আলাপন I সৃষ্টিশীলতা নিজেই একটা উদ্দীপনা-আকিমুন রহমান
আকিমুন রহমান। কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও নারীবাদী লেখক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘জীবনের রৌদ্রে উড়েছিলো কয়েকটি ধূলিকণা’, ‘পুরুষের পৃথিবীতে এক মেয়ে’, ‘রক্তপুঁজে গেঁথে যাওয়া মাছি’, ‘সোনার খড়কুটো’, ‘যখন ঘাসেরা আমার চেয়ে বড়’ ইত্যাদি। পিএইচডি করেছেন ড. হুমায়ুন আজাদের তত্ত্বাবধানে। গবেষণাপত্রটি ‘আধুনিক বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার স্বরূপ (১৯২০-’৫০)’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় বাংলা একাডেমি থেকে।
লেখালেখির শুরু আশির দশকের অন্তিমে, তবে ১৯৯৬ সালে ‘বিবি থেকে বেগম’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি ব্যাপক আলোচিত হন।
সম্প্রতি ক্যানভাস স্টুডিওতে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন চঞ্চল আশরাফ ও শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন
ক্যানভাস: আপনি গবেষণার মতো প্রণালিবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল কাজ করেছেন। সাহিত্যচর্চা এর বিপরীত। তা-ও করেছেন। কীভাবে সম্ভব হলো? একটি অন্যটিকে কখনো বিরক্ত করেনি?
আকিমুন রহমান: গবেষণা বা মননশীল লেখা হচ্ছে খুবই সুশৃঙ্খল; কোনো না কোনো তত্ত্বের ভেতর ফেলে কাজটি করতে হয়। সেখানে ব্যক্তিগত আবেগ বা ভালো লাগা, মন্দ লাগা কিংবা খুব বেশি নিরীক্ষা করার অবকাশ থাকে না। তবে আমার গবেষণাকর্মে আমি এই বিধিবদ্ধতা নানাভাবে ভেঙেছি। এমন একটা কথা তো রয়েছেই যে, ব্যাকরণ তিনিই ভাঙতে পারেন যিনি ব্যাকরণ জানেন। না জেনে তো সেটা সম্ভবই নয়। আমি মনে করি আমার গবেষণাকর্মগুলো সৃষ্টিশীল পৃথিবীতে নেমে আসার বা উঠে যাওয়ার সিঁড়ি। ওগুলো করে আমি মূলত নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমার কল্পনাকে কী করে সংহত এবং আরও বেশি তুখোড়ভাবে প্রকাশ করতে পারি, সেই অনুশীলন এতে হয়েছে। সে কারণে মননশীল লেখাগুলো আমার সৃষ্টিশীল লেখার অন্তরায় নয় বরং সহায়ক। তবে বাস্তবে একটি সমস্যা হয়েছে। গবেষণার পাশাপাশি যে ছোটগল্প বা উপন্যাস বা সৃষ্টিশীল রচনাগুলো আমি করে থাকি, তাতে কিন্তু আমাকে ঔপন্যাসিক বলতে অনেকেরই খুব দ্বিধা দেখি। তারা আমাকে বলেন গবেষক, প্রাবন্ধিক। কখনো কখনো বলেন অধ্যাপক। আমি যে কথাসাহিত্য করি বা আমি উপন্যাস রচনা করি, সে পরিচয় যেন কোথায় চলে যায়! এটা একটা সমস্যা।
ক্যানভাস: সেই সমস্যার কোনো প্রভাব আপনার লেখালেখির ওপর পড়েছে কি?
আকিমুন রহমান: এটা আমার লেখার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলেনি। একেবারেই না। কারণ সেটা স্বপ্ন, বেদনা, ঈর্ষা, হেরে যাওয়া ও জিতে ওঠার ব্যাপার তো। আর গবেষণার কাজ হচ্ছে আমি কোন এলাকাটিতে আলোকপাত করতে চাই এবং নানা তথ্য ও উপাত্তের মধ্য দিয়ে আমি কোন বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই বা বের করে আনতে চাই, সেটা। লোকে যখন আমাকে শুধু প্রাবন্ধিক বলে বা গবেষক বলে, আমার উপন্যাসগুলোর নিবেদন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, আমি যন্ত্রণা বোধ করি। তবে আমার সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে এটা কোনো সমস্যা হয়নি।
ক্যানভাস: ‘বিবি থেকে বেগম’ প্রকাশের পর আপনি বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়েছিলেন। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
আকিমুন রহমান: এ বইটিকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য ৫৬ জন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী তৎপর হয়ে উঠেছিলেন এবং তারা কিন্তু বারংবার লিখিতভাবে বলেছিলেন, বইটির প্রকাশ এখনই বন্ধ করে দেয়া হোক। কিন্তু তাদের কেউ একটা কিছু লিখে বললেন না যে, এই কারণে বইটি বাতিলযোগ্য, চিন্তাটি খারাপ বা ভুল। সবাই শুধু বললেন যে, এটা বন্ধ করে দেয়া হোক। কিন্তু আমাকে কথা বলার কোনো সুযোগ দেয়া হলো না। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগই পেলাম না।
তখন আমার যেটা মনে হয়েছিল এবং এখনো এতে আমি খুব আতঙ্কবোধ করি যে, আমাদের দেশে মৌলবাদ কেবল প্রকাশ্যভাবেই নয়; প্রগতিশীলদের ভেতরেও অন্ধকার, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং একধরনের মৌলবাদ কাজ করে। আমি প্রকাশ্য মৌলবাদীদের নিয়ে নিশ্চিন্ত যে আমি জানি ওর কাছে কী আছে, ও কী করতে চায়। কিন্তু প্রগতিশীলতার ভেতর যখন এটি লুকিয়ে থাকে, তখন একে মোকাবিলা করা মুশকিল। যখন বলে বইটি নিষিদ্ধ করতে হবে, তখন সেটা তো ফ্যাসিবাদ। তাহলে আমাদের মুক্তি কোথায়? আমরা তো মৌলবাদ দিয়ে ঘেরাও হয়ে আছি।
ক্যানভাস: বিবি থেকে বেগমের বিষয় বা বক্তব্যে কী ছিল, যা তাদের খেপিয়ে তুলেছিল?
আকিমুন রহমান: এর উপশিরোনামে আছে বাঙালি মুসলিম নারীর ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস। বাঙালি মুসলমান নারীদের জন্য কেমন ছক তৈরি করেছিলেন বিভিন্ন লেখক এবং সেটি সমাজে কতখানি প্রভাব বিস্তার করেছিল, সে বিষয়গুলো বইটিতে ছিল। কতগুলো জনপ্রিয় উপন্যাস, যেমন- ‘আনোয়ারা’, ‘সালেহা’, ‘মনোয়ারা’-এ বইগুলো কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে প্রবল জনপ্রিয় ছিল এবং প্রতিটি বিয়ের বাসররাতে স্বামী তার স্ত্রীকে এগুলো উপহার দিতেন। সেই বইগুলোর ভেতর আদর্শ নারীর যে ছাঁচ তৈরি করেছেন লেখক এবং স্বামীরা যারা বেশি শিক্ষিত নন, হয়তো ম্যাট্রিকুলেশন ফেল, তারা চাইতেন যে তাদের স্ত্রীরা নিজেদের পছন্দমাফিক ওই আদলে গড়ে উঠবে। ওই রকম একটা নারীকুল কিন্তু তৈরি হচ্ছিল ক্রমাগত। বলা হয়, অমুক অমুক পুরুষ দেবদূতের ভূমিকা পালন করেছেন বাঙালি মুসলিম নারীর মুক্তির জন্য এবং একজনের এক পত্রিকা একটা যুগ তৈরি করেছে। ওই পত্রিকার আদ্যোপান্ত সবকিছুই আমি পড়লাম। দেখলাম, যুগ সৃষ্টি করার জন্য তো নতুন চিন্তা, নতুন ভাবনা, কোথায় অন্ধকার আছে সেটা নির্দেশ করা, অন্ধকার দূর করার জন্য কী করতে হবে, তার একটা বিধি-বন্দোবস্ত তৈরি করতে হয়। কিন্তু সেখানে শুধু মেয়েদের সুন্দর করে সাজিয়ে-গুজিয়ে ছবি দেয়া হতো, স্বামীরা স্ত্রীদের জন্য কচি-কচি কাঁচা-কাঁচা পদ্য নিয়ে যেতেন, নানা রকম ইসলামি সংস্কৃতির জয়গান গাওয়া হতো ওই পত্রিকায়। সেখানে মেয়েদের বলা হতো, তুমি ফাইভ পাস হও, কোনো অসুবিধা নেই, তুমি কিন্তু পদ্য লিখতে পারো এবং সমাজে তোমার বাহবা হবে। বিষয়টি দেখে আমার মনে হয়নি যে, সেটা একটা যুগ তৈরি হয়েছে বা নারীদের মুক্তির জন্য কোনো কাজ হয়েছে। কখনোই নারীদের বলা হয়নি যে পড়াশোনা করো এবং স্বাবলম্বী হও। আমি বলতে চেয়েছিলাম যে, যিনি ওই পত্রিকার সম্পাদনার কাজে আছেন আর যিনি আমাদের নারীদের দেবদূত হয়ে আসছেন, তিনি আমাদের জন্য কোনো আদর্শ নন। কারণ, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হওয়া এবং পুরুষের সঙ্গে কদমে কদমে চলার যোগ্যতা অর্জন করা দরকার। এর মধ্য দিয়েই তো নারী মানুষ হয়ে ওঠে। এটি যেহেতু হয়নি, তারা আমাদের আদর্শ হতে পারেন না।
ক্যানভাস: শোনা যায়, সৃষ্টিশীলতার পেছনে যে উদ্দীপনাগুলো কাজ করে, সেসবের বেশির ভাগই জৈবিক; যেমন প্রেম, যৌন ঈর্ষা, অবদমন ইত্যাদি। আপনার কী মনে হয়?
আকিমুন রহমান: এটা খুব বাঁধাধরা কিছু ধারণা যে সৃষ্টিশীলতার জন্য অনুপ্রেরণা লাগে, ওই লাগে, সেই লাগে। সৃষ্টিশীলতা নিজেই তো একটা উদ্দীপনা। যা ভেঙেচুরে তছনছ করে দেয়, তারপর প্রচ- রকম সমাহিত করে, সমস্ত জাগতিক বাসনা নিবৃত করে দেয়। নতুন একটি বাসনার জন্ম দেয়।
ক্যানভাস: আপনার লেখা পত্রে পুরুষতন্ত্রের প্রতি অসন্তোষ লক্ষ করা যায়। নারীর বিপন্নতা দেখাতে গিয়ে এমনটি ঘটেছে, নাকি নারীবাদী চেতনা এর মূলে কাজ করেছে?
আকিমুন রহমান: আমি কিন্তু পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বা পুরুষতন্ত্র ভেঙে ফেলো, তছনছ করে দাও তথা পুরুষকে প্রতিপক্ষ মনে করি না। আমি মনে করি পুরুষ হচ্ছে পরিপূরক। যে সিস্টেমটা চলছে, তার মধ্যে কিন্তু মস্ত বড় গলদ রয়ে গেছে। যে কারণে পুরুষও বিপন্ন; কিন্তু পুরুষ যেহেতু নানা জায়গায় সক্রিয় থাকে, সে অনেক সুবিধা পায়, মনে হয় তার অনেক ক্ষমতা। আসলে সেও নিয়ন্ত্রিত, সেও বিপন্ন, সেও বুঝতে পারছে না যে কেমন করে একটি সিস্টেম তার সুস্থ মানবিকতা কেড়ে নিয়ে তাকে একরকমের হিংস্র করে তুলেছে। নারী কিন্তু তার চেয়ে বেশি বিপন্ন। পুরো বিধি-বন্দোবস্তের কারণে।
ক্যানভাস: আপনার অবসর কীভাবে কাটে? কী লিখছেন এখন? কীইবা পড়ছেন?
আকিমুন রহমান: সে অর্থে আমি কখনো অবসর নিই না। কারণ, আমি পড়তে পড়তে আমার বারান্দা দিয়ে আমার উঠানের দিকে তাকাই, আমার গাছের পাখিদের কিচিরমিচির শুনি। আমাদের গাছের কামরাঙা যখন পেকে ওঠে, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে বুলবুলি আসে। ওরা এসে ঠুকরে ঠুকরে খেতে থাকে। সেটা দেখি। আর এ মুহূর্তে আমি একটি উপন্যাস লিখছি। নাম ‘একদিন একটি বুনো প্রেম ফুটেছিল’। সাবজেক্ট হচ্ছে প্রেম।
ক্যানভাস: আপনার লেখক-জীবনের কোনো আনন্দদায়ক ঘটনা…
আকিমুন রহমান: ৭৫ বছর বয়সী একজন পাঠক আমার একজন শিক্ষকের কাছে চিঠি লিখেছিলেন আমার বই নিয়ে। তিনি আমার ঠিকানা জানতেন না। লিখেছিলেন, আমি উনার বইটি পড়ে আপনার শরণাপন্ন হলাম। কারণ, উনি আপনার ছাত্রী, আপনি চিঠিটা দয়া করে উনাকে পৌঁছে দেবেন। আমি বলতে চাই যে এতখানি সত্য জানার জন্যই আমি এই দেহ ধারণ করেছিলাম।
ক্যানভাস: আপনি হুমায়ুন আজাদের তত্ত্বাবধানে পিএইচডি করেছেন। সৃষ্টিশীল, পন্ডিত এবং আপনার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হুমায়ুন আজাদ- এই তিনটি সত্তা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণের সারসত্য জানতে চাই।
আকিমুন রহমান: এটা আমার মানবজন্মের পরম পাওয়া বলে মনে করি যে, আমি তাঁর তত্ত্বাবধানে কাজ করতে পেরেছি। প্রকৃতি আমাকে এত আনুকূল্য কেন প্রদর্শন করেছিল, এতখানি ভালোবাসা আমাকে কেন দিয়েছিল আমি ভেবে পাই না। আমি খুব কৃতজ্ঞ প্রকৃতির কাছে। আমি স্যারকে নানাভাবে দেখেছি। আমি দেখেছি তিনি কতখানি রোম্যান্টিক। যদিও তাঁর আচরণে বাইরে থেকে সেটা বোঝা যেত না। তিনি কচুরিপানার ফুল দেখতে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে ছুটে যেতেন। বেলি ফুলের গন্ধ পাওয়ার জন্য তিনি আকুল ছিলেন। বৃষ্টি দেখলে বেরিয়ে পড়তেন। ভিজে ভিজে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতেন। কিন্তু ভঙ্গিটা করতেন এমন যে তিনি রিকশা পাচ্ছেন না, তাই বৃষ্টিতে ভিজছেন। প্রেম নিয়ে তার অন্য রকম আকুলতা ছিল।