টেকসহি I মানবতার মানচিত্র
১৯ আগস্ট। ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিটারিয়ান ডে। মানবতার চিত্র কেমন এ জগতে?
সালিম। সিরিয়ায় শরণার্থীশিবিরে বেড়ে ওঠা এক শিশু। সমবয়সীদের সঙ্গে খেলার বয়সে নিত্যনতুন বোমার শব্দ শুনে, ঝাঁজালো গন্ধ নাকে নিয়ে ধ্বংসস্তূপে তার বেড়ে ওঠা। এক যুগের বেশি সময় ধরে চলা সিরিয়ান সংঘাতে সালিমের মতো অনেক শিশুই বঞ্চিত হয়েছে স্বাভাবিক শৈশব থেকে। শরণার্থীশিবিরগুলোতে যেখানে মোটে ১০ হাজার মানুষ থাকার কথা, সেখানে ঠাঁই হয়েছে ৫০ হাজারের বেশি জনের। ধেয়ে আসা মিসাইল আর স্নাইপারের আড়ালেই জীবন কাটছে তাদের। বোমা হামলা, খাবার ও পানির অভাব; সেই সঙ্গে প্রিয়জনকে হারানোর দুঃসহ স্মৃতি। এ নিয়েই শিবিরগুলোতে বেঁচে আছেন তারা।
দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের কারণে সিরিয়ার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশকে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে হয়। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১১ সাল থেকে এ বছর পর্যন্ত ১৩ মিলিয়ন মানুষ নিজ বাসস্থান থেকে অভ্যন্তরীণভাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬ মিলিয়নই শিশু। ২০২৩ সালের বৈশ্বিক শান্তি সূচকে ১৬৩টি দেশের মধ্যে ১৬১ নম্বরে রয়েছে সিরিয়া। ১৬২ ও ১৬৩ নম্বরে যথাক্রমে ইয়েমেন ও আফগানিস্তান। শরণার্থীশিবিরে আসা এই মানুষগুলোকে নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের অবদানও কম নয়। শরণার্থীরা যেমন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর শঙ্কায় থাকেন, তেমনি তাদের নিয়ে সরাসরি কাজ করা মানুষগুলোও থাকেন একই পরিস্থিতিতে।
সময়টা ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট। বাগদাদে জাতিসংঘ ভবনে এক সন্ত্রাসী বোমা হামলায় নিহত হন ২২ জন। তাদের বেশির ভাগই ছিলেন ইরাকে মানবিক মিশনের সঙ্গে জড়িত। তাদের সেই আত্মত্যাগ স্মরণীয় করে রাখতে জাতিসংঘ ২০০৮ সালে ১৯ আগস্টকে ‘বিশ্ব মানবতা দিবস’ (ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিটারিয়ান ডে) হিসেবে চিহ্নিত করে। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো এ দিবস পালিত হয়। প্রতিবছর জাতিসংঘ বিশ্ব মানবতা দিবসে স্মরণ করেন মানবতার সেই দূতদের, যারা বছরের পর বছর ধরে কাজ করছেন সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইয়েমেনসহ সংঘাত জর্জরিত দেশগুলো থেকে আসা শরণার্থীদের জীবনে একটুখানি আশার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে।
সম্প্রতি সিরিয়ার মানবিক বিপর্যয়ে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে প্রায় ৪৬ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে সিরিয়ার কাফর সুসা এলাকায় চালানো হয় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। তাতে নিহত ৫ জন। দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরায়েলিরা দামেস্ক ও এর আশপাশের এলাকা লক্ষ্য করে গোলান মালভূমি থেকে বিমান হামলা চালিয়েছে। মানবতার চরম বিপর্যয়ের এটাই কি সর্বোচ্চ সীমা? নাকি সামনের দিনগুলোতে আরও ভয়ংকর পরিবেশ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?
শুধুই কি সিরিয়া? উন্নত বিশ্বের দেশ ইউক্রেনের নাগরিকেরাও গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া রাশিয়ান সামরিক আগ্রাসনে জর্জরিত। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এই আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনের ৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর অর্ধেকের বেশি নিজ নিজ বাড়িঘর ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাস্তুচ্যুত ৪ দশমিক ৮ মিলিয়ন শিশুর মধ্যে ভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছে ২ মিলিয়ন। নারী ও শিশুরা সীমান্ত পেরিয়ে যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ পোল্যান্ড, রোমানিয়ায়। অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আশ্রয় নিতে গিয়ে পরিবারগুলো বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর খাদ্য, আশ্রয় এবং ওষুধ সরবরাহ করার জন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা।
সংঘাত থেমে নেই আফ্রিকাতেও। সুদানের দারফুর অঞ্চলে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে। প্রাপ্তবয়স্ক, এমনকি শিশুদের ওপরও করা হচ্ছে আক্রমণ। পশ্চিম দারফুরের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় সেখানে প্রাণহানির এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। সশস্ত্র বন্দুকধারীরা গ্রামে ঢুকছে, লুটপাট করছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, পলায়নরত বাসিন্দাদের ওপর চালাচ্ছে গুলি। এ যুদ্ধবিগ্রহ অঞ্চলগুলোতে কাজ করছেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হাজারও কর্মী। এমন সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম সেভ দ্য চিলড্রেন। সুদানের জেনিনা শহর থেকে পালিয়ে আসা এই সংস্থার কর্মীরা জানান, শিশুসহ শত শত মানুষের মৃতদেহ রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। নিহতদের অবস্থা এতই শোচনীয়, মৃতদেহগুলো শিশুর নাকি কোনো প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের, তা বোঝার উপায় নেই।
এই সহিংসতা জর্জরিত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পশ্চিম দারফুরে কাজ করা একজন মানবাধিকারকর্মী আহমেদ। সেভ দ্য চিলড্রেনের এই কর্মীর বিবৃতি থেকে জানা যায়, প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে স্নাইপারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি পাত্রে পানি ভরে নিয়ে আসতেন তারা। ৪৯ দিন গৃহবন্দি থেকে অবশেষে শহর ছেড়ে চলে আসতে পেরেছেন তিনি। আহমেদ যেদিন জেনিনা ছেড়ে আসেন, পুরো শহরে ছিল লাশের মিছিল। বাতাসে লাশের গন্ধ। পুরো শহরই পরিণত হয়েছিল ধ্বংসস্তূপে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের অনুমান, সেখানে ৫ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। জেনিনায় আরও চারটি স্কুল লুটপাট করে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো বেসামরিক লোক অবশিষ্ট নেই। সেনারা সব পালিয়ে গেছেন কিংবা মারা পড়েছেন।
এত কিছুর পরও কি থেমে থেকেছেন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মানবতাবাদী কর্মীরা? আহমেদের মতো আরও অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীকে বাঁচিয়ে রাখতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সুদানের শরণার্থীশিবিরগুলোতে। সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের (ডব্লিউএফপি) মতো সংস্থাগুলো খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষাসহ জীবন রক্ষাকারী সহায়তা প্রদানে কাজ করে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে।
বেশ কিছু বছর ধরে জাতিসংঘের মানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্বব্যাপী সমর্থন বেড়েছে। ২০২৩ সালে সংস্থাটি সারা বিশ্বে বাস্তুচ্যুত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণের জন্য জরুরি সেবা নিশ্চিত করা, বাস্তুচ্যুতদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সমর্থন আদায়, প্রয়োজনীয় সেবাগুলোর অ্যাকসেস বাড়ানো এবং ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার জন্য টেকসই সমাধান প্রচার করার ব্যাপারে গুরুত্ব দিয়েছে। জাতিসংঘের এ মানবিক প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন জানিয়ে এবং এসব দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নত দেশগুলো যথেষ্ট পরিমাণে তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। জাতিসংঘের সেন্ট্রাল ইমার্জেন্সি রেসপন্স ফান্ড (সিইআরএফ) জরুরি প্রতিক্রিয়া হিসেবে দ্রুত তহবিল দেওয়ার ক্ষেত্রে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গুরুতর সহায়তা প্রয়োজন এমন লোকদের জন্য সিইআরএফ এবং সিবিপিএফ (কান্ট্রি-বেসড পুলড ফান্ডস) মোট ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করেছে। গ্লোবাল হিউম্যানিটারিয়ান ওভারভিউ (জিএইচও) গত বছর মানবিক সহায়তাপ্রার্থী ২৭৪ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ১৮২ মিলিয়নকে সহায়তা করার জন্য ৫১ বিলিয়ন ডলারের প্রাথমিক তহবিলের প্রয়োজনীয়তা উপস্থাপন করেছে। হাইতি, কেনিয়া, মালাউই, মোজাম্বিক, পাকিস্তান ও ইউক্রেনে চলমান সংঘাতের ভিত্তিতে মানবিক চাহিদা পূরণে নতুন এ পরিকল্পনা সাজানো হয়। কিন্তু এত বড় পরিসরে তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনা থাকলেও গ্লোবাল হিউম্যানিটারিয়ান ওভারভিউ-এ ৫১ বিলিয়নের বিপরীতে প্রাপ্ত তহবিলের পরিমাণ ২৪ বিলিয়ন ডলার, যা প্রাথমিক পরিকল্পনার মাত্র ৪৭ শতাংশ। চাহিদা ও প্রাপ্ত তহবিলের মধ্যে ২৭ বিলিয়ন ডলারের তফাত! তহবিল নিয়ে পরিকল্পনা এবং এর বাস্তবিক প্রয়োগের মধ্যে যে ব্যবধান, তা শুধু জিএইচও নয়, অন্যান্য সংস্থার বেলায়ও ঘটছে।
তবে এদিক থেকে জরুরি খাদ্য সহায়তার পরিসর বাড়ানো, নারী ও শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন, স্থানীয় কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করা এবং সংকটপ্রবণ এলাকায় খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা বাড়াতে বেশ কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম। অনেক দেশে তার বাস্তবায়নও হচ্ছে। এ ছাড়া বাস্তুচ্যুত শিশুদের মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সুরক্ষা এবং মানসিক সমস্যায় সহায়তা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সেভ দ্য চিলড্রেন। তাদের উদ্যোগের মূল লক্ষ্য শিশুদের জন্য নিরাপদ স্থান তৈরি, শিশু পাচারসহ সারা বিশ্বেই শিশুশ্রম বন্ধ এবং বাস্তুচ্যুত শরণার্থীশিবিরে বেড়ে ওঠা শিশুদের অধিকারের প্রশ্নে সমর্থন জোগানো।
জাতিসংঘ, ডব্লিউএফপি এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ছাড়াও বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীগুলোর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যোগ দিয়েছে। তাদের সরবরাহ করা মানবিক সহায়তা প্রচেষ্টার প্রভাব ও সাফল্য পরিমাপ করতে সংস্থাগুলো তথ্য সংগ্রহ করেছে এবং সেগুলো প্রতিনিয়ত নিরীক্ষণ করছে। মানবিক কাজের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিশ্চিত করতে নিয়মিত মূল্যায়ন এবং রিপোর্টিং প্রক্রিয়া চালু রয়েছে এসব সংস্থায়। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে এসব শরণার্থীশিবিরে থাকা মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি রাখছে না তারা।
স্বপ্ন দেখতে পারার মাহাত্ম্য অশেষ। তাই তো এখনো জগতের সবচেয়ে নির্মম বাস্তবতার শিকার এই শিশুদের আশা, তারা স্কুলে যাবে। নিক্ষিপ্ত মিসাইলের ধ্বংসাবশেষে থেকেও স্বপ্ন দেখে নতুন পৃথিবীর। যে পৃথিবীতে মানচিত্রের বেড়াজাল ভেদ করে এই শিশুরা উদ্বাস্তু হিসেবে নয়, বেড়ে উঠবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট