ছুটিরঘণ্টা I প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর পর্তুগিজ ঐতিহ্যের মিশেল
ভ্রমণপিয়াসি মনে সমুদ্রের প্রাগৈতিহাসিক হাতছানির সঙ্গে ইতিহাসের পরিক্রমা। লিখেছেন বিধান রিবেরু
ঢাকা থেকে হায়দরাবাদ হয়ে যখন গোয়া অবতরণ করলাম, রাত দশটা। হায়দরাবাদে ট্রানজিট ছিল পাঁচ ঘণ্টার। কাজেই যথেষ্ট ক্লান্ত ছিলাম আমরা। তারপরও ডাবোলিমের গোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে ট্যাক্সি নিয়ে যখন রিসোর্টের দিকে রওনা দিলাম, একটা চনমনে ভাব চলে এলো। আমার পুত্র মনে বারবার জিজ্ঞেস করতে শুরু করল, ‘বাবা, সাগর কোথায়?’ আমার সঙ্গিনী মনিও এদিক-সেদিক খোঁজা শুরু করল, যদি সাগরের দেখা পাওয়া যায়! গাড়ি পাহাড়ি পথ এঁকেবেঁকে যখন প্রশস্ত পথে পড়ল, একটি ঝুলন্ত সেতু নজরে এলো। বলা বাহুল্য নয়, সেতুর নিচে ওটা সমুদ্র নয়, নদী। পরে জেনেছি, এর নাম জুয়ারি নদী। সেতুর নামটাও তাই জুয়ারি সেতু। এই সেতু উত্তর ও দক্ষিণ গোয়াকে সংযুক্ত করেছে।
আমাদের গন্তব্য উত্তরে। জায়গার নাম দোনা পাওলা। আর রিসোর্টের নাম সিদাদ দে গোয়া। পর্তুগিজ শব্দ সিদাদ মানে ‘সিটি’, শহর। গাড়ি যখন বিশাল রিসোর্টটিতে নিয়ে এলো, ক্লান্তি ধীরে ধীরে উবে যেতে লাগল। ফ্রন্ট ডেস্কের কাজ সেরে আমাদের যে রুমে নিয়ে যাওয়া হলো, সেটির ইন্টেরিয়র পুরোপুরি পর্তুগিজ ঢঙের। এমনকি গোটা রিসোর্টটাই পর্তুগিজ স্থাপত্যকলার সাক্ষ্য বহন করছে। পরে খোঁজটোজ নিয়ে জানি, তাজ হোটেলের এই এসেট নকশা করেছেন ভারতের বিখ্যাত স্থাপত্যশিল্পী ও নগর-পরিকল্পনাবিদ চার্লস কোরাইয়া। লাগোয়া সাগর ও পাহাড়কে সমন্বয় করে চল্লিশ একরের ওপর গড়ে ওঠা এই লাক্সারি রিসোর্ট দেখেই বোঝা যায়, পেছনের চিন্তাটা কী ছিল। স্থপতি কোরাইয়া কখনোই উঁচু ভবন নিয়ে কাজ করেননি। মানুষের দৃষ্টিসীমাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। অতিকায় ভবন নির্মাণে ইচ্ছুক ছিলেন না। সিদাদ দে গোয়া তিনি নির্মাণ করেন ১৯৮২ সালে। তার উদ্দেশ্যই ছিল পুরো জায়গাটি দেখতে যেন পর্তুগিজ পল্লির মতো মনে হয়।
কক্ষে ঢুকে বারান্দার স্লাইড ডোর খুলতেই রিসোর্টের প্রাইভেট বিচ। সশব্দ সাগরের সফেদ ফেনা দেখে আমাদের চোখের ঘুমও চলে গেল। তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা। বারান্দায় বসে সাগর উপভোগ করছি। মনে পাশে বসে বলল, ‘আমরা এখান থেকে আর যাব না।’ বেচারা আসলে ঢাকা থেকে হায়দরাবাদ আসার পথের উড়ানে ভয় পেয়েছে। বলছিল, ‘অল্পের জন্য বেঁচে গেলাম, পাইলট রোলার কোস্টার চালিয়েছে!’ কথা সত্য। ওই আড়াই ঘণ্টায় আমাদেরই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড় হয়েছিল। বাজে আবহাওয়ার বদৌলতে। যাক, পরে হায়দরাবাদ থেকে গোয়ার এক ঘণ্টার যাত্রা নির্বিঘ্ন হয়েছে, যদিও দূরের ঈশান কোণে মেঘের গায়ে আগুন দেখা গিয়েছিল। কিছুক্ষণের ভেতরেই আমরা ঘুমোতে গেলাম। ঢেউয়ের অনবরত আছড়ে পড়ার শব্দ যেন ঘুম পাড়ানি গানের কাজ করল।
গোয়ার সৈকতে প্রথম সকাল। আরব সাগরের পাড়। জায়গাটি ভ্রমণপিপাসু মানুষেরা বেছে নেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে। আমাদের প্রাথমিক কারণ সেটাই ছিল এখানে আসার। তাই আমরাও প্রথম দিন একটু আয়েশ করলাম। সিদাদ দে গোয়ার বিশাল এলাকা ঘুরে দেখলাম। এক জায়গায় বড় বড় সাইজের দাবার গুটি। আমি আর মনে খেললাম কিছুক্ষণ। ছবি তোলা হলো। রিসোর্টের প্রহরীরা বেশ হাসিখুশি। তারা আমাদের ফ্যামিলি ফটো তুলে দিলেন। এরপর দাবার ছক থেকে হেঁটে এগোলাম। সৈকতে পেতে রাখা লঘুখট্টিকায় গা এলিয়ে সামুদ্রিক ফেনার ওপর সূর্যের ঝিকিমিকি উপভোগ করলাম। মনে খেলতে চলে গিয়েছিল প্লেয়িং জোনে। সেদিন আক্ষরিক অর্থেই অলস দিন কাটালাম আমরা। তবে রাতে স্থানীয় একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁয় খেতে গেলাম। এক কিলোমিটারের ভেতর, অডজেল বিচ ঘেঁষা ‘বে ফিফটিন’ রেস্তোরাঁ। গোয়ানিজ ফুডই ট্রাই করলাম আমরা। সঙ্গে মার্টিনি আর মকটেল। ঝাল ঝাল পর্ক ভিন্দালুটা ছিল লা-জবাব। নারকেল কুচি ও লাল সস দিয়ে কষানো চান্দা মাছটাও বেশ ছিল। রাতের খাবার খেতে খেতে লাইভ মিউজিক, পাশে রাতের সমুদ্র—বেশ উপভোগ্য সন্ধ্যা কাটিয়ে আমরা ফেরত এলাম রিসোর্টে।
রিসোর্টে ফিরে বারান্দায় চেয়ার টেনে বসলাম সাগরের মুখোমুখি। চিন্তা তখন ইতিহাসের গলিঘুপচি ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোয়ার নাম আদিতে ছিল গোভাপুরি। আরব ভূবিশারদেরা একে চিনত সান্দাবুর হিসেবে। আর পর্তুগিজরা একে ডাকত ভেলহা গোয়া বলে। ১৫১০ সালে জেনারেল আফোনসো দে আলবুক্যুর্কের নেতৃত্বে গোয়া আক্রমণ করে পর্তুগিজরা। সে সময় তাদের কাছে বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন গোয়ার সুলতান ইউসুফ আদিল খান। তিন মাস পর ৬০ হাজার সেনা নিয়ে পর্তুগিজদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন ইউসুফ। কিন্তু কয়েক মাসের মাথাতেই পর্তুগিজ আফোনসো বিশাল সেনাদল এনে চিরতরে স্থানীয় শাসককে উৎখাত শুধু নয়, এই অঞ্চলের প্রায় সকল মুসলমানকে হত্যা করেন এবং গোয়ার গভর্নর হিসেবে হিন্দু তিমোজাকে নিয়োগ দেন। আর আফোনসো হন গোয়ার প্রথম ডিউক। এশিয়ার ভেতর গোয়াই ছিল পর্তুগিজদের প্রথম দখলকৃত ভূখণ্ড।
ভারতের মাটিতে পর্তুগিজদের আসার পথটি দেখিয়েছিলেন পর্যটক ও নাবিক ভাস্কো দা গামা। ১৪৯৮ সালে প্রথম তার নৌবহর নোঙর ফেলে কালিকট বন্দরে, মানে এখনকার কেরালায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যই ভাস্কো দা গামা দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে ভারতে আসার পথ আবিষ্কার করেন। কিন্তু পরবর্তী শতকেই সেটি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে আটকে থাকেনি। অর্থনৈতিক লুটপাট ও সামাজিক জুলুমে পরিণত হয়েছিল। খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দেওয়ার বীভৎস চেষ্টাও চলে। ইংরেজরা যেমন শাসন করত বিভাজিত করে, পর্তুগিজদের শাসন করার কৌশল ছিল একত্র করে। ডিভাইড অ্যান্ড রুল নয়, পর্তুগিজরা চাইত ইউনাইট অ্যান্ড রুল। ওই কারণেই ধর্মান্তরে অতটা মনোযোগী ছিল তারা। তাদের সকল আগ্রাসনের ভেতর একটি ভালো কাজ ছিল গোয়া থেকে সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করা।
সাড়ে চার শ বছর শাসনের ফলে গোয়ার পরতে পরতে পর্তুগিজ স্থাপনার ছাপ স্পষ্ট। বলে রাখি, ১৯৪৭ সালে দুই নম্বর বিশ্বযুদ্ধ শেষে, ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও গোয়া ছাড়তে নারাজ ছিল পর্তুগিজ শাসকেরা। পরে ১৯৬১ সালে বিশাল সামরিক অভিযান চালিয়ে গোয়া থেকে পর্তুগিজ শাসকদের বিদায় হতে বাধ্য করা হয়। ভারতীয় তিন বাহিনীর ছত্রিশ ঘণ্টার সেই সমন্বিত সামরিক অভিযানের নাম রাখা হয়েছিল ‘অপারেশন বিজয়’। ভারত বিজয় লাভ করেছিল শুধু সামরিক জোরে নয়, পর্তুগিজদের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং স্থানীয় গোয়াবাসীদের ক্ষোভের কারণেও। তো, মাত্র বাষট্টি বছর আগে বিদায় নেওয়া শাসকদের ছাপ ওই অঞ্চলে এখনো থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। অবশ্য আমরা ঘুরতে ঘুরতে জানলাম, পর্তুগিজ রীতিতে গঠিত যে ঘরবাড়ি, সেগুলো ঐতিহ্য হিসেবেই সংরক্ষণ করতে চায় স্থানীয় প্রশাসন। এর পেছনে রয়েছে পর্যটন ব্যবসা। লোকজন ভারতের এই এলাকায় ঘুরতে এসে যেন এক টুকরো পর্তুগিজ সংস্কৃতির দেখা পায়।
এ কারণেই, পানজিম, গোয়ার রাজধানী, এখনো সংরক্ষণ করছে ঔপনিবেশিক পর্তুগিজ বাড়ির নকশা। তারা ইতিহাসকে ধরে রাখতে চায়, ইতিহাস যত নিষ্ঠুরই হোক না কেন। মান্দবি নদীর তীরে গড়ে ওঠা এ শহরে নতুনত্বের ছোঁয়া লাগলেও পুরোনোকে তারা অস্বীকার করতে নারাজ। ঢাকাকে যেমন মসজিদের নগর বলা হয়, গোয়াকেও তেমনি বলা যায় গির্জার অঞ্চল। একসময় যেভাবে এখানে জেসুইট সম্প্রদায় ও স্থানীয় পর্তুগিজ প্রশাসন ধর্ম চাপিয়ে দিয়েছে, মন্দির ও দেবতার মূর্তি ধ্বংস করে গির্জা বানিয়েছে, তাতে এটা হওয়ারই কথা।
পরদিন বেরোলাম গোয়া দর্শনে। যাত্রার শুরুতেই কিছু কেনাকাটা হলো। সবচেয়ে দামি জিনিসটা কিনলাম আমি। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকা ‘শেষভোজ’ চিত্রকর্মের আদলে বানানো ব্রোঞ্জের মূর্তি, পাঁচ হাজার রুপি। দেখেই চোখ আটকে গিয়েছিল, অগত্যা কিনে ফেললাম। মনিও সাহস জুগিয়েছিল। পরে দোকান থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেকের ভেতর দেখা মিলল পানজিমের বিখ্যাত ইমাক্যুলেট কনসেপশন চার্চের। এখানে সিনেমার শুটিং হয় দেদার। ‘জোশ’, ‘দিলওয়ালে’, ‘সিম্বা’ প্রভৃতি সিনেমার দৃশ্যে এই গির্জার দেখা মেলে। আমরা চেষ্টা করেছিলাম ভেতরে ঢোকার; দেখলাম সর্বসাধারণের জন্য গির্জাটি তখন বন্ধ। কাজেই বাইরের প্রাঙ্গণেই একটু ঘোরাঘুরি করলাম।
ফার্নান্দেজ আমাদের সারা দিনের গাইড ও গাড়িচালক। বেশ অমায়িক। আমরা গির্জার আশপাশ দেখে গাড়িতে উঠেই দেখি পাশে একখানা পুরোনো বইয়ের দোকান। ফার্নান্দেজকে বললাম, ইউটার্ন নিয়ে যেন একটু গাড়িটা থামান। লোকটা হাসিমুখে তা মেনে নিলেন। বইয়ের দোকানে ঢুকে তেমন কিতাবের দেখা মেলেনি। দুটি বই অবশ্য কেনা হলো মনের জন্য। কার্টুনের বই। সেখান থেকে বেরিয়ে পুরোনো গোয়ার দিকে গেলাম। আমাদের পুরান ঢাকার মতো নয়; বেশ গোছানো ও পরিচ্ছন্ন। সারা দুনিয়ার খ্রিস্টভক্তরা এখানে আসেন, চার শ বছরের পুরোনো, ব্যাসিলিকা অব বম জেসাস গির্জায়। বম জেসাস মানে শিশু যিশু। সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ারের দেহাবশেষ এখানকার মূল আকর্ষণ।
সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ার জন্মগ্রহণ করেন স্পেনে, ১৫০৬ সালে। প্যারিসে তিনি দর্শনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে। এরপর কিছুদিন কলেজ অব ব্যুভেতে দর্শনের ওপর শিক্ষকতা করেন। ধর্মযাজক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ফ্রান্সিস জেভিয়ারের ছিল না। কিন্তু ইগনেশিয়ুস অব লয়োলা ও পিটার ফেবারের সঙ্গে গড়ে ওঠা বন্ধুত্ব তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। অধ্যাত্মজীবন শুরু হয় তার। তিনজন মিলে গঠন করেন ‘যীশু সমাজ’, যা আজ জেসুইট সম্প্রদায় নামে প্রসিদ্ধ। জেভিয়ারের ওপর দায়িত্ব পড়ে পর্তুগিজ উপনিবেশগুলোতে ধর্ম প্রচারের। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে এ কারণেই তার আসা। জাপানেও গেছেন দুবার; চীনেও ধর্মপ্রচারের চেষ্টা করেছেন। তবে চীনের মূল ভূখণ্ডে তাকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে চীনা দ্বীপ সানচিনে ১৫৫২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান। বালিতে কবর দেওয়ার বদলে ক্যালিসিয়াম অক্সাইড দিয়ে তার দেহ সংরক্ষণ করা হয়। এর বছর দুই বাদে, ১৫৫৪ সালে, ভারতের গোয়াতে তার এই মৃতদেহ আনা হয়। বর্তমানে সাধু ফ্রান্সিস জেভিয়ারের দেহাবশেষ বম জেসাসের গির্জার এক বিশেষ বেদিতে রাখা আছে। তাকে দেখতেই এখানে প্রতিদিন লাখো ভক্তের ভিড় হয়। উপমহাদেশীয় খ্রিস্টভক্তদের জন্য এই গির্জা অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আমার বাবাও, আমি যখন অনেক ছোট, তখন এই গির্জা পরিদর্শন করে গিয়েছিলেন।
ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এই জেসুইট গির্জা গোয়ার ভেতর বারুক ও পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। শুধু তা-ই নয়, বিশ্বে পর্তুগিজ ঐতিহ্যকে ধারণ করা সাত বিস্ময়ের একটি। ১৫৯৪ সালে একটি শিবমন্দির ভেঙে এই গির্জার নির্মাণকাজ শুরু হয়। আর এ কারণেই এখন পর্যন্ত গির্জার চূড়ায় ক্রুশ বসানো সম্ভব হয়নি। স্থাপনার কাজ শেষ হয় ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে। খ্রিস্টানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনার ভেতরে আমরা সারিবদ্ধ হয়ে ঢুকলাম। সকল প্রার্থনালয়ের মতো এখানেও সেই একই রকম শান্তিময়, নীরব পরিবেশ। দেয়ালে কিছু চিত্রকর্ম রয়েছে, যেখানে তুলে ধরা হয়েছে যিশুর ক্রুশবহন ও যাতনাভোগের চিত্র। মনে মনোযোগ দিয়ে আমাদের সঙ্গে চিত্রকর্ম দেখল, আর প্রশ্ন করে করে বোঝার চেষ্টা করল।
গির্জার পাশেই রয়েছে একটি ছোট সুভ্যেনির শপ। সেখান থেকে মায়ের জন্য জপমালা কিনলাম। নিজের জন্য কিনলাম সাধু জেভিয়ারের জীবনীগ্রন্থ। খ্রিস্টানদের তীর্থস্থান থেকে এবার আমাদের গন্তব্য হিন্দুদের তীর্থস্থানে। ফার্নান্দেজকে নিয়ে চললাম মাঙ্গেসি ট্যাম্পেলে। পানাজি থেকে এটি ২১ কিলোমিটার দূরে। এটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সাড়ে চার শ বছরের পুরোনো মন্দিরটি উৎসর্গ করা দেবতা শিবকে। গাড়ি এসে থামল একটা খোলা জায়গায়। পার্কিং এরিয়া। ওখান থেকে হেঁটে যেতে হবে। প্রখর রোদ। হেঁটে যেতে লাগবে দশ কি বারো মিনিট। মনের জন্য চিন্তা। ঠিক হলো, ওকে ফলের রস আর পানি খাইয়ে, মাথায় টুপি পরিয়ে নেওয়া হবে। গাড়ি থেকে নেমেই আমরা আগে ডাবের পানি খেলাম। পানি কিনে নিলাম। এরপর আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম মন্দিরে। দেখলাম, মন্দিরের একাংশে সংস্কারকাজ চলছে। ধবধবে সাদা রং করা মন্দিরের গায়। ভেতরে ঢুকতে হলে জুতো খুলতে হবে। মনে কান্নাকাটি শুরু করে দিল, সে জুতো খুলবে না। কারণ, গরমে মন্দিরের বাঁধানো প্রাঙ্গণ তেতে আছে। খালি পা রাখা আসলেই মুশকিল। নিরুপায় হয়ে ছায়ায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখা হলো মাঙ্গেসি মন্দির।
মন্দিরের ভেতরে থাকা মাঙ্গেসি লিঙ্গটি আগে রাখা ছিল গোয়ার মর্মুগাওতে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি যখন পর্তুগিজদের আধিপত্য তুঙ্গে, চলছে খ্রিস্টধর্মের বাড়াবাড়ি, তখন মন্দিরটি বর্তমান স্থানে সরে আসে, ১৫৬০ সালে। তখন এই মাঙ্গেসি গ্রাম ছিল হিন্দু শাসকদের অধীনে। কাজেই মন্দিরটি টিকে যায়।
মাঙ্গেসি মন্দিরটি আসলে শিবের অবতার ভগবান মাঙ্গেসের নামে। পুরাণে পাওয়া যায়, শিব একবার বাঘ সেজে স্ত্রী পার্বতীকে ভয় দেখান। তখন পার্বতী আতঙ্কিত হয়ে শিবকে ডাকেন ‘ত্রাহি মম গিরীশ’ বলে, মানে ‘হে মহাদেব রক্ষা করো’। গিরীশ শিবেরই আরেক নাম: গিরি অর্থাৎ পর্বতে শয়ন করেন যিনি। ডাক শুনে শিব আবার আসল রূপে ফিরে আসেন, পার্বতী শান্ত হন। পার্বতীর সেই ডাক ‘মম গিরীশ’ থেকে ‘মাঙ্গেরিস’ হয়ে ‘মাঙ্গেস’ শব্দটির উদ্ভব। এই মন্দিরের ভেতরে মাঙ্গেসি, শিবের অবতারের পুজোই করা হয়। ভেতরে ঢুকতে না পারলেও, পাশে থাকা ক্যানটিনে ঢুকে শীতল হলাম। চোখেমুখে ঠান্ডা পানি দিলাম। এরপর বেরিয়ে এলাম মন্দির থেকে। পার্কিং এরিয়া থেকে মন্দির পর্যন্ত রাস্তাটির পাশে অসংখ্য ছোট ছোট দোকান। ওখানে নানা ধরনের টি-শার্ট, অলংকার, সুভ্যেনির পাওয়া যায়। মনের মা কী কী যেন কিনল! তার ভেতর গোয়া লেখা একটা মগও আছে।
গাড়িতে উঠেই ফার্নান্দেজকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাদের কি বেশি দেরি হয়ে গেছে?’ উনি হাসিমুখে বললেন, ‘একদমই না।’ আমরা এখন যাব একটা মসলার গ্রামে। মাঙ্গেসি গ্রাম থেকে আধঘণ্টার পথ। সেখানেই দুপুরের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। মসলার গ্রামটির নাম সাহাকারি স্পাইস ফার্ম। আসলে ওটা গ্রাম নয়; বিশাল ঘের দেওয়া জায়গা, একটা খামারের মতো। কিন্তু স্থানীয় লোকজন একে মসলা গ্রাম বলে।
ভেতরে ভেতরে চিন্তা হচ্ছিল, মসলার গ্রামে গিয়ে মনের ভালো লাগবে কি না। তবে আমার বিশ্বাস, ওকে ওর মতো করে গল্পটা বলতে পারলে, ও উপভোগ করবে। আমার অনুমান ঠিকই ছিল। আমরা আধঘণ্টার ভেতর পৌঁছে গেলাম। গ্রামে ঢুকতে গেলে টিকিট কিনতে হয়। জনপ্রতি ৪০০ রুপি। টিকিট কিনে একটি সবুজে ঘেরা তোরণের নিচ দিয়ে, ছোট কাঠের সেতু পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হলো আমাদের। প্রথমেই বিশাল খাবারের জায়গা। দেখে মনে হবে লঙ্গরখানা। অনেক মানুষ খাচ্ছে। এক পাশে সারি করে রাখা গোয়ার সব স্থানীয় খাবার। মাছ-মুরগি-মিষ্টান্ন—সবই আছে। তবে গোয়ানিজ তরিকায় রান্না করা। বলা বাহুল্য, সবগুলো পদই সুস্বাদু। আমরা তৃপ্তি নিয়ে খেলাম। পাশে ঝুলিয়ে রাখা ছিল কলার ছড়া। চম্পা কলা। নরেরা বানরের মতো কলা ছিঁড়ে খাচ্ছে সেখান থেকে। অনেক শ্বেতাঙ্গ মানুষও দেখলাম এখানে বেড়াতে আসে।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলে একটি ছাউনিতে বসতে হয়। আট-দশজন অতিথিকে নিয়ে একজন গাইড ফার্মটি ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যান। আমরা যখন শুরু করলাম, মনেকে বললাম, ‘বাবা, আমরা এখন জঙ্গলে অ্যাডভেঞ্চার করতে যাচ্ছি।’ মুহূর্তেই মুড অন হয়ে গেল মনের। চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, ‘ইয়াহু, আমরা অ্যাডভেঞ্চারে যাচ্ছি!’ ব্যস, ওকে নিয়ে আর ভাবতে হয়নি। প্রাকৃতিক আবহে বেড়ে উঠতে দেওয়া বিপুল উদ্ভিদ ও এর বিন্যাস যেভাবে করে রাখা হয়েছে, তাতে জঙ্গল অভিযানের কথাই মনে পড়বে।
১৩০ একরের জমিতে শুধু মসলা আর নানা ঔষধি গাছ। এখানে এলে অনুধাবন করা যায় প্রকৃতি মানুষকে রোগবালাই দিয়েছে, কিন্তু প্রতিষেধকও সে দিয়ে রেখেছে। মানুষ সেসবের আর হদিস রাখে না। প্রকৃতি বিচিত্র রকম গাছ ও অমূল্য ওষুধ নিয়ে বসে আছে। আমরা শুধু প্রাকৃতিক নিদানটা আর মনে রাখিনি। মানুষ স্বাস্থ্য রক্ষার চেয়ে, প্রকৃতি নিয়ে ব্যবসার দিকে মনোযোগ দিয়েছে বেশি। মানবিক বোধের চেয়ে মুনাফা বেশি পরিচালিত করেছে মানুষকে। নয়তো হাজার হাজার জলপথ পাড়ি দিয়ে ভাস্কো দা গামা এখানে নোঙর ফেলবেন কেন? আর কেনই-বা মসলার যুদ্ধ হবে? এখানে এলে এসব প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পাওয়া যাবে।
কত দামি মসলা যে রয়েছে এই খামারে: ভ্যানিলা বা অর্কিড, দারুচিনি, জায়ফল, এলাচি, মরিচ, গোলমরিচ, লবঙ্গ, কারি পাতা, হলুদ, আদা ইতি ও আদি। সব কটি গাছ ও মসলার গুণাগুণ সম্পর্কে যখন আমাদের বলা হচ্ছিল, আমরা খুবই আশ্চর্য হচ্ছিলাম। প্রকৃতিই আসলে বড় চিকিৎসক। শুধু ব্যবহারবিধিটা জানতে হবে। দুঃখ লাগে, আমরা এখন কৃত্রিম উপায়ে রাসায়নিক দ্রব্য দিয়ে ওষুধ বানাই। অথচ মানুষ প্রকৃতির অংশ, সে প্রকৃতিকেই ভুলে বসে আছে!
মসলার গ্রাম থেকে বেরোনোর আগে পিঠে একধরনের তরল ঢেলে দেওয়া হয়, প্রশান্তির পরশ যাকে বলে। সাইট্রোনেলা ও ল্যাভেন্ডার অয়েল দিয়ে বানানো সেই তরল। আর গলায় ঢালার জন্য দেওয়া হয় ‘গরল’; ৪৩-৪৫ শতাংশ তার অ্যালকোহল, নাম ফেনি। সংস্কৃত শব্দ ‘ফেনা’ থেকেই এই নামের আবির্ভাব। দুই ধরনের ফেনি হয়: কেশ্যু ফেনি ও কোকোনাট ফেনি। সাদা পানির মতো জিনিস; ঝাঁকালে ফেনা, তাই ফেনি। আমরা কেশ্যু ফেনি গলায় ঢেলে বুঝেছি এই তরলের মালমসলায় কী ঝাঁজ! মনে খেতে চেয়েছিল, কিন্তু তাকে জুস কিনে দেওয়া হলো।
বিকেলের রোদ হেলে পড়তে শুরু করেছে। ঘড়িতে চারটা ছাড়িয়ে গেছে। সিদাদ দে গোয়াতে ফেরার পালা। আমরা রিসোর্টে ফিরে সুইমিংপুলে ডুব দিয়ে রাতের খাওয়ার জন্য বেছে নিলাম রিসোর্টের কাছেই, রাস্তার একেবারে উল্টো দিকের একটি রেস্তোরাঁকে। সেখানে চেনা পরিচিত খাবারই খাওয়া হলো।
পরদিন ঠিক হলো নৌভ্রমণ করা হবে। মনে খুব উত্তেজিত। সকালের নাশতা সেরে দুপুর পর্যন্ত রিসোর্টের সামনে থাকা ভ্যানগুইনিম বিচের সৌন্দর্য দেখা হলো। রিসোর্টের নাশতার কথা না বললেই নয়। এখানে মনি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছে দোসা। আর মনের মনে ধরেছিল ওয়াফেল। যাহোক, সেদিন নাশতা খেয়ে মনে বাইরে গিয়ে জুসবারে বসে একটি অরেঞ্জ জুস খেলো। আর জিজ্ঞেস করল, ‘বিকেলে যে রিভার ক্রুজে যাব, এটি বড় কোনো জাহাজে হবে?’ আমি বললাম, ‘গেলেই দেখতে পাবে।’
আমরা দুপুরে বেরিয়ে সাবওয়ে থেকে খাবার খেয়ে নিলাম। তারপর মান্দবি নদীর দিকে যাত্রা করলাম। সরাসরি আগে নৌভ্রমণের জন্য টিকিট কিনলাম। ৫০০ রুপি করে একেকজনের। দেড় ঘণ্টার ভ্রমণ, শুরু হবে সন্ধ্যা ৬টায়। আমাদের হাতে তখনো দেড় ঘণ্টা বাকি। ঠিক করলাম পানাজিতেই যাই বরং। সেখানে দোকানপাট আছে। রিসোর্ট থেকে আনা গাড়িতেই আমরা গেলাম পানাজিতে। সেখানে গিয়ে পুরোনো বইয়ের সেই দোকানটাতেই আবার ঢুকলাম। ১৮৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দোকান, সিংবল বুক শপ। চাট্টিখানি কথা নয়! দুটি বই কেনা হলো। অন্য দোকান থেকে মনের জন্য একটা রোদচশমা কেনা হলো। পানাজির এই সারিবদ্ধ দোকানপাট থেকে নদীর ঘাটে যেতে লাগে পনেরো মিনিট। ঠিক হলো হাঁটতে হাঁটতেই যাব। শহরটা দেখা হবে। আমরা নদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটা শুরু করলাম।
একটা সময় অটল সেতু পেরোলাম। এই ঝুলন্ত সেতু পানাজি আর পরভরিমের যোগসূত্র। সেতু পেরিয়ে নৌবিহারের উদ্দেশ্যে মাঝারি দোতলা জাহাজে পা রাখলাম। জাহাজের নাম প্রিন্সেসা দে গোয়া পিএনজি ৩২৬। সূর্যাস্তের কাল। মান্দবি নদী বেয়ে আমরা যাচ্ছি। জাহাজের দোতলায় রয়েছে মঞ্চ। সেখানে পরিবেশন করা হলো গোয়ার স্থানীয় নৃত্যগীত। নদীর দুধারের সৈকত ও স্থাপনা সম্পর্কে বয়ান চলছে মাইকে। ভাসতে ভাসতে একসময় পৌঁছে গেলাম আরব সাগরের মোহনায়! যেতে যেতে দেখা হলো রেইস ম্যাগোস ফোর্ট ও ফোর্ট আগুয়াডা। আরেকটু দূরে মিরামার সৈকত। সাগরের মোহনায় কিছুক্ষণ থেকে সূর্যডোবা দেখলাম আমরা। এরপর আবার একই পথে ফিরতে শুরু করলাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে নদীর জলে। ফিরতি পথে দেখলাম আলো ঝলমলে ভাসমান ক্যাসিনো। মনে বলল, ‘বাবা, ক্যাসিনো কী?’ আমি বললাম, ‘লোকজন যেখানে পয়সা জলে ফেলে!’ মনে কিছুই বুঝল না। যাক! ডাঙায় নেমে গেলাম মিরামারের নামকরা রেস্তোরাঁ দ্য ফিশারম্যানস হোয়ার্ফসে। এরা মৎস্য বেচলেও, বেশ ভালো বিফ স্টেক বানায়। ওয়াইন সহযোগে বেশ উপাদেয়। পরিবেশটি আরও একধাপ সুন্দর করে দিয়েছিল গানবাজনা। গায়িকা একে একে সব পরিচিত গান গাচ্ছিলেন। খাইদাই শেষ করে যখন চলে আসব, জন ডেনভার ভর করেছেন তার কণ্ঠে: ‘কান্ট্রি রোড টেক মি হোম…।’
পরের দিন ঠিক বাড়ি ফেরার পালা নয়। গন্তব্য কলকাতা। সেখানে দুদিন থেকে তারপর বাড়ি। গোয়ার বর্ণিল ও উজ্জ্বল রিসোর্টে শেষ দিনের নাশতা সেরে আমরা গাড়িতে উঠলাম বিমানবন্দরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। যেতে যেতে ভাবলাম, সাগরপাড়ের এই অঞ্চল পর্যটনের ওপর ভর করে কী দারুণভাবে টিকে আছে, কক্সবাজারেরও সে রকম সম্ভাবনা ছিল। পৃথিবীর দীর্ঘতম সৈকত আছে সেখানে। কিন্তু কক্সবাজারকে আমরা বানিয়ে রেখেছি অনিরাপদ ও অপরিষ্কার। আরও আছে হোটেলের জঞ্জাল আর বিরক্তিকর হকারের ভিড়। আমরা বোধ হয় কোনোকালেই কিছু শিখব না বলে ধনুর্ভঙ্গ পণ করে রেখেছি!
সহায়
১. হিউ অ্যান্ড কোলিন গ্যানজার, ডিসকভারিং গোয়া, (দিল্লি: জেভিয়ার কোলাকো, ২০০১)
২. দেলিয়ো মেনদোনসা, সেইন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ার, (গোয়া: নিউ এইজ প্রিন্টার্স, ২০১৮)
ছবি: লেখক