সঙ্গানুষঙ্গ I বো এরা
ইতিহাসের অলিগলি পেরিয়ে ফ্যাশনে আবারও বো-এর দাপট নতুনভাবে করে নিচ্ছে জায়গা। ভবিষ্যৎ রানি থেকে শুরু করে সোশ্যাল মিডিয়া তারকা হয়ে সাধারণ ফ্যাশনিস্তাদের চুলে
বো হচ্ছে রশি, কাপড় কিংবা ফিতা দিয়ে করা একধরনের বাঁধন, যেটা টাই, চুলের ফিতা, উপহারসামগ্রী, জুতার ফিতা বাঁধার কাজে দেখতে পাই। ফুলের মতন দেখতে এই নট বা বাঁধনটি যতটা সহজ বাঁধা, তার চেয়ে অধিক সহজ খুলে ফেলা। তা ছাড়া বো-এর দৃষ্টিনন্দনের জন্য ফ্যাশনেও তার প্রচলনের দেখা মেলে সভ্যতার শুরু থেকে। মেট্রোপলিটন আর্ট মিউজিয়ামে সুমেরীয় সভ্যতার চুলসজ্জায় ব্যবহৃত কিছু সোনার তৈরি রিবন বা ফিতা রাখা আছে। সাভানা কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনের একজন প্রফেসর ফ্যাশন ম্যাগাজিন হারপার’স বাজারকে জানান, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ২৬০০ অব্দে তৈরি এই ফিতাগুলো চুলের শোভাবর্ধনে বো-এর মতো করেই বাঁধা হতো।
আমরা অনেকেই ছোটবেলায় ভীষণ সহজ গিঁটটি বাঁধা শিখেছিলাম বানি নট কিংবা খরগোশের কান হিসেবে। বো কে কিন্তু ‘লাভ লক’ও বলা হয়। বেণি করা চুলের শেষ প্রান্তে এসে ফিতা দিয়ে বো বাঁধা হতো এবং বেণিটি পড়ে থাকত বুকের কাছাকাছি। তাই এর নাম হয়ে যায় লাভ লক। একটা সময়ে বো হয়ে যায় প্রেমের প্রতীক! হার্ট শেপের সঙ্গেও কিছুটা মিল থাকায় প্রেমিক-প্রেমিকারা উপহার বিনিময়ে ভালোবাসার চিহ্ন হিসেবে বো ব্যবহার শুরু করেন। যেকোনো ফরমাল অনুষ্ঠানে, বিয়েতে, ডিনার ড্রেসে পুরুষদের বো টাই এবং মেয়েদের বো হেয়ার করতে দেখা যায় হরদম।
আধুনিক ফ্যাশনে বো-এর সূত্রপাত মূলত ফ্রান্সে। ১৭০০ সালের গোড়ার দিকে পুরুষেরা প্রথম তাদের লম্বা চুলে রেশমের ফিতা ব্যবহার শুরু করেন। প্রথম দিকে শুধু সম্ভ্রান্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতাব্দীর দিকে একদিন রাজা চতুর্দশ লুই তার প্রিয় সভাসদদের নিয়ে ঘোড়ায় চড়ে প্রমোদভ্রমণে যাচ্ছিলেন। পথে রাজার মিস্ট্রেস, মার্কুইস দে ফন্টজের হ্যাট উড়ে গিয়ে চুল খুলে যায়। ঘোড়া চালানোয় অসুবিধে হচ্ছিল দেখে মিস্ট্রেস তার পোশাক থেকে ফিতে খুলে বো নটে চুল বেঁধে ফেলেন। তার সোনালি চুলে ফুলের কারুকাজ করা ফিতে দেখে সঙ্গে থাকা সবাই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। সেই থেকে নারীদের চুলসজ্জার ফ্যাশনেও যুক্ত হয়ে যায় বো স্টাইল। এমনকি রানি মেরি অ্যান্টনি বছরে প্রায় ২০ হাজার ফ্রাঁ খরচ করতেন শুধু চুলের ফিতা কিনতে!
উনিশ শতকের শেষের দিকে হ্যাটের ফ্যাশন শুরু হলে তাতেও বো স্টাইল জায়গা করে নেয়। বিভিন্ন ধরনের হ্যাটে রেশমের বো হয়ে ওঠে স্টাইল স্টেটমেন্ট। ১৯২০ থেকে ১৯৩০ সালে বো হয়ে ওঠে ফ্যাশনে অনবদ্য স্টাইল, যখন ক্যাথরিন হেপবার্নের মতো তারকা তার পোশাকে বো ব্যবহার করেন। রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বো স্টাইল। একে একে মারলিন ডিট্রেস, বেটি ডেভিসসহ জনপ্রিয় তারকারা তাদের পোশাকে বো-এর ব্যবহার শুরু করেন। ১৯২৭ সালে তখনকার বিখ্যাত তারকা ডিজাইনার এলসা স্কিইয়াপারেলি উইন্টার কালেকশনের নেকলাইনে রাখেন বো এবং ফ্যাশনপ্রেমীদের কাছে রীতিমতো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সে সময় বো নেক।
মাঝখানের কয়েক দশক বো স্টাইল কেবল মডেস্টি এবং ফরমাল কিছু অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থাকলেও আশির দশকে আবার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠে আসে, যখন পপতারকা ম্যাডোনা এবং বয় জর্জ মাথায় বো ব্যান্ড পরে ক্যামেরার সামনে আসেন। মূলত তাদের উদ্দেশ্য ছিল উইমেন পাওয়ারকে শো করা। পপ কালচারে মেয়েদের শক্তিকে উজ্জীবিত করতে তাদের এই ফটোশ্যুট সাড়া ফেলে পুরো পৃথিবীতে। একই সঙ্গে কোমলতা ও শক্তির প্রকাশ ঘটাতে ম্যাডোনা বো ব্যান্ডটি ব্যবহার করেন।
নব্বইয়ের দশকেও পোশাকে, চুলে ও জুতায় বো-এর ব্যবহার ছিল ব্যাপক। সিনেমা ও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে তা যেন চমৎকার যুগলবন্দী ছিল। ১৯৯৫ সালে শ্যানেল তার বো কালেকশন লঞ্চ করে, যা ফ্যাশনিস্তারা লুফে নেন। রমকম থেকে রেগুলার লাইফে বো হয়ে ওঠে তুমুল জনপ্রিয়। আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ১৯৪২ সালে ওয়েস্টিং হাউস ইলেকট্রিক কোম্পানি নারীদের প্রোডাকশন সেক্টরে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে পত্রিকায়। মিলার নামে একজন ব্যক্তি পোস্টারটির ডিজাইন করেছিলেন, যেখানে দেখানো হয় একজন নারী নিজের পেশিশক্তি দেখাচ্ছেন আর তার চুল মাথার ওপরে ফিতা দিয়ে বো করে বাঁধা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই পোস্টার নারীদের বিপুল উৎসাহ জুগিয়েছে পুরুষদের পাশাপাশি কাজ করার ব্যাপারে। নারীর সৌন্দর্য তার শক্তিতে রূপান্তর করার প্রেরণা জুগিয়েছে বিজ্ঞাপনটি।
শুধু চুলসজ্জা, জুতা কিংবা পোশাকেই নয়, বিভিন্ন অ্যাকসেসরিজ যেমন কানের দুল, গলার চোকার বা নেকলেস, হাতঘড়ি বা ব্রেসলেটেও বো ডিজাইন জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি গৃহসজ্জার আয়োজনেও আমরা বো ডিজাইন দেখতে পাই এখন।
বাচ্চাদের মাঝেও ভীষণ জনপ্রিয় বো অ্যাকসেসরিজ। মিকি মাউস কিংবা সিনড্রেলা দেখে অভ্যস্ত বাচ্চাদের কাছে নিজেদের পোশাক, জুতা কিংবা চুলের ক্লিপে বো সবচেয়ে প্রিয়। বর্তমান সময়ে এসে কার্টুন চরিত্রগুলো ফ্যাশনে বেশ প্রভাব ফেলেছে। জিবলি ক্যারেক্টার কিংবা ডিজনি প্রিন্সেসদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বো ট্রেন্ড সামনে চলে এসেছে আবার দশক ঘুরে।
চলতি বছরে আমরা মূলত বো ট্রেন্ড বেশ জোরেশোরেই ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখছি। ব্রিটিশ পরিবারের ভবিষ্যৎ রানি, ডাচেস অব কেমব্রিজ কেট মিডলটন, মারগেট রবি, নিকোল কিডম্যানদের মতো জনপ্রিয় তারকারা প্রায়শই চুলে বো পরছেন। এ ছাড়া পপতারকা আরিয়ানা গ্র্যান্ডে কিংবা আমেরিকান মডেল হেইলি বিবারের মতো তারকাদের দেখা গেছে চুলে বো পরতে। মেট গালা ২০২৩-এ গ্লোবাল ফ্যাশন আইকন প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার বো ড্রেস সবার নজর কেড়েছে। এ ছাড়া পোশাকে জেনি রুবি, নিকোলা বেকহামদের বো ব্যবহারও নজর কেড়েছে অনেকের। তবে প্রথমবারের মতো মেট গালায় আমন্ত্রিত আলিয়া ভাটের চুলে পার্লের বো ব্যবহার করার আইডিয়া ছিল ভীষণ প্রশংসনীয়, রূপকথার রাজকুমারী যেন নেমে এসেছিল লালগালিচায়! এ ছাড়া জনপ্রিয় সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে ভীষণ ট্রেন্ডি হয়ে উঠেছে বো ক্লিপ কিংবা বো রিবন। তাই যদি বলা হয় যুগটা এখন ‘বো’-এর, তাহলে কি ভুল বলা হবে?
নাঈমা তাসনিম
ছবি: ইন্টারনেট