স্বাদশেকড় I ফালুদা ফয়সালা
গরমে আরাম দেওয়ার মতো দারুণ সুস্বাদু ডেজার্ট। কালের বিবর্তনে বৈচিত্র্য এলেও মূল উপাদানের প্রতি এখনো শ্রদ্ধাশীল শেফ ও খাদ্যবিশারদেরা
ঈদসহ যেকোনো উৎসবে যে ডেজার্টগুলো না হলে আমাদের চলেই না, ফালুদা তার মধ্যে অন্যতম। এর স্বাদ যারা নিয়েছেন, তারা জেনে থাকবেন, গ্রীষ্মের তীব্র গরমে এটি কী দারুণ তৃপ্তি দেয়। ফালুদা এমন এক ডেজার্ট, যার সঙ্গে সবুজ, নীল কিংবা গোলাপি রঙের সিরাপ মেশানো হয়।
ফালুদার উৎস সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে বোঝা যায়, আজ আমরা যেভাবে এই ডেজার্ট খাচ্ছি, তার আদি রূপ এমন ছিল না। সুদূর অতীতে এতে মাত্র দুটি উপাদান মিশ্রণ করা হতো। এর ক্রমবিকাশ জানতে হলে ঘুরে আসতে হবে ফালুদার জন্মস্থান ইরানে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশে ফালুদেহ বা পালুদেহ নামে এটি পরিচিত। সেখানে এর প্রথম দেখা মেলে ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সেই সময়ে পারস্য বা ইরানি সাম্রাজ্যে শরবতের একটি প্রাচীন সংস্করণ পান করা হতো, যা তৈরি হতো সংগৃহীত বরফের সঙ্গে আঙুরের রস যোগে। খাবারটি এতই জনপ্রিয় হয়েছিল, গ্রীষ্মের পরেও এর লোভ সংবরণ করা কঠিন পড়ত। তাই ইরানিরা আরও স্থায়ী সমাধানের জন্য ইয়াখচাল তৈরি করেছিলেন। এই বিশাল গম্বুজযুক্ত বরফের ঘরগুলো মাটির দেয়াল দিয়ে বানানো হয়েছিল, যার মধ্যে ছিল ভূগর্ভস্থ স্টোরেজ এলাকা ও শঙ্কুযুক্ত ছাদ। নির্মাণটি তাপ-প্রতিরোধী হওয়ায় সারা বছর যথেষ্ট পরিমাণে বরফ সংরক্ষণে সক্ষম ছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইরানিরা যখন পাত্র ভরে এই শরবত উপভোগ শুরু করেন, এর স্বাদ কীভাবে বাড়ানো যায়, সেই ভাবনার বিস্তার ঘটান কেউ কেউ। প্রাথমিক পর্যায়ে মাড়ের সঙ্গে চিনির সিরাপ ও বরফ মেশানোর পর ফালুদেহ তার প্রকৃত রূপ ধারণ করে। স্থানীয় আইসক্রিম পার্লারগুলো এখনো এই ঐতিহ্যবাহী ডেজার্ট তৈরি করে চলেছে। শুধু ইরানেই নয়, আমাদের দেশসহ আরও অনেক দেশে গ্রীষ্মকালীন প্রিয় ডেজার্টে পরিণত হয়েছে এটি।
দুবাইয়ের র্যাডিসন ব্লু হোটেলের রেস্তোরাঁ শাবিস্তানের শেফ আবুল ফজল বলেন, ‘ফালুদেহ খেলে সাধারণত শরীর ঠান্ডা ও মন শিথিল হয়ে ওঠে। তাই প্রয়োজনের ওপর নির্ভর করে এতে বিভিন্ন সিরাপের সংমিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। সবকিছুর পরেও মূল স্বাদে আপস করা হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফালুদেহের মাড় শরীরকে দীর্ঘ সময় উপোস থাকতে সহায়তা করে, সেই সঙ্গে বাকি উপাদানগুলো শরীর ঠান্ডা রাখে বলে শুরুর দিকে রমজান মাসে ফালুদা খাওয়ার বিশেষ চল ছিল।’
ফালুদেহের একটি আধুনিক সংস্করণে মাড়ের বদলে নুডলস ব্যবহার শুরু হয়। একে আমরা আজ ভার্মিসেলি নামে চিনি। ভার্মিসেলি প্রথমে হাতের চাপের সাহায্যে তৈরি করা হতো, পরে অবশ্য চাপ দেওয়ার মেশিন আবিষ্কৃত হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় চাল কিংবা আলুর মাড় প্রথমে ঠান্ডা করে, তারপর মেশিনে চাপ দিয়ে শুকানোর পর নুডলস পাওয়া যায়।
গরমে প্রশান্তি এনে দিলেও শুরুর দিকে ফালুদেহের একটি ইউনিক স্বাদের অভাব ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের খাদ্য বিশেষজ্ঞ, লন্ডনভিত্তিক শেফ এবং কুকবুক রাইটার আনিসা হেলো বলেন, ‘আপনি কী যোগে পরিবেশন করবেন, তার ওপর নির্ভর করে ফালুদেহের স্বাদ। নুডলসের নিজস্ব স্বাদ নেই। তবে জাফরান আইসক্রিমের মতো আইসক্রিম যোগে পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গেই নুডলসে একটি অসাধারণ স্বাদ পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে আপনি পছন্দের ফলের সিরাপ দিয়ে তৈরি ফালুদেহ পরিবেশন করতে পারেন ডালিম সহযোগে। ডালিম, মালবেরি কিংবা গোলাপের ফ্লেভার এ ক্ষেত্রে এই ডেজার্টের সবচেয়ে উপযুক্ত ইরানি স্বাদ।’
হেলোর কথা থেকে বোঝা যায়, ঐতিহ্যবাহী ফালুদা খাওয়ার সময় স্বাদবর্ধক ফ্লেভার দরকার। এ কারণে বেশ কিছু ইরানি দোকানি একটি বড় গ্লাসে সুগন্ধযুক্ত নির্যাস এবং স্বাদযুক্ত সিরাপ যোগ করে এটিকে ডেজার্ট ডিশ হিসেবে পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেন। ‘বাস্তানি নামে একধরনের ঠান্ডা ডেজার্ট অতীতে পাওয়া যেত, যা রাইস নুডলস, গোলাপজল, চিনির শরবত, জাফরানের নির্যাস ও লেবুর রস দিয়ে তৈরি করা হতো এবং সবার ওপরে থাকত আইসক্রিম। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে কয়েকভাবে এটি বিবর্তিত হয়েছিল, যার মাঝে উল্লেখযোগ্য জাফরান ও লেবুর রসের মতো ড্রেসিং সহযোগে পরিবেশন করা,’ বলেছেন ইরানি ডেজার্ট এক্সপার্ট শেফ আবুল ফজল।
সেই সময়ে ইরানে আইসক্রিমও তৈরি হতো ম্যানুয়ালি। মেশিন আবিষ্কারের আগে, দুটি বড় পাত্র দুধ ও বরফ দিয়ে ভরা হতো। দুধের পাত্রটি বরফের পাত্রের তুলনায় আকারে ছোট ছিল; কেননা, দুধ পরবর্তীকালে বরফের পাত্রে রাখা হতো। বারবার হাত দিয়ে পাত্র ঘোরানোর মাধ্যমে বরফ থেকে পাওয়া শীতলতা স্থানান্তরিত হতো দুধের পাত্রে। এই প্রক্রিয়া দুধকে ছানা বাঁধতে সাহায্য করত এবং ধীরে ধীরে তা আইসক্রিমে পরিণত হতো। প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ছিল বলে অনেক ইরানিই একে গ্রহণ করেননি; আর এটি ধীরে ধীরে ইরান থেকে অনেকটাই হারিয়ে যেতে থাকে। অবশ্য সপ্তদশ শতাব্দীতে ইতালীয়রা নিজ দেশকে আধুনিক আইসক্রিমের জন্মস্থান হিসেবে দাবি তুললে ইরানের সেই আইসক্রিম বানানোর প্রক্রিয়া আবারও আলোচনায় আসে। ইরানিরা তাদের ঐতিহ্যবাহী রেসিপিতে আটকে থাকলেও ধীরে ধীরে ফালুদার মূল খাদ্য উপাদানে বিভিন্ন রং যোগ করতে শুরু করে। যেমন গোলাপের জন্য গোলাপি, টকের জন্য সবুজ, আমের স্বাদের জন্য হলুদ প্রভৃতি রং ও স্বাদে বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ফালুদা।
ভ্রমণকারীদের হাত ধরে এই ডেজার্ট ভারতে পৌঁছেছিল বলে অভিমত খাদ্য ইতিহাসবিদদের। ফালুদেহ যখন মোগল আমলে ভারতে আসে, এর নাম খানিকটা পাল্টে যায় এবং খাবারে কিছুটা ফিউশন করা হয়। তখন থেকেই ফালুদা ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ডেজার্টগুলোর অন্যতম। ‘ফালুদা মধ্যযুগে ভারতে এসেছিল মধ্য এশীয় রাজবংশের মাধ্যমে, যারা ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে আক্রমণ ও বসতি স্থাপন করেছিল,’ বলেছেন দুবাইয়ের ইন্ডিয়া বিস্ট্রোর ইরানি-ভারতীয় শেফ মোহাম্মদ আলী। প্রধানত দুধ দিয়ে তৈরি ভারতীয় ফালুদায় আইসক্রিম, তুলসী, জেলি, গোলাপের সিরাপ ও ভার্মিসেলি ব্যবহার করা হতো। শেফ মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ‘ফালুদা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। উপাদানগুলো সহজলভ্য হওয়ায় এটি তৈরি করা কঠিন নয়। অনেক শাসনব্যবস্থা এসেছে এবং চলে গেছে, রাজদরবারের মানুষদের খাওয়া এই ফালুদা আজও সবার হৃদয় তৃপ্ত করে চলেছে।’
ভারতীয় বিখ্যাত খাদ্য ইতিহাসবিদ কে টি আচায়ার মতে, এই উপমহাদেশে প্রথম ফালুদা উপভোগ করা হয়েছিল মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের [১৫৬৯-১৬২৭] রাজদরবারে। ‘অভিনব যেকোনো কিছুর প্রতি প্রবল কৌতূহল ছিল সম্রাট আকবরের ছেলে সম্রাট জাহাঙ্গীরের,’ বলেছেন আচায়া। খাবারের ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ওই সম্রাটের অসম্ভব পছন্দের খাবার ছিল ফালুদা। সমৃদ্ধ জেলির মতো এই পানীয় সেদ্ধ গম ছেঁকে এবং ফলের রস ও ক্রিম মিশিয়ে তৈরি করা হতো।
কেউ কেউ অবশ্য বলেন, ইরানি বাদশাহ নাদের শাহ [১৬৮৮-১৭৪৭] ভারতে আসার সময় এই ডেজার্ট সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। তবে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক, এটি যে রাজকীয় খাবার ছিল, তাতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। অবশ্য দ্রুতই ডেজার্টটি রাজদরবারের সীমানা থেকে ছড়িয়ে পড়ে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট