skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I কৃতজ্ঞতাবোধের কীর্তি

কৃতজ্ঞতাবোধ দেখিয়ে বেড়ানোর বিষয় নয়; এটি অনুভব করলে তা ব্যক্তিমানুষটির আচার-আচরণে, কথাবার্তায় এক ঐন্দ্রজালিক শুভ্রতা নিয়ে, অনেকটা গূঢ়ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে

কৃতজ্ঞতাবোধ। ভীষণ মিষ্টি শব্দ। মানবিক গুণ। এর মাহাত্ম্য অনেক গভীর। প্রাত্যহিক বেঁচে থাকায় ছোট-বড় অনেক কিছুর প্রতিই জ্ঞাতসারে ও অজ্ঞাতে ঋণী হতে থাকি আমরা। সামান্য আহার থেকে শুরু করে জীবন গড়ে তোলা পর্যন্ত অনেক মানুষ, অনেক প্রাণসত্তা, এমনকি অনেক নির্জীব সত্তা কিংবা ঘটনাও আমাদের বেঁধে নিতে পারে অপরিশোধ্য ঋণের জালে। তা কখনো কখনো উপলব্ধি করতে পারি; কখনো হয়তো টেরও পাই না। যখন টের পাই, এক অন্য রকম ভালো লাগায় ভরে যায় মন। জীবনকে সার্থক মনে হয়। কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই ঋণ। কখনো তা প্রকাশ করি; কখনো করা হয় না। অথচ বিবেচনাবোধসম্পন্ন সত্তা হিসেবে প্রত্যেক মানুষেরই নিজের অন্তস্তলে কৃতজ্ঞতাবোধ উপলব্ধি করা আবশ্যক। অন্যথায় মানবিক গুণাবলিবর্জিত প্রাণীতে পরিণত হতে হয়!

দুই
‘কৃতজ্ঞতা হলো আত্মা থেকে উৎপন্ন সবচেয়ে সুন্দর ফুল,’ বলেছেন আমেরিকান ধর্মযাজক ও সমাজসংস্কারক হেনরি ওয়ার্ড বিচার [১৮১৩-১৮৮৭]। মানুষের অন্তস্তলে এই চমৎকার ফুলের বীজ সাধারণত শৈশবেই বুনে দেওয়া হয়। আর সেই দায়িত্ব পালন করে পরিবার, প্রতিবেশ, সমাজ, রাষ্ট্র। বড় হতে হতে একজন ব্যক্তিমানুষ সেই পরিস্ফুটিত ফুল লালন করেন নিজ বোধশক্তি ও বিবেচনাবোধের নিরিখে। কৃতজ্ঞতাবোধ যদি ফুল হয়ে থাকে, ধন্যবাদজ্ঞাপনকে তাহলে বীজ হিসেবে গণ্য করা যায়। কেননা, ধন্যবাদজ্ঞাপন চর্চার ভেতর দিয়েই সূচনা ঘটে কৃতজ্ঞতাবোধ চর্চার। অনেকে অবশ্য এ দুটিকে গুলিয়ে ফেলেন; কেউ কেউ মনে করেন অভিন্ন। অথচ তা নয়। ধন্যবাদজ্ঞাপন হলো কোনো কিছুর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের প্রাথমিক ও প্রকাশ্য রূপ। কৃতজ্ঞতাবোধ হলো অন্তস্তলে বসত গড়া এক প্রবল অনুরাগময় অনুভব। জীবনে চলার পথে কখনো কখনো আমরা হয়তো বাধ্য হয়েই কাউকে বা কোনো কিছুকে ধন্যবাদ দিয়ে থাকি; আবার পরক্ষণেই ভুলে যাই বেমালুম। অন্যদিকে, কৃতজ্ঞতাবোধ দেখিয়ে বেড়ানোর বিষয় নয়; এটি অনুভব করলে তা ব্যক্তিমানুষটির আচার-আচরণে, কথাবার্তায় এক ঐন্দ্রজালিক শুভ্রতা নিয়ে, অনেকটা গূঢ়ভাবে প্রকাশ পেতে থাকে।

তিন
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যক্তিমানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ ইতিবাচকভাবে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। যাদের ভেতর এই বোধ জাগ্রত, তারা উৎকণ্ঠা, বিষণ্নতার মতো মনোরোগে ভোগেন কম; অন্যদিকে তাদের ঘুম ভালো হয়, মন-মেজাজ ও রোগ প্রতিরোধক্ষমতার উন্নতিসাধনের পাশাপাশি ক্রনিক পেইনের মতো শারীরিক কষ্ট অনেকটাই সেরে যায়। তাই কৃতজ্ঞতাবোধকে অনেকেই একই সঙ্গে শরীর ও মনের মহৌষধ হিসেবে বিবেচনা করেন।
বিভিন্ন গবেষণাসূত্রে জানা যায়, মানুষের আচার-আচরণ ও মানসিক অবস্থার প্রতিফলন পড়ে তার দেহযন্ত্রেও। ইতিবাচক মনোভাব শরীর থেকে অক্সিটক্সিন হরমোন রিলিজ করে; ফলে তিনি অন্যদের সঙ্গে ভালোভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। আর এমন মনোভাব ধারণের নেপথ্যে কৃতজ্ঞতাবোধ যে কার্যকর ভূমিকা রাখে, সে কথা বলা বাহুল্য। তা ছাড়া এই বোধ আমাদের জীবনকে তুলনামূলক বেশি আনন্দদায়ক করে তোলে, দুশ্চিন্তা কমায়, আত্মমর্যাদাবোধের উন্নতি ঘটায়, আমাদেরকে আরও বেশি সুস্থির ও প্রাণবন্ত হতে সাহায্য করে, রোমান্টিক সম্পর্কে আলো ছড়ায়, বন্ধুত্ব নিবিড় করে, ভারসাম্যবোধ বাড়ায়, কর্মজীবনকে করে তোলে অর্থবহ। এককথায়, এই গুণের যেন অন্ত নেই!

চার
কৃতজ্ঞতাবোধ শুধু অনুভব করলেই এর ব্যাপ্তি ও কার্যকারিতার বিস্তার ঘটবে না; বরং একে নিয়মিত চর্চার মধ্যে রাখা চাই। আর তা খুব একটা কষ্টসাধ্য নয়। চাইলে আমরা প্রতিদিন একটি জার্নাল সমন্বয় করতে পারি, যেখানে লিপিবদ্ধ থাকবে কখন, কেন, কার বা কিসের প্রতি ঋণী হয়েছি এবং সে জন্য কীভাবে তার বা সেটির কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা সম্ভব। এমন কারও প্রতি যথাসময়ে ধন্যবাদজ্ঞাপন এবং তাদের প্রশংসা করা যেতে পারে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যগুলোকে প্রতিনিয়ত মনোযোগ দিয়ে দেখা এবং সেগুলোর মাহাত্ম্য অনুভব করাও এ চর্চার অংশ। তা ছাড়া বন্ধুত্বসহ সকল সম্পর্কের মর্যাদা দেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা রাখতে পারে ভূমিকা। আরও আছে! যথাসম্ভব হাসিমুখ ধরে রাখা, জীবন সুন্দর—এমন প্রেরণাদায়ী ভিডিও দেখা, প্রতিদিন অন্তত একবার উদারতার পরিচয় দেওয়া, নেতিবাচক ও ধ্বংসাত্মক বার্তাবাহী মিডিয়া ও সিনেমা এড়িয়ে চলা, পরিবারের যে সদস্যরা দূরে থাকেন, তাদের নিয়মিত ফোনকল করা, দাতব্য কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে জুড়ে থাকা, কোনো গসিপ কিংবা কাউকে অপমান না করা, পছন্দের মানুষদের সঙ্গে অর্থবহ সময় কাটানো, সময়ে সময়ে কাছের মানুষদের প্রশংসা করা, জীবনের উজ্জ্বল দিকগুলোতে দৃষ্টি রাখা প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতাবোধকে নিজ অন্তস্তলে লালন করা সম্ভব।

পাঁচ
‘অন্যদের সাহায্য ছাড়া কারও পক্ষে সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়। বিজ্ঞ ও আত্মবিশ্বাসী মানুষ এই সাহায্যকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন,’ বলেছেন ব্রিটিশ গণিতবিদ ও দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড [১৮৬১-১৯৪৭]।
কৃতজ্ঞতাবোধের সুবাস ছড়িয়ে পড়ুক সবার জীবনে। শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top