পাতে পরিমিতি I বর্ষায় সুস্থতা
ঋতু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস মানিয়ে নেওয়া চাই। অন্যথায় বাড়বে বিপদের শঙ্কা। রইল নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
বর্ষা। গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষে ঝরো ঝরো বৃষ্টির দিন। শ্রীকান্তের গুনগুনে গান, হাতে এক কাপ চা আর টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। যখন আকাশ থেকে ঝরে পড়ে বৃষ্টির ছোট ছোট কণা, তখন অনেকে আনমনে ভুলে যান, প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনও জরুরি। আর এই ভুলে যাওয়া থেকেই শরীরে বাসা বাঁধতে পারে নানা জটিলতা।
ডায়েট হতে পারে রোগ নিয়ন্ত্রণের, রোগ প্রতিরোধের, এমনকি ওজন কমানো বা বাড়ানোর জন্য। ঋতুভিত্তিক খাদ্যব্যবস্থাপনা কেমন হবে, তার জন্যও ডায়েট তৈরি করা যেতে পারে।
গ্রীষ্ম শেষে বর্ষাকাল শুরু হতেই তীব্র গরম থেকে কিছুটা ঠান্ডা আবহাওয়ার দেখা মেলে। তাতে হালকা জ্বর, খুসখুসে কাশি, গায়ে ব্যথা, শরীর ম্যাজম্যাজ করা, ঝিমুনি ভাব, চুল পড়াসহ বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা হানা দিতে পারে। যাদের আগে থেকে শারীরিক জটিলতা থাকে, তাদের সেই সমস্যাগুলোও অনেক সময় ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। তাই সুস্থ থাকতে খাদ্যতালিকায় যা রাখতে পারেন:
রসুন: যাদের সারা বছর জ্বর, ঠান্ডা-কাশির প্রবণতা থাকে, ধরেই নেওয়া যায়, তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম। সেই ক্ষমতা আরও কমে যেতে পারে দাবদাহ থেকে বারিধারায় ঋতুবদলের বৈচিত্র্যের কারণে। তাই এ সময় রান্নায় নিয়মিত রাখতে পারেন রসুন। অথবা প্রতিদিন এক থেকে দুই কোয়া রসুন খেতে পারেন।
মেথি: বর্ষায় চারপাশ যেহেতু পানিতে সয়লাব থাকে, তাই অনেকের মধ্যেই পানি পানের প্রবণতা কমে যায়। তবে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যকর পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে তা সামাল দেওয়া সম্ভব। মেথির পানি এ ক্ষেত্রে ভীষণ কাজের। এটি রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানো, হজম শক্তি ভালো রাখা, মলত্যাগজনিত সমস্যা দূর করার পাশাপাশি নানা রকম ইনফেকশন থেকেও মুক্তি দিতে সাহায্য করে। তাই সকালে পানের জন্য অনুসরণ করতে পারেন এই রেসিপি:
ভালোভাবে পরিষ্কার করা ২ টেবিল চামচ মেথি ৫০০ মিলিলিটার পানিতে সারা রাত ভিজিয়ে রাখুন। সকালে মেথি থেকে বেরিয়ে আসা রস পুরো পানিকে হলুদাভ করে তুলবে। এই পানীয় অল্প অল্প করে সারা দিন গ্রহণের মাধ্যমে শারীরিক নানা জটিলতা দূর করা সম্ভব। তবে কিডনি কিংবা বিশেষ কোনো শারীরিক সমস্যা থাকলে এ ধরনের পানীয় বর্জন করাই শ্রেয়। পরামর্শ নিতে পারেন বিশেষজ্ঞের।
কুসুম গরম পানি: শীতকাল বাদে সারা বছরই আমাদের দেশে গরমের আধিক্য থাকে; কখনো বেশি, কখনো কম। বর্ষাকালে কখনো সারা দিন বৃষ্টি হলে একটু গরম কাপড় পরার প্রয়োজন পড়ে। যাদের কোল্ড সেনসিটিভিটি রয়েছে, তারা এ সময় নিজের বাড়তি যত্ন না নিলে পড়তে পারেন নানা রকম শারীরিক জটিলতায়। এ ক্ষেত্রে দিনের বাকি সময়টায় একটু স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি গ্রহণ করলেও আর্লি মর্নিং বা সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস কুসুম গরম পানি পান করতে পারেন। তাতে গলা খুসখুস, হাঁচি-কাশি, গলাব্যথাসহ বিভিন্ন সমস্যা কেটে যাবে।
বর্ষাকালে কাঁচাবাজার করার ক্ষেত্রেও বাড়তি সতর্কতা গ্রহণ করা ভালো। প্রচণ্ড বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাজার করতে বেরিয়ে যাওয়ার ঝোঁক রয়েছে অনেকের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে মনে রাখা চাই, বিশেষ করে পানিবাহিত জীবাণুগুলোর বংশবিস্তারের জন্য বৃষ্টি খুবই উপযোগী উপলক্ষ। বাজারে থাকা শাকসবজি জীবাণুমুক্ত কি না, কেনার সময় যথাসম্ভব খেয়াল রাখুন। বাজার ছাড়াও রাস্তার পাশে ভ্যানে করে কিংবা মোড়ে মোড়ে ঝুড়িতে নিয়ে শাকসবজি বিক্রি হয়। বর্ষাকালে বিশেষত যখন বাইরে বৃষ্টি, সেই শাকসবজিগুলোকে তখন যথাযথভাবে ঢেকে রাখা না হলে অনেক সময় বাড়ির ছাদের পানি, টিনের চালের পানি, জমানো পানি সেগুলোর ওপর পড়তে থাকে। যাদের বৃষ্টির দিনেও সবজি কিনতে বাইরে যাওয়া প্রয়োজন, তারা যদি এই ধরনের শাকসবজি বাসায় এনে সঠিকভাবে পরিষ্কার ও রান্না না করেন, তাহলে তৈরি হতে পারে বিভিন্ন রোগবালাই। তাই পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা একটু দুরূহ বলেই বর্ষায় শাক খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা অনেক সময় নিরুৎসাহিত করেন।
ডায়াবেটিসসহ নানা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য তেতো খাবারের কদর সব সময়ই রয়েছে। করলা হলে তো কথাই নেই! বর্ষায় সবুজ করলার চাহিদা একটু বেশি। এ সময় যেহেতু এ ধরনের সবজি কম-বেশি সব জায়গায় পাওয়া যায়, তাই খাদ্যতালিকায় করলার পাতলা ঝোল হতে পারে সেরা রেসিপি।
এ সময়ে জমানো পানির প্রতিও রাখা চাই বাড়তি খেয়াল। ফুলের টব, ভাঙা বোতল কিংবা পড়ে থাকা কোনো কৌটায় বৃষ্টির পানি জমে থাকলে অ্যাডিস মশার ডিম পাড়ার সুযোগ বাড়ে। ফলে বাড়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি। তাই চারপাশ যথাসম্ভব পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করুন।
অতিরিক্ত গরমে যেমন ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ে, বর্ষায়ও এ রোগের বেশ দাপট দেখা যায়। চারপাশ স্যাঁতসেঁতে থাকার এ সময়ে বাইরের খোলা খাবার, পানি ইত্যাদি যতটা সম্ভব গ্রহণ না করাই ভালো। একান্ত প্রয়োজনে গ্রহণ করতে হলে নেওয়া চাই বাড়তি সতর্কতা। তবে যেসব খাবার এড়িয়ে যেতে পারেন:
ফলের জুস: অনেকের অভ্যাস থাকে রাস্তাঘাটে ফলের জুস গ্রহণ করার। মনে রাখা চাই, পানিবাহিত রোগগুলো এ ধরনের খাবার থেকে ছড়াতে পারে সবচেয়ে বেশি। তাই সুস্থ থাকতে হলে এ সময়ে বাইরের ফলের জুস কিংবা শরবত গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকাই ভালো।
ভাজাপোড়া: বৃষ্টি হলেই একটু ভাজাপোড়া খাবার চেখে দেখার লোভ অনেকে সামলাতে পারেন না। তবে বাইরে খোলা অবস্থায় তৈরি করা এ ধরনের খাবার থেকে সাবধান! এসব বিক্রির দোকানগুলোতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওপরে শুধু পলিথিনের শামিয়ানা কিংবা কিছুটা বেড়ার প্রটেকশন নেওয়া থাকে বলে বৃষ্টি হলেই খাবারগুলোর ওপর বৃষ্টির ঝাপটা আসার, এমনকি পাশের ড্রেন বা ময়লার কোনো বিন থাকলে সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসা মাছি-পোকা খাবারে বসার সুযোগ পায়, যা ডায়রিয়াসহ নানা রোগ ডেকে আনতে পারে।
আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক পরিবর্তন ঘটার প্রবণতারও দেখা মেলে বেশ। সে ক্ষেত্রে বর্ষাকালে খেতে পারেন ভিন্ন ভিন্ন রেসিপির খাবার। রাখতে পারেন খিচুড়ির বিশেষ রেসিপি। চাল ও ডালের সংমিশ্রণে পাকানো হয় আমাদের চিরচেনা এই দারুণ সুস্বাদু ও পুষ্টিকর খাবার। এটি পাতলা, ভুনা এবং মাঝারি ঘন করে তৈরি করা যায়। অনেকে খিচুড়ির সঙ্গে নানা রকম সবজি, চিকেন, এমনকি আচার যোগ করতেও পছন্দ করেন। ঝটপট তৈরি করে নিতে অনুসরণ করতে পারেন এই রেসিপি:
উপকরণ: চাল, ডাল, মিক্সড সবজি (আলু, গাজর, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, মটরশুঁটি, চিচিঙ্গা), মুরগির মাংস, পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ, জলপাই কিংবা কাঁচা আম, তেল ও ঘি।
রান্নার প্রক্রিয়া: পরিমাণমতো তেলে পেঁয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ ভেজে নিন। এরপর ধুয়ে রাখা চাল ও ডাল থেকে পানি একটু ঝরিয়ে নিয়ে লবণ, হলুদ আর মরিচগুঁড়া দিয়ে হালকা ভেজে নিন। এবার সবজি ও চিকেনগুলো যোগ করুন। খুব কড়া করে ভাজা যাবে না; সব কটি হালকা করে ভাজতে হবে। ভাজা মোটামুটি হয়ে গেলে পরিমাণমতো পানি যোগ করুন। পাতলা নাকি ভুনা—কোন খিচুড়ি তৈরি করতে চান, তা মাথায় রেখেই পানির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। রান্না শেষ হওয়ার কিছুটা সময় হাতে রেখেই, নিজের পছন্দমতো জলপাই কিংবা কাঁচা আম যোগ করতে পারেন এই খিচুড়িতে। রান্না সম্পন্ন হওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে, চুলার আঁচ একদম কমিয়ে, ঘি যোগ করে কিছুক্ষণ পর চুলা থেকে নামিয়ে ফেলুন। বাইরে যখন টুপটাপ বৃষ্টি, তখন গরম-গরম খিচুড়ি, সঙ্গে ডিম কিংবা ইলিশ ভাজা—আর কী লাগে!
বর্ষাকালে একটু সতর্ক আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকলে ঋতুটাকে উপভোগ করা সহজ হয়ে যাবে। তাই চারপাশ পরিষ্কার রাখুন, ভালো খাওয়াদাওয়ার সঙ্গে রিমঝিম বৃষ্টি উপভোগ করুন।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট