যাপনচিত্র I রয়েসয়ে
মাশা ইসলাম। হালের মিউজিক সেনসেশন। তার একান্ত জীবনে দেওয়া যাক উঁকি
ইউটিউব সেনসেশন হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও বিজ্ঞাপনচিত্র, ওয়েব সিরিজ, সিনেমা, কোক স্টুডিও—সর্বত্রই মাশা ইসলামের দুর্দান্ত পদচারণ। সম্প্রতি ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের অভিষেকে গান গেয়ে আবারও আলোচনায়। মিউজিক কম্পোজার ফুয়াদ, অর্ণব, প্রীতম, শিশির আহমেদ, ইমন চৌধুরী প্রমুখের সঙ্গে কাজ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন’ ওয়েব সিরিজের টাইটেল ট্র্যাক ‘পরজীবী শহরের গান’ও তারই গাওয়া। এরও আগে, ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া রাহশান নূরের ‘বেঙ্গলি বিউটি’ সিনেমায় দুটি গান গেয়েছেন; অন্যদিকে, অনম বিশ্বাসের ‘দুই দিনের দুনিয়া’ ওয়েব ফিল্মে ‘টেকা পাখি’ গানটি গেয়েও শ্রোতাদের মাত করেন।
মাশা যখন শাড়ি পরে গিটার হাতে স্টেজে ওঠেন, বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় দর্শক-শ্রোতা! তা কি শুধু তার জাদুকরি কণ্ঠের কারণেই? ভিন্নধর্মী স্টাইল আর ব্যক্তিত্বের চমকও ভূমিকা রাখে তার তাক লাগানো সব স্টেজ পারফরম্যান্সে। সুরের মায়া আর স্টাইলের জাদুতে তিনি এভাবে জয় করে চলেছেন অনুরাগীদের মন।
মাশার বডি ক্লক খানিকটা ফিক্সড। সকালে ঘুম থেকে ওঠেন ৭টার মধ্যে। তারপর ধীরতালে গোছাতে থাকেন সারা দিনের কর্মপরিকল্পনা। ১০টার মাঝেই সারেন ব্রেকফাস্ট। মেনুতে থাকে ডিম, টোস্ট। আমের মৌসুমে ওটসের সঙ্গে আম মিশিয়ে খেতে ভালোবাসেন। মুড থাকলে ভাত ভাজা, পান্তাভাতের স্বাদও নেন মাঝেমধ্যে। চা তো থাকেই।
প্রতিদিন সকালে খানিকটা রেওয়াজ করার চেষ্টা থাকে তার। সকাল সকাল নিজেকে পরিপাটি রাখতেও ভালোবাসেন। আর হ্যাঁ, মাশা বেশ ফিটনেস-সচেতন। ফ্রি বডি এক্সারসাইজ, মেডিটেশনে আস্থা তার। প্রতিদিন ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ব্যয় করেন দেহযতনে।
মিউজিকের পাশাপাশি ডেভেলপমেন্ট সেক্টরেও কাজ করছেন এই গায়িকা। মা-বাবা, বড় ভাইকে নিয়ে তার পরিবার। মাশার বাবাও গান গাইতে পছন্দ করেন। তার পরিবারচক্রেই রয়েছে সাংস্কৃতিক আবহের উপস্থিতি।
বেলা তিনটার মধ্যে মধ্যাহ্নভোজ সারেন মাশা। খাবারের ক্ষেত্রে বাঙালিয়ানা খুব পছন্দ। ভাত খেতে ভীষণ ভালোবাসেন, বিশেষ করে ঘি মাখানো। ডাল, ডিম, নানা পদের ভর্তার পাশাপাশি পাতে রাখেন কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, শুকনো মরিচ। প্রোটিনের উৎস হিসেবে রাখেন মুরগির মাংস অথবা মাছ।
নিজের বাসা সাজাতে পছন্দ করেন। দেয়ালে শোভা পায় ছবি। ছোট ছোট শোপিস আছে ঘরে। ছিমছাম, পরিপাটি, মিনিমাল অবজেক্টেই সাজিয়ে রাখেন ঘর।
ড্রেস-আপ, মেকআপে খুবই মিনিমালিস্টিক থাকেন মাশা। শাড়ি, ওয়েস্টার্ন, কামিজ—সব ড্রেসেই কমফোর্টেবল। পরিবেশ-পরিস্থিতি, সময় বিবেচনা করে পোশাক বেছে নেন। তবে স্নিকার পরা আর সংগ্রহেও দারুণ ঝোঁক। ইনস্ট্রুমেন্ট কালেক্ট করতেও পছন্দ করেন। ২০১৬ সালে কেনা প্রথম গিটারটি এখনো পরম যত্নে রেখেছেন। এর আগে থেকেই সংগ্রহে ছিল একটি উডস ইউকেলেলে।
মাশা বলেন, ‘স্টাইলে আমার কাছে অগ্রাধিকার পায় কমফোর্ট। ফ্যাশন ও স্টাইল খুব সাবজেকটিভ। এটা আসলে একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। মুভমেন্টে আমি কতটা কমফোর্টেবল, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিক পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝে নিজেকে সেই স্টাইলে মানিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করি।’
সময় পেলেই রান্না করতে ভালোবাসেন। রান্নার চেয়ে বরং রান্না করে মানুষকে খাওয়াতে বেশি তৃপ্তি পান। জানা গেল, বিরিয়ানি রান্নায় নাকি বন্ধুমহলে বেশ সুনাম আছে তার!
ঘুরতে খুব ভালোবাসেন। ভ্রমণে সবচেয়ে পছন্দের দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে আছে এক দারুণ স্মৃতি। ২০১৮ সালে একটি ডিবেট কনফারেন্সে হাজির হয়েছিলেন। একবার সাবওয়েতে গিয়ে খেয়াল করেন, ওয়ালেট ফেলে এসেছেন বন্ধুর কাছে। সঙ্গে মেট্রোকার্ড থাকলেও তাতে পর্যাপ্ত ক্রেডিট ছিল না। সেই হতভম্ব মুহূর্তে দুজন সিনিয়র সিটিজেনের কাছে সাহায্য চান। কিন্তু বিধি বাম! তাদের মেট্রোকার্ডেও পর্যাপ্ত ক্রেডিট ছিল না। তবু তারা মাশার মেট্রোকার্ড রিচার্জ করে দিয়েছিলেন। অচেনা হওয়া সত্ত্বেও তাকে ক্রাইসিস পিরিয়ড কাটাতে ২ ডলার সঙ্গে দিয়ে দিয়েছিলেন ওই দুই ব্যক্তি। বিদায়বেলায় ম্যাগাজিন উপহার দেন যাত্রাকালীন সময় উপভোগ করার জন্য। এরপর আবারও বাধে বিপত্তি।
ভুল করে গন্তব্যের উল্টো দিকের ট্রেনে উঠে পড়েন মাশা। ফলে পরবর্তী স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন করে টিকিট কাটতে হয়েছিল তাকে। ওই দুই অচেনা ব্যক্তির দেওয়া সেই ২ ডলারে তিনি বিপদ সামলেছিলেন সেই যাত্রায়। এখনো প্রতি ভ্যালেন্টাইন ডেতে তাদের কথা স্মরণ করেন। নিজের কোনো সৃষ্টিকর্ম তাদের উৎসর্গ করার ইচ্ছা আছে তার। তাদের নাম, ফোন নম্বর—কিছু জানা না থাকলেও সেই আন্তরিকতা ভোলার নয়। মাশা মনে করেন, এ ধরনের স্মৃতি ভ্রমণকে স্মরণীয় করে তোলে। ভ্রমণে বিভিন্ন মানুষ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য দেখার ফলে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় উপলব্ধি করা যায়। সেই সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিও প্রসারিত হয়। তাই সুযোগ পেলেই ভ্রমণে বের হয়ে যাওয়া উচিত, সেটা দেশে হোক অথবা বিদেশে—অভিমত তার।
গরম এড়াতে ও আরামের অনুভূতি পেতে চুল খানিকটা ছোট রাখেন মাশা। মাঝেমধ্যে অবশ্য চুল বড় করা হয়। ছোটবেলায় বই পড়তে ভালোবাসতেন। সেই অভ্যাস ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। তার সবচেয়ে পছন্দের লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল।
মাঝেমধ্যে একাকী সময় কাটাতে ভালোবাসেন এই গায়িকা। তখন কফি শপে বসে থাকেন, নয়তো সিনেমা দেখেন। একান্ত নিজেকে সময় দেওয়াকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানেন তিনি। তার সবচেয়ে পছন্দের কাজ গান শোনা। ক্লাসিক্যাল, পপ, রক—সব জনরাই পছন্দ। শুনতে শুনতে দিনে ৮-১০টি গান অনায়াসে কণ্ঠে তুলে ফেলতেন ছোটবেলায়। পছন্দের মিউজিশিয়ান ও অনুপ্রেরণা এ আর রহমান, অমিত ত্রিবেদি, বিয়ন্সে, শ্রেয়া ঘোষাল, সুনিধি চৌহান, রাহাত ফতেহ আলী খান, নুসরাত ফতেহ আলী খান, শফকত আমানত আলী, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন প্রমুখ। অবসরে সিনেমা ও টিভি সিরিজ দেখেন। ডেনজেল ওয়াশিংটনের অভিনয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন। ভালো লাগে তার যেকোনো সিনেমা। হিন্দি সিনেমার মধ্যে বেশি প্রিয় জিন্দগি না মিলেগি দোবারা, দিল চাহতা হ্যায়।
সেলিব্রিটি ক্রাশের প্রসঙ্গ উঠতেই মজার ছলে মাশা বলেন, ‘এটা চেঞ্জ হতেই থাকে! অনেক বছর আমার ক্রাশ ছিলেন জন মেয়ার। এরপর শন ম্যান্ডেসকেও ভালো লেগেছে।’
‘২০১৯ সালে মালয়েশিয়ায় এড শিরানের কনসার্ট দেখেছিলাম। ১০৩ ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ৮ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকে সামনে স্ট্যান্ডিংয়ে থেকে উপভোগ করেছিলাম সেই কনসার্ট। প্রথমে একটি জাপানিজ ব্যান্ড পারফর্ম করেছিল। এড শিরান যখন স্টেজে উঠলেন, মনে হলো আমার জ্বর সেরে গেছে! সেখানে করা পাগলামো আমার স্মরণীয় স্মৃতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে রয়েছে,’ জানালেন তিনি।
মাশা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন একটু রয়েসয়েই। খুব যে পছন্দ করেন, তা নয়। হয়তো কোনো ট্রিপে গেলে কিংবা মিউজিক্যাল পারফরম্যান্সের ছবি দেওয়া হয় টুকটাক। ফেসবুকের চেয়ে ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবে সময় কাটে বেশি।
মাশার রাতের পাতে থাকে ভাত। কখনো কখনো অবশ্য ভাতের বদলে সবজি অথবা নুডলস বেছে নেন। পছন্দ করেন লেবুর শরবত ও ডাবের পানি। মধু দিয়ে রং চা পান করা উপভোগ করেন। রাতে খাবার ও ঘুমের নির্দিষ্ট সময় নেই। তবে প্রাত্যহিক ৬ ঘণ্টার ঘুম খুব গুরুত্বপূর্ণ তার কাছে।
প্রতিশ্রুতিশীল এই তারকার জীবনদর্শন খুব সহজ। মাশা বলেন, ‘আমি খুব একটা বস্তুবাদী নই। আমার মনে হয়, টাকা আপনাকে সাসটেইনেবিলিটি দেবে। তবে তার চেয়েও মানসিক প্রশান্তি ও সুখ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য কিছু করলে, প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে তা আবার ফিরিয়ে দেয়।’
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন