skip to Main Content

মনোযতন I অ্যাগোরাফোবিয়া

বিশেষ মনোব্যাধি। কোনো পরিস্থিতি বা স্থানের ভয়, যেখানে বিব্রত, ভীতি কিংবা অসহায় বোধ কাবু করে। সেরে ওঠার পথ দেখাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা
গল্প-উপন্যাস পড়ে জোছনা রাতের প্রতি অন্য রকম ভালো লাগা জন্মেছে আপনার। কিন্তু আজ রাতে আকাশের কোথাও চাঁদের চিহ্ন নেই। তবু আকাশ টানছে লাটাইয়ের মতো। মায়ার বাঁধনে জড়াচ্ছে আপনাকে। অন্ধকারকে মনের পুঁজি বানিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে চলেছেন জানালার দিকে। রেলিং ধরে তাকিয়েছেন দূর আকাশে, মিটিমিটি জ্বলা তারাদের পানে। রাজ্যের সব অন্ধকার কেটেকুটে খেয়ে নিচ্ছে মায়াবী চোখ। কিছুক্ষণ তাকানোর পর তারাদের দূরের নয়, একান্ত কাছের মনে হচ্ছে। আকাশ আর জোনাক পোকার মতো জ্বলা তারাগুলো আপনাকে নিজের করে নিচ্ছে। রাডারের মতো কাছে টানছে! পৃথিবীর কেউ পাশে নেই। আছে তারা। আছে আকাশ। আর আছে ‘আরেকটি আপনি’!
ভেতরে এই যে আরেকটি আপনার বসবাস, তা বুঝতে পারেন শুধু এই অলৌকিক ঘাম দেওয়া রাতে। যে রাতে একান্ত নিজের সঙ্গে বসবাস করেন। সঙ্গী হয় প্রচণ্ড গরম। ঘামে ভেজা নেতানো শরীর ভেতরের এই আরেকটি আপনাকে হতাশা ও ক্লান্তির পিঠে করে টেনে নিয়ে যায় স্বপ্নের প্রান্তরে; নিরাপদ ও সুনিশ্চিত আগামীর দিকে। কিন্তু মাঝেমধ্যে বেঁকেও বসে। তখন আরেকটি আপনাকে চিনতে পারেন না। খুব ভয় পায় সে। শুধুই ভাবে, এই রাতে আকাশে তারা না থাকলে কী হতো? কিংবা অফিস থেকে দেওয়া কাজের ডেডলাইন পেরিয়ে গেলে কী হবে? কিংবা পদোন্নতির পরীক্ষায় ফেল করলে? অথবা ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে না পারলে? এই কী হলে কী হবে ভয়েই ‘আরেকটি আপনি’ বাঁচতে ভুলে যাচ্ছে। সারা দিন ভয় তাড়া করে তাকে। ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলেও ভাবে, এটা হলে কী হবে, ওটা হলে? এই যে একধরনের ভয় গ্রাস করে নিচ্ছে তাকে কিংবা আপনাকে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে অ্যাগোরাফোবিয়া।
প্রকার ও প্রভাব
এই ভয় আপনাকে মূলত পাঁচভাবে তাড়া করতে পারে—
 যানবাহনে ওঠার ভয়;
 খোলা জায়গায় থাকার ভয়;
 বদ্ধ জায়গায় থাকার ভয়;
 ভিড়ে লাইনে দাঁড়ানোর ভয়;
 ঘরের বাইরে একা থাকার ভয়।
অ্যাগোরাফোবিয়া যেকোনো বয়সের মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে সাধারণত ২১ বছর বা তার অধিক বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে শিশু কিংবা বয়োবৃদ্ধদের মধ্যেও দেখা দিতে পারে। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীরা এই মনোরোগে আক্রান্ত হন বেশি; হিসাবে প্রায় দ্বিগুণ। এ ছাড়া—
 শারীরবৃত্তীয় কারণ: এ ক্ষেত্রে নিউরোট্রান্সমিটারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শরীরে সেরোটোনিন কম থাকলে অ্যাগোরাফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
 জিনগত কারণ: উদ্বেগ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিনবাহিত হয়ে থাকে। মা-বাবা কারও মধ্যে উদ্বেগজনিত সমস্যা থাকলে খুব সহজে সন্তানের মধ্যে তা চলে আসতে পারে।
 মনস্তাত্ত্বিক কারণ: আতঙ্ক, কাছের মানুষের মৃত্যু, সম্পর্কে গোলমাল, কাজের চাপ, পরিবেশে পরিবর্তন প্রভৃতি অনেক ক্ষেত্রেই এ রোগের জন্ম দেয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অ্যাগোরাফোবিয়া এমন লোকদের আক্রান্ত করতে পারে, যাদের অতীতে প্যানিক অ্যাটাক হয়েছিল। এটি তাদের অনুরূপ পরিস্থিতির ভয় ধরাতেও শুরু করে।
লক্ষণ দেখে চেনা
অ্যাগোরাফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে ভয় পাওয়ার পাশাপাশি আরও কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে; যেমন—
 অসহায় বোধ করা;
 নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা;
 বিচ্ছিন্নতাবোধে ভোগা;
 উৎকণ্ঠায় ভোগা।
এ ছাড়া কিছু শারীরিক লক্ষণও দেখা দিতে পারে; যেমন—
 মাথা ঘোরা;
 বমি বমি ভাব হওয়া;
 দম বন্ধ হওয়া অবস্থা;
 পেট খারাপ হওয়া;
 শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়া;
 হৃৎস্পন্দন দ্রুত হওয়া;
 শরীর কাঁপিয়ে ঘাম আসা;
 হঠাৎ ঠান্ডা লাগা।
নির্ণয় ও সমাধান
মনোবিদেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাইকোমেট্রিক টেস্টের মাধ্যমে এই রোগ নির্ণয় করেন। এই সাইকোলজিক্যাল টেস্টের মাধ্যমে রোগীর মধ্যে কতটা ভয় বা উদ্বেগ রয়েছে, তা-ও নির্ধারণ করা যায়। টেস্টের ফলাফলের পরই চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। সবার ক্ষেত্রে ওষুধের প্রয়োজন পড়ে না। কারও কারও ক্ষেত্রে শুধুই কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এই সমস্যা থেকে সমাধান পাওয়া যেতে পারে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হকের মতে, ‘অ্যাগোরাফোবিয়া সাধারণত সামান্য বা হালকা উদ্বেগ ব্যাধি হিসেবে শুরু হয়। প্রাথমিক কয়েকটি প্যানিক অ্যাটাকের মাধ্যমে শুরু হয়ে থাকে। প্রথমেই চিকিৎসা করানো গেলে সহজে সেরে যায়। যদিও এই রোগের স্থায়ী কোনো প্রতিকার নেই; তবে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারলে প্যানিক অ্যাটাকের ওপর নিজেই নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন। অন্যথায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি আরও খারাপ রূপ নিতে পারে।’
এদিকে গবেষকদের মতে, উদ্বেগ কমানোর জন্য মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য বেশ কাজে দেয়। আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান বাড়িয়ে তুলতে পারলে ভয় এমনিতেই অনেকটা কমে যায়। আর কাউন্সেলিংয়ের পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খেলে সমস্যা আরও প্রশমিত হয়। অবশ্য অনেকেই না বুঝে অ্যাগোরাফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। তারা জানেন না, এমন হাসাহাসির কারণে আক্রান্ত ব্যক্তির আত্মবিশ্বাসে আরও চিড় ধরে। ওষুধের পাশাপাশি থেরাপির মাধ্যমেও এর চিকিৎসা করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সাইকোথেরাপি, কগনিটিভ-বিহেভিওরাল থেরাপি এবং এক্সপোজার থেরাপি।
 সাইকোথেরাপি: সাইকোথেরাপিতে একজন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদার বা থেরাপিস্টের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করার বিষয়টি জড়িত। এটি আপনাকে ভয় এবং ভয়ের উদ্রেক ঘটার কারণসংক্রান্ত সমস্যা সম্পর্কে কথা বলার সুযোগ করে দেয়। দ্রুত ও কার্যকর ফলের জন্য থেরাপির পাশাপাশি হালকা মাত্রার ওষুধের পরামর্শও দেওয়া হয়।
 কগনিটিভ-বিহেভিওরাল থেরাপি: এটি আপনাকে শেখাবে, প্যানিক অ্যাটাকের জন্য দায়ী চাপযুক্ত পরিস্থিতিতে কীভাবে কাজ করতে হয়। এতে সুস্থ চিন্তার সঙ্গে নেতিবাচক চিন্তার প্রতিস্থাপন জড়িত। অ্যাগোরাফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এ এক সাধারণ থেরাপি এবং এটি তাদের জীবনের ওপর নিজ নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারে সাহায্য করার ওপর ফোকাস করে।
 এক্সপোজার থেরাপি: এই থেরাপি এমন পরিস্থিতিতে ফেলার ওপর ফোকাস করবে, যা ভয়কে ট্রিগার করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি ভয়কে অদৃশ্য করে দিতে পারে। যেকোনো আসক্তি কাটিয়ে ওঠার মতো জীবনধারা, নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যাভ্যাস অ্যাগোরাফোবিয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে সক্ষম।
আশার কথা, দ্রুত শনাক্ত করা গেলে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে পারলে কার্যকর চিকিৎসার মাধ্যমে, একজন থেরাপিস্ট বা ডাক্তার, অথবা উভয়ই মিলে আপনাকে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারেন। তাই যদি মনে করেন, আপনার ভেতর অ্যাগোরাফোবিয়ার লক্ষণ রয়েছে, দ্রুততম সময়ে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top