skip to Main Content

টেকসহি I দক্ষতা দর্শন

১৫ জুলাই। ওয়ার্ল্ড ইয়ুথ স্কিলস ডে। যুবসমাজকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করার প্রয়াস। কেমন চিত্র আমাদের দেশের? সারা দুনিয়ার?

কিছুদিন আগে দেশের কর্মক্ষেত্রের চলমান অবস্থা নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। তাতে দেখা যায়, এ বছরের প্রথম তিন মাসে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৫৯ হাজারে; গত বছরের শেষ তিন মাসে তা ছিল ২০ লাখ ৩২ হাজার। এ মুহূর্তে দেশে বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। তাদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যা কম নয়।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬-১৭ সালের আরেক জরিপ অনুসারে, জাতীয় বেকারত্বের হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ। সে সময় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার ছিল এর দ্বিগুণের বেশি, ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। সমীক্ষায় আরও জানা যায়, দেশের মোট বেকারত্বের মধ্যে তরুণ ৭৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এর মধ্যে শিক্ষিত তরুণদের সংখ্যাই বেশি। স্নাতক বা ডিগ্রি লেভেলে পড়াশোনা করা বেকার তরুণ ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ; আর মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রাপ্ত বেকার ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
যুবসমাজের কর্মসংস্থানের এ দুরবস্থা শুধু বাংলাদেশে নয়; বিশ্বের আরও অনেক দেশ নিজেদের যুবসমাজকে কাজে লাগানোর দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে। তরুণদের কর্মসংস্থান নিয়ে সচেতনতা এবং তাদের কাজের বিশেষ ক্ষেত্র তৈরি করার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর ‘বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। ১৫ জুলাই পালিত হয় দিবসটি। নিয়োগকারী বা কর্মসংস্থান প্রদানকারীদের সঙ্গে যুবসমাজের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই এই দিবস পালিত হয়ে আসছে।
গত বছর বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবসের থিম ছিল ‘ভবিষ্যতের প্রয়োজনে তরুণদের দক্ষতায় পরিবর্তন’। গতবার দিবসটির গুরুত্বও ছিল ভিন্ন। কোভিড-১৯ মহামারি থেকে আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। পাশাপাশি বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন, সংঘাত, দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও অন্যান্য সংকট কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেগুলো নিয়েও কাজ করা হয় দিবসটিতে।
এ বছর যদিও পুরো বিশ্ব করোনার ধাক্কা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে; বেকারত্বের হার কিংবা চাকরির বাজারে তবু সুদিন ফেরেনি। যুবসমাজকে কর্মক্ষম করার পেছনে শুধু গতানুগতিক নয়, কারিগরি শিক্ষারও প্রয়োজন। আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার সুযোগ থাকলেও তা খুব সীমিত; তার ওপর এ ধরনের শিক্ষার পর চাকরির সুযোগও তুলনামূলক কম। ২০২১ সালে জেনারেশন আনলিমিটেড, পিডব্লিউসি এবং ইউনিসেফ একটি যৌথ প্রতিবেদনে দাবি করে, সে সময় চাকরির বাজারের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা শনাক্ত এবং তা অর্জন করতে সক্ষম—এমন তরুণের সংখ্যা অনেক কম। এর ফলে বাড়ছে স্কিল গ্যাপ। একই সঙ্গে যুবসমাজে বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হার।
ওই প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ভবিষ্যতে কর্মসংস্থানের জন্য ঠিক কী ধরনের দক্ষতা প্রয়োজন, তা বুঝতে পারেন না ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীরা। তাদের মধ্যে যদি কেউ তা শনাক্ত করতেও পারেন, সেই দক্ষতা অর্জনের সুযোগ খুবই সীমিত। তা ছাড়া অনেকে চাকরির বেলায় ভুল তথ্য দিয়ে আবেদন করেন। সেসব তথ্য যাচাইয়ে নিয়োগকর্তারা অনেক সময় শতভাগ সঠিক উপায় অবলম্বন করতে পারেন না বলেও উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় দক্ষতা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। মূলত বৈশ্বিক স্কিল গ্যাপ, অর্থনৈতিক মন্থরতা এবং জটিল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ চাকরির বাজারের কারণে গত দুই দশকে তরুণদের কর্মসংস্থান ১২ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।
২০১৯ সালের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তি এমন সব চাকরির ক্ষেত্র তৈরি করবে, যা বিশ্ব এখনো দেখেনি। ৪ বছর আগের সেই রিপোর্ট যে সত্য হতে যাচ্ছে, তার প্রমাণ কিন্তু এখন সামনে। গত বছরের শেষ দিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চ্যাটবট চ্যাটজিপিটি বাজারে আনে ওপেনএআই। অনেকটাই মানুষের মতো কথোপকথন চালাতে সক্ষম এ প্রযুক্তি আসার পর আলোড়ন ঘটে যায় পুরো বিশ্বে; বিশেষ করে চাকরির বাজারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা গবেষক ও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব নতুন প্রযুক্তি আমাদের এত দিনের গতানুগতিক চাকরির ক্ষেত্রকে পুরো বদলে দেবে। একদিকে যেমন অনেকে চাকরি হারাবেন; অন্যদিকে তৈরি হবে নতুন কর্মক্ষেত্র। এমনকি মাত্র কয়েক মাসেই এ প্রযুক্তির আরও উন্নত সংস্করণ আসা শুরু হয়েছে। ওপেনএআই সম্প্রতি বাজারে এনেছে চ্যাটজিপিটি-৪, যা প্রাথমিক সংস্করণের চেয়ে আরও উন্নত। এগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টেক জায়ান্টরাও কাজ করছে প্রযুক্তিটি নিয়ে। গুগলের ‘বার্ড’, চীনা কোম্পানি বাইদুর ‘আর্নি বট’ এমনই কিছু প্রযুক্তি।
যেভাবে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে, তা থেকে ধারণা করা যায়, শিগগির প্রযুক্তি জগতে আমূল পরিবর্তন আসছে। এই অবস্থায় চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি খাতে নিজের যোগ্যতা বাড়াতে কাজ করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে তরুণদের সুযোগও বেশি। নতুন কিছু সহজে আয়ত্তে নিতে পারবেন তারা। নতুন কর্মক্ষেত্রের এ ধারার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশি তরুণদের ওপরও। প্রোগ্রামিং, ওয়েব ডিজাইনিং প্রভৃতি ক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংয়ের পরিমাণ বেড়েছে আগের চেয়ে বেশি। তবু এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না কর্মক্ষেত্রে; যার প্রধান কারণ পর্যাপ্ত দক্ষতার অভাব। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ বাংলাদেশের শ্রমশক্তিতে প্রবেশ করেন। কিন্তু পলিটেকনিক, বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ—তিনটি ক্ষেত্রেই এ দেশে কর্মসংস্থানের হার ৫০ শতাংশের কম। এমনকি বেকারত্ব এত বেশি হওয়া সত্ত্বেও বিদেশে বিপুল শ্রমশক্তি পাঠানো হয়।
বিশ্বব্যাংক তাদের সেই প্রতিবেদনে বেকারত্বের জন্য সঠিক দক্ষতার অভাবকে দায়ী করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশ ও বিদেশের কর্মসংস্থান বাজারে শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম তরুণদেরকে দক্ষ শ্রমশক্তিতে পরিণত করার জন্য প্রথমেই পরিবর্তন আনা চাই শিক্ষাপদ্ধতিতে। এ পরিবর্তন আনা চাই স্কুল পর্যায় থেকেই। শিক্ষার্থীরা যেন জ্ঞান লাভের পাশাপাশি বিশ্ব ও পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে সচেতন হতে পারেন, সেভাবেই শিক্ষাদান করা জরুরি। সেই সঙ্গে তারা যেন মাধ্যমিক স্তর থেকেই নিজেদের আগ্রহের জায়গা খুঁজে পান, এবং সে জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ মেলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সেদিকটাও দেখতে হবে। এ ছাড়া বেসরকারি খাতের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি করার বিষয়টিও শুরু থেকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা চাই।
এখনকার চাকরির ক্ষেত্র যেহেতু অনেকটাই প্রযুক্তিনির্ভর, তাই আইসিটি, কমিউনিকেশন এবং প্রবলেম সলভিংয়ের মতো সমস্যা সমাধানের সফট স্কিল গড়া জরুরি, যেন তরুণেরা সুযোগ পান। এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি অন্যান্য দেশেরও বিনিয়োগ করা চাই। বর্তমান চাকরির বাজারে মূলত সফট স্কিলের গুরুত্ব বেশি। এর মাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে আজীবন নতুন নতুন স্কিল ডেভেলপের সুযোগ থাকে। আর এভাবে স্কিল বাড়তে থাকলে তা শেষ পর্যন্ত আরও উন্নত চাকরি ও ভালো ক্যারিয়ার গড়তে কাজে আসে। দক্ষতা অর্জন আসলে নিজের অর্থনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের একটি মাধ্যম। চাকরির বাজারে নতুন সুযোগ তৈরির দিক দিয়ে এগিয়ে আছে বেসরকারি খাত ও বিভিন্ন শিল্প। তাই এসব নতুন পরিবর্তন চিহ্নিত করতে এবং এর ফলে কীভাবে শিক্ষাক্ষেত্র বা প্রশিক্ষণ কাজে লাগতে পারেন, তা বোঝার জন্য শিল্প ও শিক্ষা খাতের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।
উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। বিশ্বব্যাংকের স্কিলস অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট এবং বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) মধ্যে একটি অংশীদারত্বের অধীনে ২০১৯ সালে ১১ হাজারের বেশি অদক্ষ কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের পর ৮০ শতাংশ কর্মী কর্মসংস্থানের দক্ষতা অর্জন করেন। এ ধরনের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি কারিকুলাম উন্নয়নে সহযোগিতা, ইন্টার্নশিপের সুযোগ, ল্যাবরেটরি বা ওয়ার্কশপের সুবিধা থাকলে তা চাকরির বাজারে সাহায্য করতে পারে।
যদিও ভবিষ্যৎ চাকরির বাজার অনিশ্চিত এবং সব সময়ই পরিবর্তনশীল, তবু একটি দেশের বিভিন্ন সংগঠন যদি এ ধরনের উদ্যোগ নেয়, তাহলে তা তরুণদের দক্ষতা অর্জনে বহুগুণ কাজে আসতে পারে। এতে একদিকে যেমন উপকৃত হবে তরুণসমাজ, তেমনি বিশ্বের কর্মক্ষেত্রও হবে সমৃদ্ধ।

 সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top