টেকসহি I স্মার্ট টেক্সটাইল
পোশাকেরও আছে সংবেদনবোধ আর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা! এখনো জনসাধারণের হাতের নাগালে না এলেও, সহসাই মিলবে এর পরিষেবা
সূর্যের প্রখর তাপ থেকে ত্বক সুরক্ষায় অতিবেগুনি রশ্মি (ইউভি) প্রতিরোধী সানস্ক্রিন ক্রিমের কথা অনেকে জানি; কিন্তু এমন কোনো পোশাক কি আছে, যা সানস্ক্রিন ক্রিমের মতো দেহকে ইউভি থেকে সুরক্ষা দিতে পারে? বলছিলাম ইউভি প্রোটেকটিভ পোশাকের কথা। প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছে, মানুষের জীবনধারণের সকল অনুষঙ্গেই অভিনব পরিবর্তন আসছে। এ ধারার সঙ্গে মিল রেখেই স্মার্ট টেক্সটাইলের উদ্ভব। স্মার্ট ম্যাটেরিয়াল শব্দযুগল প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৮৯ সালে, জাপানে। আর স্মার্ট টেক্সটাইল হিসেবে লেবেলকৃত প্রথম টেক্সটাইল পণ্য মেমোরি এফেক্ট সমৃদ্ধ সিল্ক তন্তু। এর আগে ১৯৬০-এর দশকে শেপ মেমোরি ম্যাটেরিয়ালের আবিষ্কার ও পরের দশকে ইন্টেলিজেন্ট পলিমারিক জেল উদ্ভাবনকেই মূলত স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালের গোড়াপত্তন হিসেবে ধরা হয়। স্মার্ট টেক্সটাইল বলতে বর্তমানে আমরা যা বুঝি, তার কার্যকারিতা আগের তুলনায় অনেক জটিল। এ ধরনের কাপড়কে ‘পরিধানযোগ্য কম্পিউটার’ হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয় অনেক সময়।
স্মার্ট বা ইলেকট্রনিক টেক্সটাইল শব্দযুগল মূলত নানাজনে নানাভাবে ব্যবহার করে থাকে; যেমন স্মার্ট ক্লোদিং, হাই-টেক স্মার্ট টেক্সটাইল, স্মার্ট ফ্যাব্রিক, ইন্টেলিজেন্ট ফ্যাব্রিক, ওয়্যারেবল বা পরিধেয় ইলেকট্রনিক। এগুলোর মধ্যে সামান্য কিছু ভিন্নতা থাকলেও একটি বিষয় কমন; আর তা হলো টেক্সটাইলগুলোর মধ্যে কিংবা এর সঙ্গে অল্প পরিমাণে হলেও ইলেকট্রনিক উপাদান মিশ্রিত থাকে। স্মার্ট বা ই-টেক্সটাইল হলো এমন ধরনের কাপড়, যাতে পাতলা, নমনীয় এবং স্বচ্ছ জাতের সেন্সর, অ্যাকচুয়েটর, এমনকি ন্যানোজেনারেটর এম্বেড করা থাকে। হাতে থাকা মুঠোফোনের সঙ্গেও অনেক সময় সংযোগ থাকে এ ধরনের কাপড়গুলোর। এককথায়, স্মার্ট টেক্সটাইল হলো এমন সব উপাদান, যা পরিবেশগত অবস্থা বা উদ্দীপনাকে অনুভব করতে এবং সে অনুযায়ী যান্ত্রিক, তাপীয়, রাসায়নিক, বৈদ্যুতিক, চৌম্বকীয় অনুভূতির প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম।
স্মার্ট টেক্সটাইলের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ পোশাকের নমনীয়তা, ব্যবহারকারীর স্বাচ্ছন্দ্য এবং ইলেকট্রনিক উপাদানগুলোকে ক্ষুদ্রকরণ ও ফ্যাশনেবল করে তোলা। এ কাজের জন্য গবেষকেরা ন্যানোম্যাটেরিয়াল, পলিমার, ডাইলেকট্রিক ইলাস্টোমার এবং কম্পোজিটের মতো বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেন। ন্যানোটেকনোলজির ব্যবহার যদিও নতুন নয়, তবে টেক্সটাইল ও টেকনোলজির মিশেলের বিষয়টি খুবই সাম্প্রতিক। প্যানাসনিক, কোভেস্ট্রো, ডুপয়েন্টের মতো কোম্পানিগুলো একদিকে যেমন স্মার্ট টেক্সটাইলের জন্য নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে আসছে, তেমনি গবেষকেরা নমনীয় ব্যাটারি, গ্রাফিন সুপারক্যাপাসিটরের মতো সেন্সিং এবং এনার্জি স্টোরেজ সমৃদ্ধ প্রযুক্তি তৈরির সন্ধান দিচ্ছেন। নতুন উদ্ভাবিত এসব প্রযুক্তি স্মার্ট টেক্সটাইলকে নিয়ে যাবে অনন্য উচ্চতায়, এমনটা আশা করাই যায়। বলে রাখা ভালো, গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ইন্টেলিজেন্ট টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালগুলোর বাজারজাত শুরু হয়। এরপর থেকে বিশ্বব্যাপী স্মার্ট টেক্সটাইলের বাজার কেবল প্রসারিতই হচ্ছে। সাধারণ কাপড়ের তুলনায় ই-টেক্সটাইল বাজারের অনুপাত মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাড়ছে।
স্মার্ট টেক্সটাইলের ধরনেও রয়েছে রকমভেদ। প্রধানত নান্দনিকতা ও কর্মক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে এদের আলাদা করা হয়। নান্দনিক স্মার্ট টেক্সটাইল বিশেষ করে পোশাকে আলো জ্বালানো এবং রং পরিবর্তন করার ক্ষমতার কারণে ফ্যাশন শিল্পে বেশ জনপ্রিয়। উজ্জ্বল আলো নির্গত করা পোশাক ও গাউন বরাবরই ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবে দাপটের সঙ্গে জায়গা করে নিয়েছে। কর্মক্ষমতার দিক দিয়ে স্মার্ট টেক্সটাইল আবার তিন ধরনের—প্যাসিভ, অ্যাকটিভ ও আলট্রা স্মার্ট ফ্যাব্রিক। প্যাসিভ ইন্টেলিজেন্ট টেক্সটাইল হলো প্রাথমিক প্রজন্মের স্মার্ট টেক্সটাইল, যা মূলত বাহ্যিক পরিস্থিতি যেমন অতিবেগুনি রশ্মি প্রতিরক্ষামূলক পোশাক, কন্ডাকটিভ ফাইবার ইত্যাদি সমৃদ্ধ থাকে। শুধু সেন্সর দিয়েই এসব কাজ সম্ভব বলে প্যাসিভ স্মার্ট টেক্সটাইল শুধুই পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে পারে। প্যাসিভ স্মার্ট কাপড়কে কখনো কখনো ইন্টেলিজেন্ট টেক্সটাইলের প্রথম প্রজন্ম হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। তবে এগুলোর কার্যকারিতা প্রথম প্রজন্মের প্রযুক্তির চেয়েও উন্নত মানের। পরিবেশগত পরিবর্তন শনাক্ত করতে পারলেও সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না এ ধরনের কাপড়। যেমন একটি কুলিং ফ্যাব্রিক শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, কিন্তু সক্রিয়ভাবে শীতলতা তৈরি করতে পারে না। ফ্যাব্রিকের গঠনের কারণে এটি কেবল দ্রুততম সময়ে দেহের ঘাম বাষ্পীভবনে সাহায্য করতে পারে। একই ধরনের ঘটনা ঘটে ইউভি সুরক্ষা, অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-স্ট্যাটিক ফিচারযুক্ত পোশাকের বেলায়ও।
এরপর আসে অ্যাকটিভ ফ্যাব্রিক। অ্যাকটিভ স্মার্ট টেক্সটাইলের বিশেষত্ব হচ্ছে, এগুলো বাহ্যিক পরিবেশ কিংবা মানুষের ইনপুট পেলে সেভাবেই নিজেদের সক্রিয় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। যেমন পরিধানকারীর গতি বা তার আশপাশের আবহাওয়ার পরিবর্তন হলে ফ্যাব্রিকেও বদল আসে। এ ধরনের কাপড় নিজ নিজ আকৃতি পরিবর্তন, তাপ সঞ্চয় ও নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি অন্যান্য কাজও করতে পারে। যদিও প্যাসিভ টেক্সটাইল এগুলোর গঠনের ওপর নির্ভরশীল; অ্যাকটিভ ফ্যাব্রিক অ্যাকচুয়েটর ও সেন্সরের জন্য বিদ্যুতের সাহায্য নেয়। এই অ্যাকচুয়েটর ও সেন্সরগুলো ফ্যাব্রিকের ইন্টেলিজেন্ট ম্যাটেরিয়ালগুলোতে উদ্দীপনা পৌঁছে দেয়; ফলে কাপড়গুলো আশপাশের ডেটা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করতে পারে।
স্মার্ট টেক্সটাইল জগতে সর্বশেষ ও সবচেয়ে আধুনিক সংযোজন আলট্রা স্মার্ট ফ্যাব্রিক। এগুলো অ্যাকটিভ স্মার্ট টেক্সটাইলের মতো একইভাবে পরিবেশগত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে, প্রতিক্রিয়া জানায় এবং সে অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। তবে এ ক্ষেত্রে এগুলো আরও একধাপ এগিয়ে। আলট্রা স্মার্ট টেক্সটাইল এমন এক উপকরণ, যা উদ্দীপনা কিংবা পরিবেশগত অবস্থা যেমন তাপ, যান্ত্রিক, রাসায়নিক, চৌম্বক বা অন্যান্য উৎস শনাক্ত করে, প্রতিক্রিয়া দেখায়, নিরীক্ষণ করে এবং সে অনুযায়ী অভিযোজিত হয়! আলট্রা স্মার্ট টেক্সটাইল এমন ইউনিট নিয়ে গঠিত, যা মানব মস্তিষ্কের অনুরূপ কাজ করতে সক্ষম।
এবার দেখা যাক বাস্তব জীবনে কর্মক্ষেত্রে স্মার্ট টেক্সটাইলের ব্যবহার। ফায়ার ফাইটার ও উদ্ধারকর্মীদের মতো জরুরি সহায়তা কাজে নিয়োজিতদের জন্য ব্যাপক উপকারী স্মার্ট টেক্সটাইল। যেমন কন্টিনিউয়াস মনিটরিং অব লাইফ সায়েন্সেস প্রযুক্তি ব্যবহার করে শ্বাস-প্রশ্বাস ট্র্যাক করার পাশাপাশি হৃদপিণ্ডের সংকোচন-প্রসারণ ট্র্যাক করা যায়। কন্টিনিউয়াস মনিটরিং বায়োসেন্সর দিয়ে ঘাম, পানিশূন্যতা, স্ট্রেস শনাক্ত করা যায়। অনুরূপ প্রতিরক্ষামূলক স্মার্ট টেক্সটাইল অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন স্বাস্থ্যসেবা, ভবন নির্মাণের শ্রমিক ও পরিবহনের রক্ষণাবেক্ষণে কর্মরতদের বেলায় ব্যবহার করা যায়। এমনকি এ ধরনের প্রযুক্তির গোড়ার দিককার ব্যবহারকারীদের মধ্যে রয়েছেন সামরিক বাহিনীর সদস্যরা।
বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে এমন কিছু স্মার্ট টেক্সটাইলের মধ্যে রয়েছে লিভাইসের কমিউটার ট্র্যাকার জ্যাকেট। টেক জায়ান্ট গুগলের প্রজেক্ট জ্যাকোয়ার্ড লঞ্চ করে এটি। এই জ্যাকেটের হাতায় স্পর্শ এবং অঙ্গভঙ্গি-সংবেদনশীল কিছু প্রান্ত রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা মিউজিক অ্যাপের মতো বিভিন্ন পরিষেবার কাজ করতে পারেন হাতের ইশারায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে পকেট থেকে ফোন বের না করেই কল রিসিভ করা সম্ভব! স্মার্ট টেক্সটাইলের আরেক চমক নাইকির অ্যাডাপ্ট। এটি এমন এক লেসিং সিস্টেমের জুতা, যা ইলেকট্রনিকভাবে পায়ের আকৃতি অনুযায়ী নিজের আকৃতি পরিবর্তন করে। এমনকি হাতের স্মার্টফোন ব্যবহার করেই নাইকির এ জুতাগুলোর আকৃতি পরিবর্তন করা সম্ভব সহজে। স্মার্ট টেক্সটাইলের আরেকটি উদাহরণ স্যামসাং এনএফসি স্যুট। স্যামসাং তাদের বডি কম্পাস ওয়ার্কআউট শার্ট চালু করে স্মার্ট টেক্সটাইল জগতে পা রেখেছে। এই শার্ট মূলত বায়োমেট্রিক ডেটা নিরীক্ষণ করে।
স্মার্ট টেক্সটাইলের পণ্যগুলো এখনো সর্বসাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলেও শিগগির যে নিত্যপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ হয়ে উঠবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। টেক্সটাইল শিল্প ও প্রযুক্তির বাজারে যে অভিনব জোয়ার আসতে চলেছে, সে জোয়ারে টিকে থাকতে হলে তাই নিজেদেরও হতে হবে স্মার্ট ও ট্রেন্ডি।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট