এডিটর’স কলাম I বিচ্ছিন্নতাবোধের বিষ
জনারণ্যের ভিড়ে হয়ে পড়েছেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! বিচ্ছিন্নতাবোধ বাসা বেঁধেছে আপনার অন্তরমহলে। কারও সঙ্গে চাইলেও মিশতে পারছেন না ঠিকঠাক; আনমনেই সারাক্ষণ নিজেকে ‘একা, ভীষণ একা’ মনে হচ্ছে
ব্যক্তিস্বাধীনতা। আধুনিক বিচারবোধসম্পন্ন মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত বাসনা। সর্বজনীন দৃষ্টিতে, জীবনকে নিজের মতো সাজিয়ে তোলার, নিজস্ব জীবনবোধ লালন করার স্বাধীনতা। রাজনৈতিক দৃষ্টিতে, ব্যক্তিগত অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। যদিও এটি মানুষের জন্মগত অধিকার, তবু তা অর্জনে লড়তে হয় ভীষণ। কখনো প্রচলিত সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে; কখনো নিজের বিরুদ্ধেই। তবু ব্যক্তিস্বাধীনতার পিপাসা ফুরানোর নয়। ফুরানো উচিতও নয়, বোধ করি। কেননা, এ এক শাশ্বত চাওয়া। যার পুরোটাই আপাতদৃষ্টে ইতিবাচক। কিন্তু আরও অনেক ইতিবাচক বিষয়-আশয়ের মতো এরও রয়েছে কিছু নিকষ কালো দিক। কিংবা বলা ভালো, ব্যক্তিস্বাধীনতাকে ঠিকমতো উপলব্ধি করতে না পারলে, এর ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করালে তা বাঁক নিতে পারে নেতিবাচক তাৎপর্যে। তেমনই এক পরিণতির নাম অ্যালিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতাবোধ।
দুই
ধরা যাক, কর্মক্ষেত্রে, সামাজিক জীবনযাপনের বেলায় কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়ানো থেকে নিজেকে যথাসম্ভব দূরে রাখার প্রচেষ্টা বরাবরই থাকে আপনার। বাধ্য হয়ে কখনো কখনো এমন সব ছাড়ও দিতে হয়, যেগুলো হয়তো সাধারণ অর্থে নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করে। কিন্তু এসব বাধ্যবাধকতা পেরিয়ে যা একান্ত জীবন, সেখানে আপনি কোনো ছাড় দিতে নারাজ। জীবনকে যেভাবে অনুভব করেন, আপনার কাছে জীবনের মাহাত্ম্য বা তাৎপর্য যা, তার চর্চা সেই ব্যক্তিজীবনে অব্যাহত রাখতেই অভ্যস্ত। সেখানে হয়তো জবাবদিহির কোনো বালাই থাকে না, শুধু নিজের কাছে দায়বদ্ধ থাকা ছাড়া। কেননা, আপনার সেই সব কর্মকা- আপাতদৃষ্টে সমাজব্যবস্থা কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়ায় না। কাজের সময়টুকুর বাইরে, যখন নিজের সঙ্গে নিজের জীবনযাপন, আপনি থাকেন নিজের মতো। কারও সাতে-পাঁচে নয়। আপনার এই অভ্যাসের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে পরিমণ্ডলও। আপনাকে কেউ ঘাঁটায় না খুব একটা। সাদাচোখে, আপনি ব্যক্তিস্বাধীনতার সুফল উপভোগ করা ব্যক্তি হিসেবে অনেকের কাছেই উদাহরণ হয়ে ওঠেন। কিন্তু খেয়াল করে দেখেছেন কি, এমন চর্চা করতে করতে অজান্তেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন অন্য মানুষদের কাছ থেকে বেশ দূরে। নিজের এমন এক পরিমণ্ডল গড়ে তুলেছেন, যা ভেদ করে একান্ত আপনার কাছে অন্য কারও পক্ষে পৌঁছানো সহজ হচ্ছে না। আপনি পছন্দও করছেন না সেই গোলকে অন্য কারও উপস্থিতি। বরং অবসর সময়টুকু নিজের মতো কাটাতে ভালোবাসছেন। হয়তো ঘুরতে যাচ্ছেন কোথাও, হয়তো শুনছেন প্রিয় গান… এককথায়, মন যা চায় সেভাবেই উপভোগ করছেন সময়; অবশ্যই কাউকে বা কোনো কিছুকে জ্বালাতন না করে। ভাবছেন, যেহেতু অন্যদের কোনো ব্যাপারে নাক না গলিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে জীবন, তাই ভাবনা কী? না, ভাবনা আছে! এই আপনিই একসময় টের পারেন, নিজেকে সবকিছু ও সবার কাছ থেকে মনে মনে দূরে সরিয়ে নেওয়ার ফলে জনারণ্যের ভিড়ে হয়ে পড়েছেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ! বিচ্ছিন্নতাবোধ বাসা বেঁধেছে আপনার অন্তরমহলে। কারও সঙ্গে চাইলেও মিশতে পারছেন না ঠিকঠাক; আনমনেই সারাক্ষণ নিজেকে ‘একা, ভীষণ একা’ মনে হচ্ছে।
তিন
আভিধানিক সংজ্ঞায়, একজন মানুষ যখন তার চারপাশের পরিমণ্ডল ও মানুষগুলোর কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয় কিংবা একা হয়ে পড়ে, তখনই আবির্ভূত হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ। যার মনোজগতে এই বোধ বাসা বাঁধে। তিনি হরদমই নিজের প্রিয় মানুষদের পাশাপাশি সমাজের কাছ থেকেও মুখ ফিরিয়ে রাখেন। এ ছাড়া উপসর্গ হিসেবে তাদের মধ্যে দেখা মিলতে পারে দূরত্ববোধ ও বিচ্ছেদবোধ, যা শুধু অন্যদের প্রতিই নয়, বরং নিজের একান্ত আবেগগুলোর প্রশ্নেও। তাই বিচ্ছিন্নতাবোধকে একটি জটিল, অথচ চিরচেনা পরিস্থিতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এতে সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক—উভয় প্রভাবই পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচ্ছিন্নতাবোধগ্রস্ত মানুষ সচরাচর নিজেকে অসহায় মনে করেন। পৃথিবীকে তার কাছে শূন্য বা অর্থহীন মনে হয়। কোনো ধরনের আলাপচারিতা কিংবা অনুষ্ঠানে নিজেকে আগন্তুক ও অনাহূত মনে করেন, তাই এড়িয়ে চলেন। বাকি সবার কাছ থেকে আলাদা মনে করেন নিজেকে। অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের প্রশ্নে ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। অথচ আপাতনির্দোষ ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা করতে চেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে এসব পথে নিজেই নিজেকে ঠেলে দিয়েছেন যে! কেননা, অধিকাংশ মনোবিজ্ঞানীর মতে, ব্যক্তিস্বাধীনতার ভুল বা ভ্রান্ত উপলব্ধি থেকেই অনেক ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম।
চার
বিচ্ছিন্নতাবোধের বিষক্রিয়া বুঝতে দুটি উদ্ধৃতির দ্বারস্থ হওয়া যাক। প্রথমটি আমেরিকান রাজনীতিক মার্টিন লুথার কিংয়ের। তিনি বলেছেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবোধ হলো জীবন্ত লাশ হয়ে যাওয়ার একটি ছাঁচ। এটি নৈরাশ্যের এমনই এক অ্যাসিড, যা সমাজকে গলিয়ে ফেলে।’ অন্যদিকে, তার স্বদেশি কণ্ঠশিল্পী, ‘কিং অব পপ’খ্যাত মাইকেল জ্যাকসনের ভাষ্যে, ‘নিজেদের বিক্ষত পৃথিবীকে আমাদেরই সারিয়ে তুলতে হবে। পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা, নৈরাশ্য এবং নিরর্থক বিনাশের যে চিত্র আমরা আজ দেখি, তা মানুষ পরস্পরের এবং নিজেদের পরিবেশ-পরিমণ্ডলের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা অনুভব করায় সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতাবোধেরই ফল।’
পাঁচ
চাইলেও ব্যক্তিস্বাধীনতার চর্চা করা সবার পক্ষে সম্ভব হয় না; যদিও তা কম-বেশি সকলেরই আরাধ্য। উল্টো দিকে, যেকোনো জীবনবোধই যথার্থভাবে উপলব্ধি না করে, অগভীর বোঝাপড়া থেকে সামলাতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। তাই ব্যক্তিস্বাধীনতার বিভ্রান্ত চর্চা যেন আপনার জীবনে ছড়িয়ে না দেয় বিচ্ছিন্নতাবোধের বিষ—সচেতন থাকুন।
কারও বা কোনো কিছুর, এমনকি নিজের প্রতিও যেকোনো ধরনের হানিকর প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে উপভোগ করুন ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ। বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে ঘটুক মুক্তি।