মনোযতন I সিজোফ্রেনিয়া সারাই
সবচেয়ে পরিচিত মনোরোগগুলোর একটি। আতঙ্কজাগানিয়াও। তবু ভড়কে না গিয়ে চাই যথাযথ সামাল দেওয়া। বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে লিখেছেন আশিক মুস্তাফা
ঝাঁজালো রোদের ফাঁকফোকরে, আকাশে কখনো কখনো মেঘের ঘোরাঘুরি। এই মেঘ হয়তো আনমনেই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় শৈশবে। কিংবা মন কেমনের দেশে। নিজের সঙ্গেই তখন কথা বলে ওঠেন আপনি। কখনো মোবাইলে ‘আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদরদিনে…’-এর সঙ্গে ঠোঁট মিলিয়ে জানালায় বসে বৃষ্টির ফোঁটায় প্রশান্তি খোঁজেন। বর্ষার এ এক চিরচেনা দৃশ্য। কিন্তু এমন দৃশ্যের হয়তো কোনো আবেদনই নেই আপনার ঘরেরই আরেকজনের কাছে। তিনি ঘরের কোণে বসে একাকী কথা বলেন; কিংবা চুপচাপ চেয়ে থাকেন। কেউ আগ বাড়িয়ে কথা বললেও তার কাছ থেকে পাওয়া যায় না সাড়া। কখনো মুখ ফসকে কথা বেরিয়ে এলেও তা অসংলগ্ন। এই যে অসংলগ্নতা, এটাই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় সিজোফ্রেনিয়া। আরেকটু মোটাদাগে বললে, জটিল এক মানসিক রোগের নাম সিজোফ্রেনিয়া। যার ঘাড়ে ভর করে এই রোগ, তার মনে হতে পারে, এই বুঝি পরিবারের কেউ তার খাবারে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে! তাকে এড়িয়ে করে ফেলছে পরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ ছাড়া আরও অমূলক সন্দেহ তাড়া করে তাকে।
এমন রোগীদের নিয়ে সাধারণত পরিবারের লোকেরা পড়ে যান বড় ধরনের সমস্যায়। রোগীর অদ্ভুত আচরণের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বড্ড হিমশিম খেতে থাকেন।
লক্ষণের উপলক্ষ
সিজোফ্রেনিয়া খুবই জটিল এক মনোরোগ। এর লক্ষণের নেই অন্ত। তবে উল্লেখযোগ্য কিছু লক্ষণ দেখে চিহ্নিত করতে পারেন এই রোগে আক্রান্তদের। যেমন—
একা একা কথা বলা;
চুপচাপ থাকা;
কারও কথার জবাব না দেওয়া;
কানে অলীক কথা শোনা;
অসংলগ্ন কথা বলা;
গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে উদাসীন বোধ করা;
নিজের খেয়াল রাখার ব্যাপারে উদাসীন হয়ে পড়া;
কোনো কাজে মনোযোগ না থাকা;
আবেগ, অনুভূতি কমে যাওয়া;
প্রাত্যহিক কাজ সঠিকভাবে না করা;
ভুল কিছু বিশ্বাস করা;
অহেতুক সন্দেহপ্রবণতা তৈরি হওয়া;
অবাস্তব চিন্তাভাবনা করা প্রভৃতি।
এ ছাড়া অনাগ্রহ, চিন্তার অক্ষমতা, আবেগহীনতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধও এ রোগের লক্ষণ। আর এ ধরনের রোগীরা কিছু অবাস্তব দৃশ্য দেখার দাবি করেন। অবাস্তব স্পর্শ অনুভবের কথা বলেন। যেমন তার ত্বকের ভেতরে পোকা হাঁটাহাঁটি করছে। কিছু রোগীকে বলতে শোনা যায়, তার পেটে ও মাথায় পোকা কিলবিল করছে। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে এ রোগের লক্ষণগুলো কয়েক মাস কিংবা বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকাশ পেতে পারে; আবার হঠাৎ করেও দেখা দিতে পারে। তবে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত সব রোগীর লক্ষণ এক হয় না। লক্ষণগুলো সাধারণত রোগীর ওপর নির্ভর করে।
সমাজের রক্তচক্ষু
আমাদের অনেকে সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে বসবাস করেন। অথচ তা আমরা বুঝতে পারি না। চিকিৎসকেরা মনে করেন, মানসিক রোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ও সবচেয়ে অক্ষম করে তোলা রোগের অন্যতম সিজোফ্রেনিয়া। মানসিক রোগীদের ‘পাগল’ বলে অমানবিক ও অপমানকর অপবাদ দেওয়ার কারণ এই রোগজনিত কিছু অস্বাভাবিক আচরণ, চিন্তা ও প্রত্যক্ষণ। অথচ এই রোগসহ অন্যান্য মানসিক রোগের উৎপত্তি সাধারণত ঘটে মস্তিষ্কের জৈব-রাসায়নিকের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা বা অসামঞ্জস্যের কারণে।
সিজোফ্রেনিয়া একটি মস্তিষ্ককেন্দ্রিক রোগ। অথচ এ রোগে আক্রান্তদের অনেক ক্ষেত্রেই পাগল বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা, অপমান করাসহ চিকিৎসাবঞ্চিত রাখা হয়। কোনো কোনো পরিবারে একজন মাদকাসক্ত কিংবা সিজোফ্রেনিয়া রোগী থাকলে অনেক সমাজের চোখে সেই পরিবার যেন হয়ে ওঠে কলঙ্কিত! সামাজিক বৈষম্য ও লোকলজ্জার ভয়ে ওই পরিবার ও ব্যক্তিকে হেয়কর ও লাঞ্ছনাকর জীবন যাপন করতে হয়। তবে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অবদানে বর্তমানে এই রোগীরা শুধু আরোগ্য লাভই করছেন না, অর্থপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন জীবনেরও অধিকারী হয়ে উঠতে পারছেন।
সমীক্ষা কথা বলে
এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্তমান বিশ্বে প্রায় তিন কোটি মানুষ সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন। আর বাংলাদেশে এই রোগীর সংখ্যা ছাড়িয়েছে প্রায় ১৮ লাখ। সাধারণ মানুষের চেয়ে এই রোগীরা ১৫ থেকে ২০ বছর আগে মারা যান। অন্যদের তুলনায় তারা ছয়-সাত গুণ বেশি বেকার জীবন যাপন করেন। তারা প্রায়ই গৃহহীন থাকেন কিংবা রাস্তায় ভবঘুরে জীবন যাপন করেন; সর্বোপরি তাদের মধ্যে ৫ থেকে ১০ শতাংশ আত্মহননের পথ বেছে নেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, রোগজনিত অক্ষমতার প্রথম ১০টি কারণের একটি হচ্ছে সিজোফ্রেনিয়া। এ রোগে আক্রান্তরা অনেক ক্ষেত্রেই মর্যাদাহীন এবং নির্বান্ধব ও আত্মীয়হীন জীবন যাপন করেন। শিক্ষার সুযোগ হারান, চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকেন; তাদের শারীরিক সুস্থতা ও চেহারা বিনষ্ট হয়, সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে যায়। সর্বোপরি ভবিষ্যৎ জীবন বলে কিছু অবশিষ্ট থাকে না। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে ধূমপানের হার দুই থেকে ছয় গুণ বেশি। তাদের মধ্যে ৪৫ থেকে ৫৫ শতাংশ স্থূলতায় ভোগেন। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের হারও তাদের মধ্যে অধিক থাকে। অথচ অন্যদের তুলনায় তাদের শারীরিক রোগের চিকিৎসায়ও অবহেলা করা হয়।
ভুলের বেসাতি
একসময় ধারণা করা হতো, এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। আক্রান্তদের নিয়তিতে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুই লেখা! অবশ্য আধুনিক চিকিৎসা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, এমন ধারণা নিতান্তই ভুল। এমনকি আক্রান্তরা উৎপাদনশীল ও সৃজনশীল কর্মেও ফিরে আসতে পারেন। চিকিৎসকেরা মনে করেন, এই রোগে আক্রান্ত ২৫ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেন, ৩৫ শতাংশ স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারেন, ২০ শতাংশ সহায়তা সাপেক্ষে উন্নতি লাভ করেন। শুধু ১৫ শতাংশই তেমন উন্নতি লাভ না-ও করতে পারেন। অথচ এই ১৫ শতাংশকে দেখেই অনেকে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান, এ রোগ আরোগ্য লাভ হয় না।
ঝুঁকির হিসাব
চিকিৎসকেরা বলছেন, এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে ২০ বছর বয়সের শুরুর দিকে। ৪৫-এর পর তা কমে যায়। ৫০ বছরের পর সাধারণত নতুন কেউ সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হন না, যদি না আগে থেকেই তা তাকে আক্রান্ত করে থাকে। অন্যদিকে, ৫৫ বছরের পর নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা কম।
এখন পর্যন্ত এই রোগের সঠিক কারণ জানা না গেলেও যেসব প্রধান কারণ এর জন্য দায়ী, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জেনেটিক বা বংশধারা। বংশের কারও এই রোগ থাকলে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকেরা বলছেন, বাবা-মা দুজনের এই রোগ থাকলে সন্তানের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৪০ গুণ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, যমজ বাচ্চার একজনের থাকলে আরেকজনের ঝুঁকি বাড়ে ৫০ গুণ। এ ছাড়া সন্তান মাতৃগর্ভে থাকার সময় কোনো সমস্যা হলে কিংবা জন্মানোর সময় কোনো ক্ষতি বা অক্সিজেনের অভাব হলে এই রোগ হতে পারে। কেউ যদি চাইল্ডহুড ট্রমায় ভোগেন কিংবা অতি সংবেদনশীল ব্যক্তিত্বের অধিকারী হন, তার সঙ্গে কোনো ভয়াবহ ঘটনা ঘটলে তিনি সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন।
মুশকিল আসান
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু বলেন, ‘সিজোফ্রেনিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয় রোগটির জন্য নয়, বরং সমাজ ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ওই রোগকে যে প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা দিয়ে থাকে, সে জন্য। এই রোগীরা সঠিক চিকিৎসায় শুধু আরোগ্য লাভই করেন না; তারা গড়ে উঠতে, বেড়ে উঠতেও পারেন। এর জন্য ওষুধ ও চিকিৎসার পাশাপাশি কমিউনিটি বেসড রিহ্যাবিলিটেশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা জরুরি। যত আগে থেকে চিকিৎসা শুরু হবে, ফল তত ভালো হবে। চাকরির সংস্থান, বাসস্থানের ব্যবস্থা, যথাযথ শিক্ষার সুযোগ, উপযুক্ত বিনোদন এবং ভালোবাসাপূর্ণ পারিবারিক জীবন এদের আরোগ্য লাভকে ত্বরান্বিত করতে পারে। এককথায়, আমরা একটি ভালো জীবনের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকি, সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্তদের জন্যও সেসব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের প্রতি পরিবারে আবেগের ধরন ও মাত্রা বিশেষ ভূমিকা রাখে। যদি তাদের প্রকাশ্য সমালোচনা, শত্রু মনোভাব পোষণ কিংবা অতিরিক্ত আগলে রাখার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এই রোগের তীব্রতা বেড়ে যেতে পারে।’
‘ওষুধ দিয়েই মূলত রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রথমে অ্যান্টিসাইকোটিক মেডিসিন, এরপর সাইকোথেরাপির দিকে যেতে হয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনো ধরনের ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না,’ যোগ করেন তিনি।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু আরও বলেন, ‘সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত ৮০ শতাংশ রোগী কিছুদিন ভালো এবং কিছুদিন খারাপ থাকেন। অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বা সুস্থ হন না। বাকি ১৫ থেকে ২০ শতাংশ একদম ঠিক হয়ে যান। এই রোগীদের মৃত্যুর হার বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ, তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। ৫ থেকে ১০ শতাংশ সুইসাইড করেন। তাই এ রোগীর প্রতি তার পরিবারের সদস্যদের সংবেদনশীল ভূমিকা রাখা জরুরি।’
এই নিউরোলজিস্টের মতে, এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে পারে রোগীর পরিবার:
এই বিশ্বাস নিজের ভেতর তৈরি করতে হবে যে এটি একটি রোগ। পরিবারের কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে লজ্জিতবোধ করার কিছু নেই।
এই রোগের জন্য নিজেকে অপরাধী ভাবা যাবে না। এটি কারও ভুলের ফল নয়। এই রোগকে মেনে নিন।
রোগের লক্ষণ জেনে নিন। কেননা, প্রাথমিক লক্ষণ আগে ধরতে পারলে পুনরায় আক্রমণ এলে তা তুলনামূলক সহজে ঠেকাতে পারবেন।
রোগীর জন্য একটি দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করুন এবং তা মেনে চলতে তাকে সহায়তা করুন।
রোগী যেন নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, সেদিকে খেয়াল রাখুন।
তাকে বুঝতে দিন, তিনি একাই এই রোগ মোকাবিলা করছেন না, আপনারাও তার সঙ্গে রয়েছেন।
এ নিয়ে প্রকাশ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা প্রকাশ করবেন না। সরাসরি নির্দয় সমালোচনা করবেন না; বরং নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারলে প্রশংসা করুন।
বাসায় চিকিৎসা সম্ভব না হলে চিকিৎসকের পরামর্শে হাসপাতালে ভর্তি করান। দেখবেন, একসময় নতুন আলোয় ফিরে আসবে আপনার প্রিয় মানুষটি।
ইলাস্ট্রেশন: সংগ্রহ