদিকে, যা দেখেন, মনে রাখেন তার মাত্র ৫ শতাংশ। গবেষণায় বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী উল্লেখ করেছেন, কীভাবে নির্দিষ্ট ঘ্রাণ তাদের আনন্দের স্মৃতিগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করে তোলে। এমনকি কোনো কিছু কিনতে গিয়ে উল্লেখিত পণ্যের সঙ্গে গ্রাহক যদি তার পছন্দের গন্ধের যোগসূত্র পান, তাতে চাহিদার পরিমাণও বেড়ে যায়। পণ্যগুলো যখন আনন্দদায়ক ঘ্রাণের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তখন প্রায় সময় আরও আকর্ষণীয় হয়; তাই সেগুলোর একটি বৃহত্তর ইতিবাচক মানসিক আবেদন তৈরি হয় গ্রাহকের কাছে।
বলা হয়ে থাকে, ঘ্রাণ মানুষ চিনতে সহায়তা করার ক্ষমতা রাখে। বেশির ভাগ মানুষ অন্যকে তাদের গন্ধের ওপর ভিত্তি করে বিচার করেন। ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশে ঘ্রাণের বেশ বড় ভূমিকা রয়েছে। কী ধরনের পারফিউম ব্যবহার করছেন, তা অন্যদের কাছে প্রথমেই আপনার অলিখিত পরিচয় করিয়ে দেয়। পুরো ব্যাপারটাই মানসিক। যেমন পাশ দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে যদি খুব সুন্দর মৃদু গন্ধ পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, মানুষটি অভিজাত, রুচি উন্নত। এভাবে পরিচিতি না থাকলেও ঘ্রাণের কল্যাণে তার ওপর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কিংবা এমনও হতে পারে, তার কোনো ভালোবাসার বা পছন্দের কেউ হয়তো এমন অ্যারোমা ব্যবহার করতেন, তাতে নিজের অজান্তেই অচেনা মানুষটির প্রতি একধরনের মমতা বা আবেগ সৃষ্টি হয়। শুধু ঘ্রাণের কারণে একদম অপরিচিত মানুষকে আপন মনে হয়। আবার, সুগন্ধের বিষয়গত পছন্দের ওপরও ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যগুলো ধরা যায়। একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের উপলব্ধিগুলো সুগন্ধি গঠনের ওপর নির্ভর করে ভিন্ন হয়। ব্যাপারটা সহজে বলা যাক। ধরুন, ফ্লাওয়ার অ্যারোমা বেইজড পারফিউম পছন্দ করেন না, আপনার পছন্দ সাইট্রাস। ঠিক তেমনভাবে এমন আরেকজন সাইট্রাস পছন্দের মানুষের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের মিল খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা ৮০ শতাংশ।
সুগন্ধের পরিবর্তন ক্ষমতাও রয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, সুগন্ধিভিত্তিক প্রথম ইমপ্রেশন চাকরি পাওয়া থেকে শুরু করে এমনকি একজন রোমান্টিক সঙ্গী খুঁজে পেতেও সহায়তা করতে পারে। তবে তারা প্রয়োজনের সময় আপনার সমর্থন বা অন্যকে সাহায্য করার সম্ভাবনা কতটা প্রভাবিত করবেন, তা নির্ধারণ করে মস্তিষ্ক। যেমন রোস্টেড কফি, মিষ্টি পেস্ট্রি কিংবা ফুলেল পারফিউমের মতো মনোরম গন্ধে ঘেরা অপরিচিত জায়গাকেও হঠাৎ আমাদের কাছে পরিচিত কিংবা খুব ভালোবাসার মনে হতে পারে। কারণ, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মনোরম ঘ্রাণের সূক্ষ্ম ইতিবাচক স্মৃতি অনুভূতির স্মরণকে ট্রিগার করতে সক্ষম, যা আমাদের মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে। আর এই মেজাজ পরিবর্তন পরবর্তীকালে যে কারও সামাজিক আচরণকেও প্রভাবিত করে।
ভালো গন্ধ ভালো বোধ তৈরি করে; বিশেষ করে মানসিক সুস্থতা উন্নত করতে বেশ কাজে দেয়। এটি মানুষের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে অনুরণন ঘটানোর ক্ষমতা রাখে। ব্যাপারটি পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক—এমনটা বলা যাবে না। গবেষণায় দেখা গেছে, ল্যাভেন্ডার-ইনফিউজড পারফিউম ব্যবহারে প্রাপ্তবয়স্করা অনেক রিল্যাক্সড বোধ করেন; তাদের মেজাজ উন্নত হয় এবং গণিতের গণনায় তারা আগের চেয়ে দক্ষ হয়ে ওঠেন। নির্দিষ্ট সুগন্ধি মন ও শরীর উভয়কে শান্ত রাখতে, বর্তমান মুহূর্তে ফোকাস উন্নত করতে বিশেষভাবে কার্যকর। যেমন চাপ কমানো ওষুধ খাওয়ার চেয়ে সন্ধ্যায় একটি সুগন্ধ মোমবাতি জ্বালানো উদ্বেগ কমাতে অনেক বেশি সাহায্য করতে পারে। তার মানে, শুধু একটি গন্ধ যোগ করা কিংবা পরিবেশকে মোহময় করার চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ও উদ্দেশ্য রয়েছে সুগন্ধির। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যেকোনো সুন্দর গন্ধের সংস্পর্শ আমাদের মেজাজকে ৪০ শতাংশ উন্নত করার ক্ষমতা রাখে। মানসিক চাপ তো কমায়ই, ঘুমকেও প্রভাবিত করে।
এই মনোমুগ্ধকর কার্যকর প্রভাবের কারণে আজকাল সৌন্দর্যবিশ্বে গন্ধের গুরুত্ব নিয়ে নতুনভাবে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে। সে কারণেই বলা হচ্ছে, কী পরছি বা কীভাবে সাজছি, তার চেয়েও অনেক বেশি জরুরি, কোন সুবাসে নিজেকে সুবাসিত করছি। কারণ, সেটি অনেকাংশে নির্ধারণ করে দেয় ভেতরের আসল মানুষকে।
রায়া ফাতিমা
ছবি: ইন্টারনেট