ছুটিরঘণ্টা I স্বর্ণখচিত মরূদ্যানে
মরুর বুকে এ যেন আদিগন্ত স্বর্ণে গড়া ইন্দ্রজাল! অন্তরে দোলা দিয়ে যাওয়া প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্য। সঙ্গে স্থানীয়দের আতিথেয়তা। লিখেছেন ফাতিমা জাহান
সোনালি শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়াচ্ছি। যা দেখি সবই স্বর্ণরঙা। চোখধাঁধানো। বাজার, গলি, দেয়াল, বাড়িঘর—সব যেন স্বর্ণ দিয়ে বাঁধিয়ে কেউ কারুকাজ করেছে। ইট-পাথরের শহরের রং আচমকা সোনালি হয়ে যাবে, ভাবতেও পারিনি। বাইরে বসন্তের রোদ তাতিয়ে মারছে। এ দেশের সব নারী হয় লাল, নয় গোলাপি ঘাঘরা চোলি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। একে তো চোখ ঝলসে যাচ্ছে সরু অলিগলির সোনালি আঁচে, তার ওপর এই রঙিন সুন্দরী নারীরা বসন্তের শেষ দিকের বাতাসকে আরও উসকে দিতে চাইছেন। আমার পছন্দের রঙিন শহর তো আছে অনেক এই জগতে, কিন্তু ঐশ্বর্য ভান্ডারের সব হিরে-জহরত নিয়ে, পাহাড়সমান স্বর্ণের স্বর্গ হৃদয় নিয়ে জেগে থাকে ভারতের রাজস্থানের জয়সালমেরের শহর।
উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়িয়েছি অনেক শহরে, কিন্তু এভাবে ঘুরে বেড়ানো যে এত রঙিন, চমকপ্রদ হতে পারে, কে জানত! গলির এক মাথায় দাঁড়িয়ে একটি বাড়ির ছবি তুলছিলাম। বাড়ি তো নয় যেন রাজপ্রাসাদ। সোনালি রঙের স্যান্ডস্টোনের ওপর সূক্ষ্ম খোদাই করা কারুকাজ, ফুল লতা পাতা নকশা। সেই বাড়ির মালকিন আমাকে দেখে বেরিয়ে এসে বারান্দায় বসতে বললেন। পানি খেতে দিলেন। আরও বললেন, দুপুরের খাবার যেন তাদের সঙ্গে খাই। এই সমাদর, ভালোবাসা, মায়া একমাত্র রাজস্থানেই পাওয়া সম্ভব! আমি বাড়ির মালকিনকে নিরাশ করি কী করে, যার মনটা এক রাজকীয় অভ্যর্থনায় পূর্ণ? আমাকে বসিয়ে রেখে তিনি নিয়ে এলেন লাচ্ছি ও মিষ্টি। এত মিষ্টি আতিথেয়তায় নতুন করে আরও মধু ঢেলে দিল আশপাশের প্রতিবেশিনীদের কলকাকলি। কত বিদেশিই তো এই অলিগলিতে চক্কর কাটতে থাকেন, কিন্তু আমার মতো সৌভাগ্যবান সম্ভবত আর নেই।
দুপুরের শাকাহারী ভোজন সেরে আবার অলিগলিতে অলিখিত নিয়মে ঘুরে বেড়াচ্ছি। গলির বেশির ভাগ বাড়িই দোতলা। নিচতলায় দোকান আর দোতলায় থাকেন বাড়ির মালিক। এমন একটি রাজস্থানি কাপড়ের দোকানে আমি আটকে গেলাম। এত রঙের রাজস্থানী সুতি জামাকাপড়, ব্যাগ শোভা পাচ্ছে, মনে হলো সব কিনে বাড়ি নিয়ে যাই। দোকান সামলাচ্ছেন অজয় নামের একটি ছেলে। যত বলি আর দেখতে চাই না, তত বেশি জামা দেখাচ্ছেন। চা, শরবত—রাজ্যের সব খাবার খাওয়াতে চাইছেন। আমি বিকেলবেলার সোনালি আভা মাখতে কাছাকাছি এক জলাধারের কাছে যেতে চাইলাম। মরুভূমির বালি সব সময়ই তপ্ত থাকে, পুড়িয়ে দিতে চায় সোনালি ফুল হয়ে। কখনো কখনো জলাধার মনে করিয়ে দেয়, এখানে এখনো কিছু মরীচিকার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। অজয়ের বাবা আমার সঙ্গে অজয়কে পাঠালেন, যদি পথ হারিয়ে ফেলি, সেই ভয়ে। বলে রাখি, পরদেশি বা মেহমানকে এই অঞ্চলে সৌভাগ্যবহনকারী হিসেবে গণ্য করা হয়।
গাদিসার লেক মাঝারি আকারের জলাধার। জলের ওপর ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে পায়রা। শুনেছি স্বচ্ছ টলটলে জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকলে মরুভূমির দেশে নাকি পুণ্য বাড়ে। কিন্তু এর চেয়ে পুণ্যের কাজ হলো গাদিসার লেকের মাঝে এক আরামগাহে গিয়ে বসে থাকা! ঠিক লেকের মাঝখানে কোনো এক মহারাজা নির্মাণ করেছেন এক ছোট্ট অবকাশ ঘর। তাতে সোনালি স্যান্ডস্টোনে ছাতার আকারের ছাদ, যেন স্বর্ণখচিত দ্বীপ। চারপাশ খোলা সেই দ্বীপে যেতে হয় নৌকায়। এদিকটায় তেমন ট্যুরিস্ট আসেন না। তাই নৌকা নিতে হলো স্থানীয় একজনের সহায়তায়। দ্বীপের চারদিকে পানি আর পানি। যদিও খুব বেশি বিস্তৃত নয়, তবু এই মরুর দেশে সন্ধ্যের রেশে যা ঠান্ডা পড়ে, তা ভুলতে পারার নয়।
পরদিন সোজা হানা দিলাম কেল্লায়। মানে সোনার কেল্লায়। আমি যাযাবর মানুষ, চারদিকের জ্ঞান কম। যেখানে মন চায়, চলে যাই। জয়সালমেরে এসে সোনার কেল্লা না দেখলে জীবনের বারো আনাই বৃথা, মনে হলো। সোনার কেল্লা বা জয়সালমের দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন মহারাজা রাওয়াল জয়সাল, ১১৫৫ সালে। এটি ভারতের একমাত্র দুর্গ, যেখানে মহারাজার মহলের সঙ্গে নগরের আমজনতাও দুর্গের ভেতরে বসবাস করতেন। শত্রু আক্রমণ করলে নিরাপত্তা চাই; তা মহারাজ শুধু নিজের জন্যই নয়, প্রজাদের জন্যও নিশ্চিতের কথা ভেবেছিলেন। স্বর্ণের তুলিতে, স্বর্ণ কেটে কেটে তৈরি এই দুর্গ। এর বাইরে এখন বাহারি ঘাঘরা চোলিতে রঙিন হয়ে রাজপুত নারীরা বসন্তের জানান দিতে দিতে আমার কাছে আবদার করছেন, পায়ের নূপুর নয়তো কোমরের বিছা কেনার জন্য। রুপালি কারুকাজের গয়নাগুলো যেন চাঁদের দেশ থেকে আনা হয়েছে মিনাকারী নকশা করিয়ে। এমন গয়না আমি পরি না; তবু দুর্গের সামনে পসরা বসিয়ে, গাল ফুলিয়ে আবদার করা নারীদের একটুও নিরাশ করতে ইচ্ছে করল না। পাঁচ জোড়া চওড়া নূপুর আর দুই জোড়া কোমরবন্ধ কেনার পর এই রঙিন প্রজাপতিদের খুশি আর ধরে না। এই খুশি তো চাঁদের দেশে গেলেও মেলা ভার! খুশিতে এদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী নারী এক হাত লাল ঘোমটা দিয়ে বিড়িতে দিলেন টান। এদের পাশেই রাভানহাট্টা বাজিয়ে গান গাইছেন এক বৃদ্ধ, ‘কে ঘর আজা পরদেশি, কে তেরে মেরে এক জিন্দরি…।’ পরদেশিকে ঘরে আসার কাতর অনুনয়; কারণ, তার আর গায়কের জীবন যে একই সুতোয় গাঁথা। এমন অনুরোধ শুনেও দূরে থাকা সম্ভব, এমন পাষাণ হৃদয়ের পরদেশি কে-বা আছে!
দুর্গের ভেতরে অলিগলি, তস্য গলি। সেখানে এককালে ছিল প্রজাদের ঘর। ঘরগুলো এখনো অটুট, সোনালি কারুকাজের রেখায়। এর মাঝে আরও সূক্ষ্ম কারুকাজে ঘেরা দুটি মন্দির। ভগবানের দরবারে কখনো কমতি পড়ে না ভক্তির। জনসাধারণ কিংবা ট্যুরিস্ট—সবাই মাথা ঠেকিয়ে যাচ্ছেন। দুর্গের ভেতরে এখন হোটেল বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ভ্রমণার্থীরা ইচ্ছে করলেই কয়েক রাত প্রাসাদে বসবাস করার সুখলাভ করতে পারেন।
রাজা-রানির মহলগুলো যেমন সোনারুপোর ঐশ্বর্যে ভরপুর, তেমনি প্রায় হাজার বছরের চিত্র বা খোদাই এখনো অটুট। মনে হয়, এই জনমেই আমি শিল্পীদের এই শিল্পকর্ম করতে দেখেছি! সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপার হলো, একদম ওপরের তলার বারান্দা দিয়ে পুরো জয়সালমের শহর দেখা যায়। যত দূর চোখ যায়, শুধু সোনালি প্রান্তর, স্বর্ণে মোড়ানো এক নগরী যেন তাকিয়ে আছে, সকালের আড়মোড়া ভাঙছে তার। ছিটকে ছিটকে পড়া এত আভা দেখে মনে হয়, দু হাত ভরে গায়ে মাখি, নৈবেদ্য দিই।
সোনার কেল্লায় যত ঘুরে বেড়াই, ততই মনে হতে থাকে কম দেখা হলো। একবার নিচ অবধি গিয়ে আবার সোনালি ভবনগুলোয় ঘুরে বেড়াবার জন্য ওপরে উঠে আসি। কী মিহি কারুকাজ আর ঝরোকা। ঝরোকার অপর পাশেও উত্তাল হাওয়া বয়ে যায় খোলা মনে। আমার কাছে ভারতীয় যেকোনো প্রাসাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হয় ঝরোকাকে। নানা নকশা কাটা, ছোট ছোট ফোকর দেওয়া দেয়াল; অথচ ফোকরে চোখ রাখলে বাইরের সবকিছু দেখা যায় অবিকল।
বেলা পড়ে আসছে। আমি এখান থেকে যাব বাড়া বাগ বা বড় বাগে। সোনার কেল্লা থেকে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে, রাজা-মহারাজাদের সমাধিসৌধ সেখানে। ট্যাক্সি করে যেতে হবে।
জয়সালমেরের যেকোনো প্রাসাদ, অবকাশকেন্দ্র কিংবা সমাধি—যা-ই হোক না কেন, এর বহিরঙ্গের আকার খোলা ছাতার মতো, তাই এই নকশাকে বলে ছাতরি। এসে দেখি, বাড়া বাগ বা বড় বাগানের সমাধিগুলোও বিশাল বিশাল ছাতার নিচে আশ্রয় নিয়েছে। একেক রাজা এবং তার তিন বা চারজন রানির সমাধি একেকটি ছাতার নিচে আরাম করছে! সমাধির মতো আলাদা আকারের কিছু নেই। একেকটি ছাতার নিচে বড় বড় লম্বা শ্বেতপাথরে খোদাই করা রাজার পা থেকে মাথা অবধি ছবি। পাশে সারি সারি তিন বা চার রানির ছবি। যত বেশি কারুকার্য খচিত ছাতা, তত বড় রাজার রাজকীয়তা। সোনালি মরুভূমির মাঝে সারি সারি সোনালি ছাতা। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটি বিস্তৃত সোনালি রাজপ্রাসাদ। দূর থেকে ডাকছে, হাতছানি দিচ্ছে কাছে গিয়ে তার কথা শোনার। কে-বা আসে এই বিরান মরুভূমিতে রাজা-রানিদের সমাধির পাশে বসে দুদণ্ড কথা বলতে। একেবারে জনমানবহীন এই প্রান্তরে কে-বা আসে রাজা-রানিদের স্মরণ করে। শুধু এক পশুপালক ভেড়ার দল নিয়ে এখানে এসেছেন মনের সুখে চরে বেড়াতে। এরাই এখন রাজা-রানিদের কাছের জন। জনসাধারণের রাজা মরণের পর জনসাধারণের মাঝেই ফিরে গিয়েছেন; পার্থক্য শুধু, নিজেদের শেষ আবাসস্থল তাদের ইহজগতের আবাসস্থলের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ করে রেখে গেছেন।
রাজার হৃদয়, রাজকীয় হৃদয়ে পরিপূর্ণ এক সমাধিস্থান বারবার মনে করিয়ে দেয়, সোনালি প্রান্তরে যা-ই দেখি না কেন, সবকিছুতেই মোহ জাগে। সবকিছুই মনে হয় স্বর্ণে তৈরি ইন্দ্রজাল। সেই ইন্দ্রজাল শুরু হয়েছে এই সোনালি রাজ্যের মানুষের আতিথেয়তার মধ্য দিয়ে; এর শেষ হওয়ার কোথাও কোনো নাম নেই!
ছবি: লেখক