এডিটর’স কলাম I সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও সহাবস্থান
ভিন্নতা আমাদের মাঝে যেন দেয়াল গড়ে না দেয়; বরং তা জীবনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও উদযাপনে এনে দেয় বিচিত্র সম্ভাবনা, তা নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার নিশ্চিত করা প্রয়োজন
২১ মে। ওয়ার্ল্ড ডে ফর কালচারাল ডাইভারসিটি ফর ডায়ালগ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। সহজ করে বললে, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা সুরক্ষার পক্ষে আওয়াজ তোলার দাবি নিয়ে বিশেষ দিবস। জাতিসংঘ অনুমোদিত এ দিবসের মাহাত্ম্য অনেক। আমরা জানি, প্রতিটি রাষ্ট্রে, প্রতিটি জনপদে বিভিন্ন ধরনের মানুষের বসবাস। তাদের প্রত্যেকের জীবনধারণ পদ্ধতি, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের জায়গা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় অভিন্ন হবে, এমন কোনো কথা নেই; বরং অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মানুষের সহাবস্থানে গড়ে ওঠে একেকটি সমাজ। সেই সব বৈচিত্র্যে অনেক সময় সংহতির অনিন্দ্য মাধুর্যের দেখা মিললেও, কখনো কখনো এমন কাণ্ড ঘটে, যাতে তুমুল বিশৃঙ্খলা হানা দেয়। সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে ক্লিষ্ট হয়ে সংখ্যালঘুদের সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে যেতে থাকে সমাজ থেকে, যা মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। তাই প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই নিজ নিজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যেন সমাজ তথা রাষ্ট্রে নিরাপদে টিকে থাকতে পারে, তারা যেন সেগুলো নির্ভয়ে উদযাপন করতে পারেন, সেই দাবি নিয়েই এই বিশেষ দিবসের আবির্ভাব।
দুই
জাতিসংঘ সূত্রে জানা যায়, শুধু বিশ্বের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের ঋদ্ধতাকে বড় করে তোলা নয়, বরং শান্তি সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নের প্রয়োজনে আন্তসাংস্কৃতিক সংলাপের ভূমিকাও অপরিহার্য। করোনা অতিমারি আমাদের আরও একবার জানান দিয়ে গেছে, সংকটের দিনগুলোতে সামাজিক সংহতি, শিক্ষাগত সম্পদ কিংবা ব্যক্তিগত কল্যাণ অর্জনে সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল মাধ্যমের রয়েছে স্বকীয় মূল্য। জাতিসংঘ আরও জানাচ্ছে, পৃথিবীর বড় বড় সংঘাতের তিন-চতুর্থাংশই ঘটে সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে। তাই শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে সেতু গড়ে তোলা জরুরি। শুধু অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার নিরিখেই নয়; বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগাত্মক, নৈতিক ও আত্মিক জীবনের আরও তাৎপর্যপূর্ণ অর্থময়তার জন্যও উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং টেকসই উন্নয়ন অর্জনে এটি একটি অপরিহার্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়। একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে গ্রহণ ও চিহ্নিত করার মধ্য দিয়ে মানবসভ্যতার বিকাশ সম্পর্কেও করা সম্ভব নিগূঢ় বোঝাপড়া। অন্যদিকে, ব্যক্তিগতভাবে নিজের ভেতর আয়ত্ত করা সম্ভব অপর বা ভিন্নতাকে গ্রহণের ইতিবাচক মানসিকতা।
তিন
বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কীভাবে একটি জনপদ বা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকে বিশ্বের দরবারে ইতিবাচকভাবে ফুটিয়ে তোলে, তার উদাহরণ অনেক। আর তা বেশ গুরুত্ববহও। প্রাচীন চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস বলে গেছেন, ‘একজন ভদ্রলোকের পক্ষে অন্যদের সঙ্গে দারুণভাবে মানিয়ে চলা সম্ভব; আর এতে যে সব বিষয়ে তাকে অন্যদের সঙ্গে একমত হতেই হবে, তা জরুরি নয়।’ এই কথার সূত্র ধরেই টের পাওয়া যায়, নানা বিষয়ে দ্বিমত কিংবা অমিল থাকা সত্ত্বেও সমাজে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ধরে রাখা ভদ্রতার লক্ষণ। সেই ভদ্রতাবোধ অর্জন করা প্রত্যেক মানুষের একান্ত দায়িত্ব।
চার
সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য মূলত বহু সংস্কৃতির সমার্থক। আমরা যে সংস্কৃতির অন্তর্গত, তার বাইরেও রয়েছে অনেক সংস্কৃতির উপস্থিতি—এই সত্য আমাদের মেনে নেওয়া চাই। সম্মান করা চাই অপরের সংস্কৃতিকে। তাদের উদযাপনে কোনো বাধা না দিয়ে বরং করা চাই উপভোগ। তাহলে মানুষ হিসেবে আমাদের ভেতর আরও বেশি মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীলতার মতো গুণাবলির বিকাশ ঘটবে। কেননা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারলে অপরের প্রতি হিংসা নয়, বরং প্রয়োজনে জেগে উঠবে সমবেদনা। তা ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও উদ্ভাবনী ভাবনা হাজির হবে মানসপটে, যা আমাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে বিকশিত করবে। খুলে দেবে ভাবনার নতুন দুয়ার। সেই সঙ্গে সম্ভাবনারও। কিন্তু কীভাবে তা অর্জন সম্ভব? বিশেষজ্ঞদের মতে, নিজ সংস্কৃতির বাইরের মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এ ক্ষেত্রে দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে। আপনি যদি মুক্তমনা হয়ে ওঠেন, অপরের কথা শোনেন এবং তা গুরুত্ব দেন, অন্য কাউকে সাংস্কৃতিকভাবে সংবেদনশীল দৃষ্টিতে দেখেন, পার্থক্যগুলো ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেন, বিরোধী মতের লোকদের ওপর নিজ বিশ্বাস চাপিয়ে না দেন, তাহলেই সম্ভব।
পাঁচ
‘বন্ধুত্বের জীবনীশক্তি স্রেফ অভিন্নতাকে উপভোগের ভেতর নয়, বরং ভিন্নতাকে সম্মান করার ভেতরও নিহিত থাকে,’ বলেছেন আমেরিকান সাহিত্যিক জিম ফ্রেডেরিক। ভিন্নতা আমাদের মাঝে যেন দেয়াল গড়ে না দেয়; বরং তা জীবনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ ও উদযাপনে এনে দেয় বিচিত্র সম্ভাবনা, তা নিজ নিজ জায়গা থেকে সবার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কেননা, ভিন্নতাকে সম্মান জানানো এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছাড়া কোনো মানবগোষ্ঠী, এমনকি কোনো ব্যক্তিমানুষও অগ্রগামী হতে পারে না।
টিকে থাক বিভিন্নতা। মর্যাদা পাক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। শান্তিপূর্ণ হোক সহাবস্থান।
জীবন সুন্দর হোক সবার।