টেকসহি I নারী রাইডারের রাস্তা
মে মাসের প্রথম শনিবার। ইন্টারন্যাশনাল ফিমেল রাইড ডে। মূলত মোটরসাইকেল চালানো এবং মোটরসাইকেল স্পোর্টসের প্রতি নারীদের উৎসাহিত করতেই এর সূচনা। তবে অন্তর্নিহিত বার্তা আরও সুদূরপ্রসারী
ফ্রান্সের এক মফস্বল। আদিগন্ত আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু পিচ ঢালা পথ। দুধারে পাহাড়ের উঁকিঝুঁকি, সারি সারি গাছ। তার ফাঁক গলে ক্ষণে ক্ষণে জ্বলজ্বলে সূর্যের আলো তো ক্ষণে ক্ষণে গাছের গাঢ় ছায়া। এই অবিরাম তীব্র আলো ও তীব্র ছায়া ছড়ানো রাস্তায় শাঁই-শাঁই করে বাইসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে এক যুবতী। পরনে শার্ট ও লং স্কার্ট। প্রকৃত রং জানা নেই আমাদের। কেননা, তাকে আমরা দেখছি সাদাকালো ফুটেজে। তাতে শার্টের রং সাদা আর স্কার্ট কালো হয়ে ধরা দিয়েছে। শার্ট সে গুটিয়ে বুকের নিচ বরাবর দিয়ে রেখেছে গিঁট। আর স্কার্ট পতপত করে উড়ছে হাওয়ায়। অল্প সময়ের মধ্যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে এই যুবতী একটা গাছের পাশে থামাল সাইকেল। তারপর সাইকেল রেখে নেমে গেল রাস্তার নিচে, জলাশয়ের পাশে থাকা ঝোপের আড়ালে।
একটু পর আবার উঠে এলো আড়াল থেকে। এই ক্ষণে তার শার্টের গিঁট খোলা। রোমালে ভেজা হাত মুছে নিতে নিতে, সাইকেলের কাছে উঠে আসতে আসতে আবারও গিঁট বেঁধে নিল শার্টে। তারপর আবার চড়ে বসল সাইকেলে। এ যেন সাইকেল নয়, রূপকথার পঙ্খিরাজ! ছোটাল বেদম। পেছন থেকে নেওয়া শটে আমরা আবারও দেখলাম, পতপত করে উড়ছে স্কার্ট। এই যে সাইকেল থামিয়ে একটু আড়াল নিয়েছিল সে, আমাদের অনুমান তা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে; আর সেই ক্ষণকালের ফাঁকে একদল উঠতি বয়সী বালক আড়াল থেকে ছুটে এসে স্পর্শ করেছিল গাছে হেলান দিয়ে থাকা সাইকেলটিকে। নিয়েছিল সাইকেলের ঘ্রাণ! আসলে নারীটির ঘ্রাণই নিয়েছিল ওরা, যে ঘটনাকে আপাতদৃষ্টে যুবতীটির প্রতি অনুরাগী হয়ে তাকে অবিরাম অনুসরণ করা এই কিশোরদের এক নির্দোষ অভিলাষ হিসেবে ভাবা গেলেও, প্রকৃতপক্ষে তা নয়। এর ভেতর রয়েছে জ্বালাতনের ইঙ্গিত। এই কিশোরেরা দৃশ্যতই আপদ। অন্যদিকে, সূর্যের তীব্র আলোয় গাছের যে গাঢ় ছায়া, তাকেও আমরা ভাষান্তর করতে পারি একজন নারী রাইডারের চলতি পথে সদা ঘাপটি মেরে থাকা বিপদের আভাস হিসেবে।
মনোমুগ্ধকর ট্রেকিং শটে সাজানো দুই মিনিটের এই দৃশ্য ফরাসি মাস্টার ফিল্মমেকার ফ্রাঁসোয়া ত্রুফোর ১৯৫৭ সালে নির্মিত ‘দ্য মিসচিফ মেকারস’ শর্ট ফিল্মের। এই দৃশ্য বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে আইকনিক হয়ে রয়েছে দুর্দান্ত প্রতাপে নারীর সাইকেল চালানোর মহিমা নিয়ে। এরপর পৃথিবীর নানা প্রান্তের নানা সিনেমায় এমন দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে হয়তো একঘেয়েমি চলে এসেছে অনেক দর্শকের মনে। প্রসঙ্গ সেটি নয়। আলোচ্য বিষয় হলো, ঘাপটি মেরে থাকা এত এত আপদ ও বিপদের ভেতর রাস্তা কতটা নিরাপদ নারী চালকদের জন্য?
আমরা খালি চোখে তাকালেই সেই চিত্রের দেখা পাব। দিনে দিনে বিশেষত শহরের রাস্তায় নারী চালকের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকার রাস্তায় কোনো নারীকে মোটরবাইক কিংবা গাড়ি চালাতে দেখলে এখন আর তেমন কেউ বোকা-বোকা মুখ করে তাকিয়ে থাকে না। গলিতে মেয়েদের বাইসাইকেল চালাতে দেখা যায় হরদম। অন্যদিকে, দিনাজপুরের চিরিরবন্দর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক ছাত্রী বিভিন্ন গ্রাম থেকে ১০-১২ কিলোমিটার পথ দল বেঁধে সাইকেল চালিয়ে ক্লাসে আসে—এ খবর বেশ পুরোনো ও প্রেরণাদায়ী। তবু সার্বিকভাবে, শুধু বাংলাদেশই নয়, সমগ্র পৃথিবীতে নারী চালক বা ফিমেল রাইডারদের নিরাপত্তা কতটা জোরালো, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এটা উপলব্ধি করার জন্য তথ্য-উপাত্ত ঘাঁটার প্রয়োজন নেই। খালি চোখেই দেখা মেলে। যতই বৈষম্যহীনতা ও সম-অধিকারের কথা বলি না কেন, রাস্তায় নারী চালকদের প্রতি পুরুষ চালকদের আক্রমণাত্মক মনোভাব, এমনকি পথচারীদের বিদ্রূপ ও জ্বালাতন হরদম ঘটে। শুধু নারী হওয়ার কারণেই কোনো কোনো চালককে নাজেহালের শিকার হওয়ার খবরও আমরা পাই। এমনকি তাদের সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ার পেছনে কখনো কখনো লৈঙ্গিক পরিচয়ই ভয়ানক নেতিবাচকভাবে কাজ করে। এমন উদাহরণ প্রচুর।
মাস কয়েক আগে রাজধানীতে স্কুটি চালিয়ে ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে কাভার্ড ভ্যান চাপায় নিহত হন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ছাত্রী মাইশা মমতাজ মিম। গা শিউরে ওঠার মতো সেই দুর্ঘটনার ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, পাশে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্ত্বেও অনেকটাই যেন ইচ্ছা করে মিমের স্কুটিকে চাপা দিয়েছিল কাভার্ড ভ্যান চালক। শুধু তা-ই নয়, দুর্ঘটনার পর গাড়ি কিছুক্ষণের জন্য থামালেও আহত পড়ে থাকা মিমকে উদ্ধারে কোনো উদ্যোগ না নিয়েই সটকে পড়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধার করা হলে হয়তো বাঁচানো যেত মিমকে।
স্মরণে আনা যেতে পারে পর্বতারোহী, সাইক্লিস্ট ও দৌড়বিদ রেশমা নাহার রত্নার কথাও। এভারেস্ট ছোঁয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সে পথে এগোচ্ছিলেনও। কিন্তু ৭ আগস্ট ২০২০ সকালে তার জীবনের ইতি টেনে দেয় এক মাইক্রোবাস চালক। রাজধানীর চন্দ্রিমা উদ্যানসংলগ্ন লেক রোডে তখন সাইকেল চালাচ্ছিলেন রত্না। মাইক্রোবাস চাপায় পিষ্ট হয়ে যায় পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠার প্রস্তুতি নিতে থাকা এই অভিযাত্রীর জীবন। সেই দুর্ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়, এটাও ছিল অনেকটাই ইচ্ছাকৃত। তাহলে কি ভিকটিম নারী হওয়ার কারণেই ঘটে থাকে এ ধরনের দুর্ঘটনা? বিশেষজ্ঞরা এমন অনুমানকে উড়িয়ে দেন না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় দীর্ঘকাল ধরে নারীদের হেয় করার, তাদের জন্য কিছু কাজ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার, বাকি কাজগুলোতে তাদের অংশগ্রহণকে মেনে না নেওয়ার যে চর্চা চলে আসছে, সেই নিরিখে এমনটা বলা যেতেই পারে।
আশার কথা, বিশ্বের যেকোনো সড়কে যেকোনো সময়ে নারী চালকদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিতের দাবি তোলার উপলক্ষ হয়ে এসেছে একটি বিশেষ দিন। মে মাসের প্রথম শনিবার বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিমেল রাইড ডে। ২০০৭ সালে দিবসটির প্রবর্তন করেন প্রখ্যাত কানাডিয়ান-ডাচ মোটরসাইকেল অ্যাডভোকেট এবং রোড অ্যান্ড রেস ইনস্ট্রাক্টর ভিকি গ্রে। মূলত মোটরবাইক চালনায় নারীদের উৎসাহিত করতে এবং মোটরবাইক স্পোর্টসে তাদের অংশগ্রহণ বাড়াতে এ দিবসের সূচনা। দিবসটি ঘিরে ১২০টির বেশি দেশের নারীরা এই স্পোর্টসে সেদিন অংশ নেন। তবে ফিমেল রাইড ডের মাহাত্ম্য শুধু এটুকুতে সীমাবদ্ধ নেই। এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আরও ব্যাপক পরিসরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।এই বিশেষ দিবস ঘিরে সকল নারী চালকের নিরাপত্তার বিষয়টি উঠে আসছে আলোচনায়। আশা করা হচ্ছে, দিন যত যাবে, আপামর মানুষ তত বেশি অভ্যস্ত ও সংবেদনশীল হয়ে উঠবে নারী চালকদের প্রতি। সড়কে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের প্রতি।
রুদ্র আরিফ
ছবি: ইন্টারনেট