কভারস্টোরি I ট্রেইলব্লেজার
ফ্যাশনে নতুন ধারার প্রবর্তকদের দেখা গেছে নিজের স্টাইলে সবার সামনে হাজির হতে এবং মন জয় করে নিতে। যুগে যুগে সেই নতুনত্ব মুগ্ধ করেছে ফ্যাশনপ্রেমীদের। বলা হয়ে থাকে, ব্যক্তির স্টাইল থেকেই তৈরি হয় ফ্যাশন। বিস্তারিত সারাহ্ দীনার লেখায়
ফ্যাশন। এই একটি শব্দে চোখের সামনে অনেক রকম ট্রেন্ডের ট্রেলার চলে আসে, তাই না? প্রতিটি ট্রেন্ড আসে কোনো এক ব্যক্তির হাত ধরে। স্বতন্ত্র ফ্যাশনসচেতন ব্যক্তি নিজেকে নিজের মতো তৈরি করলে প্রকাশিত হয় তার চিন্তা, মতবাদ, ভাবনা, বিশ্বাস। সব মিলিয়ে একজন ব্যক্তি নিজের আলোয় আলোকিত হন। সেখানে পোশাক, অনুষঙ্গ, মেকআপ, হেয়ারস্টাইল প্রভৃতি কাজ করে নিয়ামক হিসেবে। আনকোরা এই সৌন্দর্য দেখে নিজেকে সেভাবে তৈরির আগ্রহ দেখা যায় কারও কারও মাঝে। এই ট্রেন্ড অনুসারীদের সংখ্যা কখনো কখনো পৌঁছে যায় বড় অঙ্কে। ঠিক তখনই ফ্যাশন পরিণত হয় একটি স্টাইলে। যিনি নতুনকে আপন করে প্রথমবারের মতো সবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন, ফ্যাশন প্রবর্তক হিসেবে তিনি জায়গা করে নেন ইতিহাসে। সেই মানুষটিই ট্রেইলব্লেজার। আজ গল্প দেশের ট্রেন্ড সেটারদের নিয়ে।
আমাদের দেশে মূলত চলচ্চিত্র তারকাদের কাছ থেকেই ফ্যাশনের নতুন ধারায় আগ্রহী হতে দেখা গেছে সাধারণ নাগরিকদের। সত্তরের দশক থেকে দেশের তারকাদের নিয়মিত দেখা শুরু করেন বাংলাদেশের মানুষ। তাই এ দেশের ফ্যাশনে তখন ঢাকাই চলচ্চিত্রের শক্তিশালী প্রভাব পড়ে। বাইরের দেশের সঙ্গে সে সময়ে বিনোদন বিনিময় এতটা সহজ ছিল না। বিশ্ব ফ্যাশনের নির্যাস সে সময়ে খানিকটা অধরা ছিল। আনন্দ আয়োজনের ভরসা তখন মূলত সিলভার স্ক্রিন। তা-ও চাইলেই সিনেমা হলের পর্দায় চোখ রাখা যায়, বিষয়টি এমনও ছিল না। আর টেলিভিশন? সে সময়ে বোকা বাক্স ছিল খুব কম মানুষের বসার ঘরে। তাই ছোট কিংবা বড় পর্দা—এর কোনোটার বিনোদনই নিয়মিত আস্বাদনের সুযোগ তেমন হতো না। যেদিনই মানুষ রং দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ পেতেন, সেদিনকে বিশেষভাবে মনে রাখতেন। পর্দায় দেখতেন যাদের, তাদের কথা মনে গেঁথে যেত। প্রিয় হয়ে উঠতেন সেই অভিনেতা-অভিনেত্রী। জীবনঘনিষ্ঠ কনটেন্ট নির্মাণে মনোযোগী ছিলেন তখনকার পরিচালকেরা। দর্শক তাই নায়ক-নায়িকার সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পেয়ে আহ্লাদিত হতেন। জীবনযাত্রাও প্রভাবিত হতো স্ক্রিনের মানুষগুলোর প্রতি অনুরাগে।
অভিনেতাদের প্রতিভার পাশাপাশি পোশাক আর সাজসজ্জার দিকেও মনোযোগ থাকত দর্শকদের। তাই তো গানের সঙ্গে যখন নায়করাজ রাজ্জাককে বড় পর্দার দেখা যায়, তখন মনে পড়ে যায়, এ দেশের তরুণেরা সুরে সুরে তাকে নাচতে দেখে তার বেল-বটমের নকশার প্রতি আগ্রহী হয়েছিলেন। নিজের জন্য এমনই একটি বানিয়ে নিতে ছুটেছিলেন দরজির কাছে। আবার এই রাজ্জাকের পরনে দেখা মেলা নকশা করা সোয়েটারের চাহিদা ছিল যুগ যুগ ধরে। উল-কাঁটাতে পটু অনেক মেয়ে সে সময় প্রিয়জনের জন্য সোয়েটারের বুকজুড়ে নকশা তুলেছেন। রাজ্জাকের স্টাইল ছড়িয়ে পড়েছে দর্শকদের মাঝে। পরিণত হয়েছে ফ্যাশনে। বর্তমান সময়ের পরিচিত ক্লদিং আইটেম ‘ফরমাল শার্ট’। এ পোশাকে দর্শকদের সামনে রাজ্জাক হাজির হয়েছেন বহুবার। সে সময়ের দর্শকেরা রাজ্জাকের এই স্টাইলকে বেশ আগ্রহ নিয়ে গ্রহণ করেছিলেন। তা-ই পরিণত হয়েছিল ফ্যাশনে।
চিত্রনায়িকা ববিতার স্টাইলে মাধুর্য মিশে ছিল। দেশি ও পাশ্চাত্য—দুই রকমের পোশাকেই তিনি ছিলেন পরিশীলিত। তার এক রং জর্জেট ও কাতান ব্লাউজের সন্ধি আজও ট্রেন্ডি। বলা যেতে পারে ফরেভার ফ্যাশনেবল। একটি হালকা সবুজ জর্জেট শাড়ি এবং সঙ্গে জরি সুতার নকশার ব্লাউজে নেচেছিলেন তিনি সৈকতজুড়ে। সেই গানের সুর আজও গুনগুন করেন ববিতায় মুগ্ধ দর্শকেরা। তখনকার ফ্যাশনেবল অনেকে বেছে নিয়েছিলেন এমন শাড়ি-ব্লাউজ। এই যুগেও এমন কম্বিনেশন আমাদের চোখে পড়ে। তরুণ তুর্কিরা এই ধারার শিকড়ের খোঁজ সম্পর্কে অবহিত কি না, জানি না। তবে জানি, এখনো এই ওয়ান কালারের শাড়ির আবেদন আছে। ববিতা চুলের সাজে ফুল ব্যবহার করতেন। খোঁপার এক পাশে গুঁজে নিতেন একটি কিংবা তিনটি ফুল। এই সিম্পল হেয়ার ডুতে তখনো আগ্রহ ছিল, এখনো অনেকে ফুল পরে নেন ববিতার মতো করে।
ববিতার সঙ্গে জুটি বেঁধে কাজ করতেন জাফর ইকবাল। তিনি সেই সময়ের স্টাইলিশ নায়ক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ম্যাগি হাতার রাউন্ড নেক লাইনের টি-শার্ট পরে হাজির হয়ে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। এই সাদাতে তিনি মন হারিয়েছিলেন, তাকে দেখে দর্শকেরা নিজেদের হারিয়েছিলেন সাদার ফ্যাশনে! সাদা রং টপ-বটম; সঙ্গে সাদা জুতায় দারুণ স্টাইলিশ জাফর ইকবালকে ফলো করতেন তখনকার আধুনিকেরা। ববিতা ও জাফর ইকবাল জুটি আধুনিক পোশাককে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রপ্রেমীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে বেশ ভূমিকা রেখেছে। তাদের ‘অবুঝ হৃদয়’ চলচ্চিত্রের ‘তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন’ গানে সাদা লং ফ্রকে দেখা দিয়েছিলেন ববিতা। সঙ্গে ছিল কালো কটির লেয়ারিং। এই সাদা-কালোর মিশেলের সঙ্গে রং মিলিয়ে পোশাক পরেছিলেন নায়ক জাফর।
কবরীর উঁচু খোঁপা সে সময়ে হেয়ার ডু হিসেবে দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। দীঘল ঘন চুলকে কবরী গুছিয়েছিলেন ভারী খোঁপায়। আমাদের দেশের মেয়েরা সেই খোঁপায় মন হারিয়েছিলেন। তাই এভাবে চুল বেঁধে নিতেন মিষ্টি মেয়ের মতো করে। তখনকার সময়ের বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দা, দাওয়াতে এমন খোঁপাতেই নজর আটকে যেত। বিয়ের কনের লাল-সোনালি ওড়নার ফাঁকেও উঁকি দিত খোঁপা। অ্যালবাম ঘাঁটলে হয়তো আপনার মা-খালাদের হেয়ার ডুতেও খুঁজে পাবেন কবরীকে। কবরীর ব্লাউজের নেকলাইনে দেখা গিয়েছিল বোট নেক। সে সময়ে এমন নকশায় নতুনত্ব ছিল। আধুনিকারা দরজির শরণাপন্ন হতেন এমন গলার ব্লাউজের ফরমাশ নিয়ে।
মিনিমালিজমকে ট্রেন্ডি করে তুলেছিলেন শাবানা। তখন থেকে এখনো শাবানার সেই লুক ট্রেন্ডি। একই রং, শাড়ি-ব্লাউজে তিনি নান্দনিক হয়ে উঠেছিলেন। রঙের নানান খেলা দেখা গেছে তার শাড়িজুড়ে। লাইট থেকে ডার্ক শেডে দর্শকদের কালার প্যালেটের দারুণ সব শেডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সাজে স্নিগ্ধতা ধরে রেখেছিলেন নিজের রূপসজ্জায়। সেই আনকোরা সাজ এ দেশের মায়েদের কাছে হয়ে উঠেছিল নিত্যদিনের অনুষঙ্গ। জর্জেট, সিল্ক—দুই ধরনের ফ্যাব্রিকেই সলিড কালারের শাড়ি আলোচনায় ছিল তখন। এখনো এ ধরনের লুকে দেখা যায় অনেককে। এমনকি শাবানার মতো করে গয়নাও পরতেন তখনকার ফ্যাশনিস্তারা। গলায় একটি চেইন, সঙ্গে মাঝারি আকৃতির লকেট। আর নকশা মিলিয়ে কানে ছোট দুল। যাকে টপ বলে ডাকা হয়।
মৌসুমী এসেছিলেন বসন্ত বাতাসের মতো। তাকে ঘিরে যেন ফুলের সুবাস। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর দুরন্ত সেই কিশোরী হয়ে উঠেছিলেন তরুণীদের ফ্যাশন আইকন। তার চুলের কাট তখন ইয়াং গার্লদের ফেভারিট। ব্যাংগস কোরা চুল কপালের এক পাশ ঢেকে রাখত, বাতাসে সরে যেত আলতো করে। এই হেয়ার কাট পরিচিতি পায় মৌসুমী কাট নামে। মৌসুমী শাড়ি পরেছিলেন সামনে আঁচল নিয়ে এসে। সেই শাড়ি পরার ধরনে মন হারিয়েছিলেন কতজন! বিয়েবাড়িতে তখন এই মৌসুমী স্টাইলের শাড়ি পরা বউ দেখা যেত। ট্রেন্ডি বউ মানেই আঁচল সামনে এনে শাড়ি। এর সঙ্গে সঙ্গে ‘অন্তরে অন্তরে’ চলচ্চিত্র থেকে কোমরের বিছা আসে নতুন করে আলোচনায়। এই গয়না পুরোনো দিনের, কিন্তু মৌসুমীর কোমর জড়ানো অলংকারে চোখ আটকে গিয়েছিল অনেকের। তাই তখনকার জনপ্রিয় এই নায়িকার স্টাইলের শাড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় বিছা। নানান রকম কারুকাজের বিছা তখন আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। এখানেই শেষ নয়; মৌসুমীর ড্রেসের হাতার নকশাও ফ্যাশন হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, হচ্ছে। এখনো ফরমায়েশি কামিজ বানাতে গেলে দরজি অনেক সময়ে জানতে চান, মৌসুমী হাতার নকশা চাই কি না।
মৌসুমীর নামের সঙ্গে এসে যায় সালমান শাহর কথা। এই নায়ক এসেছিলেন চলচ্চিত্রের অঙ্গনে হাজার আলো জ্বালিয়ে। দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন দ্রুততম সময়ে। তরুণ এই তুর্কি মাথায় ব্যান্ডানা বাঁধতেন। রঙিন স্কার্ফ নানান কায়দা করে জড়িয়ে নিতেন মাথায়। তাকে দেখে তরুণদের মনে তখন ঝড়। নিজেকে প্রিয় নায়কের মতো করে উপস্থাপনের তাগিদে স্কার্ফ মাথায় বাঁধতে শুরু করে নব্বইয়ের দশকের দুরন্ত প্রাণেরা। ক্যাপেও মাথা ঢেকেছেন এই নায়ক। তাকে দেখাদেখি সেদিকেও চোখ যায় ইয়াং জেনারেশনের। নব্বইয়ের দশকে রকমারি ক্যাপের ব্যবসা জাঁকিয়ে বসেছিল আমাদের দেশে। ছেলেদের পোশাকের দোকানের আশপাশে, কলেজের কাছাকাছি তখন ক্যাপ বিক্রির জন্য হকারের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। সালমান তার ভক্তদের জন্য নিয়ে এসেছিলেন আরও অনেক কিছু। হাই নেক ইনার জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে অবদান ছিল তার। সোয়েটার কোমরে, গলায় বেঁধে নেওয়ার যুগও এনেছিলেন তিনি। লেয়ারিংয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন সালমান। কখনো ব্লেজার, কখনো শার্ট, কখনো জ্যাকেটে লেয়ারিং করতেন। সালমান শাহকে অনুসরণে আমাদের দেশের তরুণসমাজের আগ্রহ ছিল আকাশছোঁয়া। এই নায়কের ছবি মানেই ছিল নতুন কোনো স্টাইলের ফ্যাশনে পরিণত হওয়া। দর্শকদের সঙ্গে সঙ্গে পোশাক ও অনুষঙ্গ ব্যবসায়ীরাও তাই অপেক্ষায় থাকতেন নতুন সিনেমার জন্য। সালমান শাহ অকালপ্রয়াত। তবু এই ট্রেন্ড সেটার হিরোর ড্রেস সেন্স আজও আলোচনার বিষয়।
বিনোদন জগতের চলচ্চিত্র ছাড়াও গানের মানুষেরা আমাদের দেশের ফ্যাশনকে নানান সময়ে প্রভাবিত করেছেন। বাংলা গানের কিংবদন্তি শিল্পী রুনা লায়লা এ দেশের মানুষকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়েছিলেন আংটির সঙ্গে। হাতের আঙুলজুড়ে মাঝারি থেকে বড় সাইজের ফিঙ্গার রিং তার হাতের আঙুলে জ্বলজ্বল করে স্টেজ পারফরম্যান্সের সময়ে। তার গানের সঙ্গে সঙ্গে হাত ও আঙুলের সৃষ্টিশীল মুদ্রা মনোগ্রাহী।
এর মধ্যে ব্যান্ড সংগীত এ দেশে আসে। তখনকার সময়কালের কথা বিশেষভাবে বলতে হয়। আমাদের দেশের ব্যান্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষগুলো শুধু সুর ও সংগীত নিয়ে নিরীক্ষা করেছেন তা নয়, ফ্যাশনেও দিয়েছেন মনোযোগ। ‘মাইলস’ ব্যান্ড নিয়ে হাজির হয়েছিলেন দুই ভাই—শাফিন আহমেদ ও হামিন আহমেদ। কাউবয় ফ্যাশনের সফট ভার্সন হিসেবে শাফিন আহমেদের উদাহরণ টানা যেতে পারে। গ্লসি শার্ট, ডেনিম, হ্যাট, বুটে তিনি পাশ্চাত্য ফ্যাশন ধারা নিয়ে এসেছিলেন। নিজের স্টাইলের পাশাপাশি তার গিটারকেও সাজিয়ে তুলতেন তিনি। সেখানেও ছিল নিজের সিগনেচার। গিটারে আটকে নিতেন একটি রুমাল। রঙিন এই রুমাল আলাদা করে তুলেছিল এই সংগীতশিল্পীর প্রিয় মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টকে। এখনো করে।
বাংলা ব্যান্ডের ভোকালদের স্টাইল ইনস্পিরেশন হিসেবে দেখা শুরু হয় আশি ও নব্বইয়ের দশকে। সে সময়ে ব্যান্ড সংগীতের উত্থান এমন উচ্চতায় ছিল, যেখানে একেকটি ব্যান্ড ঘিরে ছিল উন্মাদনা। প্রিয় গায়কের মতো সেজে উঠতে চেষ্টা ছিল টিনএজ থেকে যুবক অবধি। ‘এলআরবি’ নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু যখন নতুন করে দৃশ্যপটে হাজির হন, তখন তিনি কালোর উন্মাদনায় ভাসিয়েছেন এ দেশের কিশোর-যুবাদের। ব্ল্যাক সানগ্লাসে চোখ ঢেকে চলার দিনের শুরু এই জনপদে তখনকার সময়ে উন্মাদনায় পরিণত হয়েছিল। ব্যান্ড সংগীতের সোনালি সময়ে আমরা দেখেছি প্রিয় গায়ককে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে সেভাবে নিজেকে সাজাতে। জেমস তখন ‘ফিলিংস’ নিয়ে ব্যস্ত। জিনস প্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি প্রিয় গায়কের পরনে দেখে ইয়াং স্টাররা তখন এদিকেই ঝুঁকেছিলেন। অনেককে জেমসের মতো করে স্কার্ফ নিয়ে নানা কারসাজি করতেও দেখা যেত। তার পিয়ারসিং দাগ কেটেছিল ফ্যানদের মনে। আইব্রাও আর থুতনিতে অলংকার পরতে শুরু করেছিলেন তিনি। পিয়ারসিংয়ের প্রেমে পড়ে যায় তরুণ দল। চোখের ওপরে আইব্রাওতে ছোট গয়না পরে নিতে দেখা যায় অনেককে। ‘আর্ক’ ব্যান্ডের হাসানও ছিলেন একজন ফ্যাশন প্রবর্তক। তার টি-শার্টের ওপরে শার্টের লেয়ার জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
ফ্যাশন মূলত তৈরি হয় একটি স্টাইলের জনপ্রিয়তাকে কেন্দ্র করে। কোনো মানুষ যখন তার নিজস্ব চিন্তাধারার মাধ্যমে নিজেকে সাজিয়ে তোলেন, তখন সেটি তার স্টাইল। ব্যক্তির ব্যক্তিগত রুচির বহিঃপ্রকাশ। সেই স্টাইল যখন একজনের কাছ থেকে অন্যজন, এভাবে অনেকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে, তখন তা ফ্যাশনে পরিণত হয়। আমাদের বিনোদন দুনিয়ার বিভিন্ন ব্যক্তি নিজেদের স্টাইলে দর্শকদের মুগ্ধ করেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাদের স্টাইল ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। তারকাদের মাধ্যমে ট্রেন্ড স্থাপিত হওয়ার কারণ হিসেবে সরাসরি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। একটি চলচ্চিত্র দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, লাখ লাখ দর্শকের সামনে প্রদর্শিত হয়। তাতে যে অভিনয়শিল্পীরা কাজ করেন, তাদের দিকে অখণ্ড মনোযোগ থাকে দর্শকের। নায়ক-নায়িকাদের যে ব্যক্তিত্ব সেখানে প্রদর্শিত হয়, সেটিও প্রভাব রাখে। ইতিবাচক ব্যক্তিত্বের সাহসী নায়কের মতো জনপ্রিয়তার আগ্রহে যুবকেরা নিজেদের সেভাবে সাজিয়ে তুলতে আগ্রহী হন। আবার নায়িকাদের ক্ষেত্রেও ইমেজ রাখে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। নারী দর্শকেরা নিজেদের অবস্থান ও স্বপ্নের সঙ্গে মিল পেলে রুপালি পর্দার সেই চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন। নিজেকে সাজিয়ে তুলতে চান প্রিয় অভিনেত্রীর মতো করে।
বহুদিন গেছে, এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের মুগ্ধ দর্শকেরা তাদের জীবনের সঙ্গে নায়ক-নায়িকাদের সাধারণ জীবনযাপনের মিল খুঁজে পেতেন। সেখান থেকে তাদের কাছের মানুষ মনে করা শুরু করেন। এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন ঢালিউডের পরিচালকেরা। অনেক সময় জীবনঘনিষ্ঠ চলচ্চিত্র তৈরি করতেন তারা। সেখানে চরিত্রাভিনেতাদের সাজিয়ে তুলতেন এই দেশের মানুষের মতো করেই। তারা বেশ ভালো বুঝতেন দর্শকের চাহিদা। অর্থাৎ দর্শক কী দেখতে চান। চলচ্চিত্রের মিষ্টি মেয়ে কবরীর মতো করে চুল বাঁধার আগ্রহে সে সময়ের মেয়েরা হেয়ার কেয়ারে আগ্রহ বাড়িয়েছিলেন। দীঘল কালো চুলে ফ্যাশন খুঁজে পাওয়ার সময় ছিল সেটি।
এ ছাড়া নায়িকা শাবানাকে ধারণ করতে দেখা গেছে অনেকের মাঝে। শাবানা তার সোনালি ক্যারিয়ারে যেসব চলচ্চিত্র বেছে নিয়েছিলেন, সেগুলোতে দর্শক খুঁজে পেয়েছিলেন তাদের পরিচিত একজন নারীকে। চরিত্রের প্রয়োজনে সহজ-সরল বাঙালি নারীর অভিনয়ে দর্শককে আবেশিত করে রাখতেন শাবানা। তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনের খবরে উচ্ছ্বসিত হতেন শহর-মফস্বলের নারীরা। ঘরবাড়ি সামলে পৌঁছে যেতেন প্রিয় নায়িকার সিনেমা দেখতে। সারা দিনের কাজ সামলে দেখা পেতেন কাঙ্ক্ষিত নায়িকার গল্প দেখার। সেখানে তাকে যেসব ক্যারেক্টার প্লে করতে দেখা যেত, সেগুলো তখনকার নারীদের যাপিত জীবনেরই অংশ। তাই নায়িকা শাবানাকে কাছের মানুষ ভেবে নেওয়া যেত সহজে। পোশাক, সাজসজ্জাতেও সেই প্রভাবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত। অনেকে বেছে নিতেন শাবানার মতো শাড়ি। শাবানার ব্লাউজের হাতা তো আজও অম্লান। কনুই ছুঁই ছুঁই সরল নকশার ব্লাউজ এখনো টিকে আছে। সমকালীন দেশি চলচ্চিত্রের প্রভাব বিস্তারের সেই দিন হয়তো দূর অতীত! তবু রয়ে গেছে রেশ।
অন্যদিকে, ফ্যাশন এখন বৈশ্বিক। অন্তর্জালের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন-দুনিয়ার তথ্য জেনে নেওয়া যায় সহজে। তার মধ্যেও নিজস্ব স্টাইলে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন কয়েকজন। কারও কারও স্টাইলের ইউনিকনেস তরুণদের আকৃষ্ট করেছে। এ তালিকায় বলা যেতে পারে ব্যান্ড তারকা জন কবিরের কথা। জন তার পুরো চুল ফেলে দিয়েছেন। শেভড হেড। সঙ্গে রেখেছেন দাড়ি। দৈর্ঘ্য কম নয় একেবারে। জনের এই নিজস্বতা কিছু মানুষের ভালো লেগেছে। যদিও সবাই মেতেছেন এই ট্রেন্ডে এমন বলা যাবে না। প্লাস সাইজ ফ্যাশনকে জনপ্রিয় করার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন মডেল সোবিয়া আমিন। একসময় আমাদের দেশের রেডিমেড জামার ক্ষেত্রে ৪০-৪২ ইঞ্চির চেস্ট সাইজের বেশি পাওয়া দুষ্কর ছিল, সেখানে বর্তমান চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। প্লাস সাইজ পোশাকের ডেডিকেটেড ব্র্যান্ড তৈরি হয়েছে এ দেশে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস প্লাস বাংলাদেশ নামের রিয়েলিটি শোও আয়োজিত হয়েছে। বর্তমানের উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে এই ফ্যাশন ধারার কথা।
করপোরেট দুনিয়ায় চোখ রাখলে আমরা দেখতে পাব, নারী কর্মীর সংখ্যা বেড়েছে। একই সঙ্গে পারিপাট্যে বেড়েছে মনোযোগ। করপোরেট লেডিদের মাঝে রুবাবা দৌলা বিশেষভাবে আলোচ্য। তিনি শাড়িকে প্রফেশনাল ওয়্যারের তালিকায় নিয়ে আসতে ভূমিকা রেখেছেন। টেলিকম কোম্পানিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অফিস সামলেছেন বাংলাদেশের নারীদের চিরায়ত পোশাক—শাড়ি পরে। সেখান থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন তরুণীরা। স্টাইলিশ এই নারী সহজ সাজের সঙ্গে শাড়ির যুগলবন্দীতে প্রমাণ করেছেন, শাড়ি পরেও নারী কাজ করতে পারে সমানভাবে।
ট্র্রেইলব্লেজাররা সোসাইটিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আদর্শ ও কর্মজীবন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ইতিবাচক তারকাদের প্রতি আকর্ষণবোধের কারণে নিজেকে পরিশীলিত সাজে সাজিয়ে তুলতে আগ্রহী হন ফ্যাশন-সচেতনেরা।
নজর নতুনত্বে
নুসরাত ফারিয়া
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি আমার জন্ম। বুঝতে বুঝতে চলে আসে ২০০০ সাল। দেশের বিনোদন ব্যবস্থা তখন বেশ উন্নত। স্যাটেলাইটে বিশ্ব ফ্যাশনের খবরাখবর পাওয়া যায়। আমিও ধীরে ধীরে ফ্যাশন-বিউটি বুঝতে শিখছি। আগ্রহ বাড়ছে রঙিন পর্দার মানুষদের প্রতি। কেমন পোশাক, কেমন সাজ; তা মনোযোগ দিয়ে দেখি। চিত্রনায়িকা শাবনূরের সাজে চোখ আটকে যায়। নিয়মিত তার অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি কীভাবে সাজছেন, সেদিকে আগ্রহ বাড়ে। অবাক বিস্ময়ে দেখি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ তারকা মৌসুমীকে। তার সে সময়ের চুল ২০০০ সালের পরেও ইন ট্রেন্ড মনে হয়েছে। কপালের ওপরে চুলের ছন্দ মুগ্ধ করেছিল। এরপরে যখন নিজেই হয়ে উঠি বিনোদন জগতের মানুষ, তখন পরিচয় ঘটে নতুন একটি বিষয়ের সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, আমার লুক দেখে সে অনুযায়ী মেকআপে নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছেন বিউটি ভ্লগাররা। আমার কোনো একটি সাজ তাদের পছন্দ হয়েছে বলে সেভাবেই সাজার চেষ্টা করছেন। খুব ভালো লেগেছে আমার নিজস্বতায় পরিপূর্ণ সাজে অন্যদের সাজ দেখে। এটুকুই নয়। আমাকে যারা ফলো করেন, তাদের দেখেছি ‘নুসরাত ফারিয়া ইন্সপায়ারড আউটফিট’ তৈরি করে আমার মতো লুক নিতে। আমি সম্মানিতবোধ করেছি তাদের এই ভালোবাসা পেয়ে। একসময় ট্রেইলব্লেজারদের দেখে উৎসাহিত হতাম, আর আজ মানুষ আমার স্টাইলকে নিজের করে নিচ্ছেন। ট্রেন্ডে পরিণত করছেন। অবশ্য, আমি শুধু ফ্যাশনের ট্রেন্ড সেটার নয়, নারীদের আত্মবিশ্বাস, সাহসের নতুন দিক উন্মোচনেও কাজ করতে চাই।
অনুলিখন: সারাহ্ দীনা
মডেল: নুসরাত ফারিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কিয়ারা
জুয়েলারি: জড়োয়া হাউজ
স্টাইলিং ও ফ্যাশন ডিরেকশন: ফয়সাল তুষার
ছবি: জিয়া উদ্দীন