কুন্তলকাহন I হেয়ার শেডিং
দূষণ, দুশ্চিন্তা কিংবা খাবারে অনিয়ম। সঙ্গে যোগ হতে পারে হরমোনের হেরফের আর জেনেটিক্যাল নানা ইস্যু। তবে নিস্তারেরও রয়েছে উপায়
হেয়ার শেডিং বুঝতে হলে প্রথমে এর সঙ্গে ফলিংয়ের ফারাক বুঝে নিতে হবে। শেডিং হচ্ছে চুল ঝরে পড়া আর ফলিং হচ্ছে চুল পড়ে যাওয়া। তফাত কোথায়? শেডিংয়ের সময় মাথা থেকে অন্তত ১০০টা পর্যন্ত চুল ঝরে পড়া স্বাভাবিক। সাধারণত কোনো স্ট্রেসফুল সময় পার হওয়ার পর এটি ঘটতে দেখা যায়। গর্ভকালীন এবং প্রসব-পরবর্তী সময়, মেনোপজ, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির পরিবর্তন, হঠাৎ অনেক বেশি ওজন কমে যাওয়ার পর হেয়ার শেডিং হতে পারে। এটি মানবদেহের খুবই স্বাভাবিক এবং সাময়িক প্রক্রিয়া। বডি রিঅ্যাডজাস্টের সঙ্গে সঙ্গে শেডিংও বন্ধ হয়ে যায়। ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যে আবার নিজ থেকে চুল গজাতে শুরু করে। কিন্তু চুল ঝরার হার শ ছাড়িয়ে যায় তখনই, যখন এর সঙ্গে যুক্ত হয় জেনিটিক্যাল নানা ইস্যু, হরমোনের হেরফের আর পুষ্টির অভাব। তখন তৈরি হয় ‘মোর অন দ্য ফ্লোর’ সিচুয়েশন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার নাম টেলোজেন এফ্লুভিয়াম। মেঝে ছাড়াও হেয়ার ব্রাশ, তোয়ালে, বিছানা ও বালিশে চুল ঝরে পড়ার সুস্পষ্টতা নজরে পড়ে। এমনকি আঙুল বোলালেও চুল উঠে আসতে শুরু করে। তখনই বুঝে নিতে হবে, এটি রোধ করা প্রয়োজন। অন্যদিকে হেয়ার ফল হচ্ছে চুল পড়ে যাওয়া। যা আবার গজাবে কি না, এর কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বিশেষজ্ঞদের মত, যত দিন হেয়ার ফলের কারণ রোধ করা না যাবে, নতুন চুল গজাবে না। কিন্তু শেডিংয়ের ব্যাপারটি সাময়িক। ফারাক সেখানেই। শেডিংয়ের সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে বাড়তি যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি মেনে চলা যেতে পারে একদম সহজ কিছু পন্থা।
ব্যালেন্সড ডায়েট
সুষম খাবার অর্থাৎ প্রচুর শাকসবজি, চর্বিহীন মাংস এবং সামুদ্রিক মাছ—সব কটিতেই চুলের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ রয়েছে। অ্যাভোকাডো কিংবা ডিমের মতো ভিটামিনযুক্ত খাবার থাকতে পারে প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায়। খাওয়া যেতে পারে আয়রনে পরিপূর্ণ পালংশাক, যা স্ক্যাল্পে রেড ব্লাডসেল বহন করে নিয়ে যায় এবং চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। পাশাপাশি কমলালেবু, টমেটো ও মরিচের মতো ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার কোলাজেন তৈরিতে সাহায্য করে, যা চুলের ফলিকল সুস্থ রাখে। এ ছাড়া খাবার তালিকায় যোগ করা যেতে পারে ফ্ল্যাক্স বা চিয়া সিডের মতো ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডে পূর্ণ বীজ; যা চুলকে স্বাস্থ্যকর ও শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করবে। এমনকি নতুন চুল গজাতেও।
হেয়ারস্টাইল
চুল পড়ার সমস্যা থেকে রেহাই পেতে হেয়ারস্টাইলে দিতে হবে বিশেষ মনোযোগ। আঁটসাঁট কিংবা খুব শক্ত করে বাঁধা চুল ঝরে পড়ার সমস্যা আরও বাড়িয়ে দেয়। কেননা খুব শক্ত করে চুল বাঁধলে সেটা চুলের ফলিকলে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজির মতে, খুব জোরে চুল না বাঁধা এবং ঘন ঘন পেছনের দিকে টেনে নেওয়া কমালে চুল পড়ার হার কিছু কমিয়ে আনা যেতে পারে। চুল ঠিক কোন জায়গায় কমে যাচ্ছে, সেটা খেয়াল করলে কাজ আরও সহজ হয়ে যাবে। যদি হেয়ারলাইন, কিংবা যে স্থানে নিয়মিত চুল বাঁধা হয়, সেখানে চুল কমতে থাকে, তখন থেকেই সাবধান হওয়া দরকার। চুল খুব হালকা করে বেঁধে নেওয়া যেতে পারে। বেণি করলেও খুব আলতোভাবে করতে হবে। খুব আঁটসাঁট করে টেনে উঁচু করে চুল বাঁধা কমিয়ে আনতে হবে। আর সব সময় একই স্থানে বা একই স্টাইলে চুল না বেঁধে ভিন্ন স্টাইলে মাথার ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বেঁধে নেওয়া যেতে পারে। এতে লুকে পরিবর্তন আসবে। চুলও খানিকটা স্বস্তি পাবে।
স্লিপ সাইকেল
সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন পর্যাপ্ত ঘুম প্রয়োজন, তেমনি তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে ত্বক আর চুলেও। সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে। মেলাটোনিন নামের একটি হরমোন ঘুমচক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। পর্যাপ্ত ঘুমে শরীরে এর সঞ্চার হয়। চুলের বৃদ্ধিতেও এটি সহায়ক বলে প্রমাণিত। এ ছাড়াও পর্যাপ্ত ঘুম চুলকে অতিরিক্ত তৈলাক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। ঘুমের অনিয়ম হলে স্বাভাবিকভাবে স্ট্রেস লেভেল বাড়তে শুরু করে। ফলাফল—চুলের বৃদ্ধির হার কমে যায়। বাড়ে অতিরিক্ত তেল উৎপাদনের হার।
ওমেগা-৩
ওমেগা-৩ চুলের যত্নে খুব কার্যকর উপাদান। ডায়েটে এটি যোগ করলে তা চুলের বৃদ্ধিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ওমেগা-৩ পেতে স্যামন ও চিয়া সিডের মতো খাবার ডেইলি ডায়েটে জুড়ে দেওয়া যায়। অথবা একটি মানসম্পন্ন ব্র্যান্ডের মাছের তেলের সাপ্লিমেন্টও ব্যবহার করে দেখা যায়। মাছের তেল স্ক্যাল্পে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে। সেই সঙ্গে এটি চুলের ফলিকলগুলোকে খুলে দিয়ে আরও নতুন চুল গজাতে জায়গা করে দেয়।
স্ক্যাল্প ট্রিটমেন্ট
চুল পড়া প্রতিহত করার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিকল্পনা হলো হেয়ার কেয়ার রুটিনে নিয়মিত মাথার ত্বকের যত্ন অন্তর্ভুক্ত করা। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার শ্যাম্পুর আগে স্ক্যাল্প ট্রিটমেন্ট করে নিলে ফলিকুলার হেলথ বজায় থাকে, যা হেয়ার ফলিকলের জীবনীশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে। বাজারে এখন ভালো ভালো ব্র্যান্ডের স্ক্যাল্প ট্রিটমেন্ট মিলবে, যা ব্যবহারও খুব সহজ। এ ছাড়া ব্যবহার করা যায় স্ক্যাল্প সেরাম। এতে স্ক্যাল্পের রুক্ষতা দূর হবে। কিছু কিছু সেরাম তো বিশেষভাবে চুলের বৃদ্ধির জন্যই তৈরি। প্রয়োজন অনুযায়ী যেকোনো ভালো মানের স্ক্যাল্প সেরাম বেছে নেওয়া যেতে পারে।
হেয়ার মাস্ক
ঘুমাতে যাওয়ার আগে চুলে হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। এ সময়টা মাস্কিংয়ের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। কারণ, বিশ্রামের সময় শরীর, মন, মস্তিষ্কও বিশ্রাম নেয়। ফলে মাস্কের সব পুষ্টিগুণ খুব সহজে স্ক্যাল্পে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন কিছু ব্যবহার করা চাই, যা চুলের শক্তি ধরে রাখার ভিত তৈরিতে সক্ষম। সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে মাস্কের সাহায্যে চুলের কিউটিকলে যেন লিপিড, আর্দ্রতা আর প্রোটিনের সর্বাধিক প্রবেশ ঘটে।
শিরীন অন্যা
মডেল: স্মৃতি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল