যাপনচিত্র I স্মৃতির সেতু
সোহানা সাবা। অভিনেত্রী। মডেল। নৃত্যশিল্পী। ১৯৯৮ সাল থেকে মিডিয়ায় পথচলা। কেমন তার একান্ত জীবন?
কিছুদিন আগেও সোহানা সাবার ঘুমের রুটিন ছিল অগোছালো। ঘুমাতে যেতেন রাত ২-৩টায়! সকালে ঘুম থেকে উঠেই তাড়াহুড়ো করে কাজে বেরিয়ে যেতে হতো। কোভিডের শুরুর দিকে জীবনযাপন এভাবেই চলছিল। অতিমারির সেই সময় রাত জেগে দেখতেন টিভি সিরিজ। একসময় উপলব্ধি করলেন, নিয়মানুবর্তিতা ফিরিয়ে আনা দরকার। ঘুমাতে যাওয়া শুরু করলেন রাত ১২টার মধ্যেই।
ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘প্লিজ গ্র্যান্ট মি কফি টু চেঞ্জ দ্য থিংস আই ক্যান, অ্যান্ড ইয়োগা টু অ্যাকসেপ্ট দ্য থিংস আই ক্যান্ট’। কথাটি সাবার সঙ্গে কতটুকু মেলে, তা বলা না গেলেও তার সকাল শুরু হয় এক কাপ কফি নিয়ে ইয়োগা করার মধ্য দিয়ে। সাধারণত সকাল ৭টার মধ্যেই ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর ১০ মিনিটের জন্য হলেও একটি মেডিটেশন সেশন করেন। এরপর সুরিয়া নমস্কার, প্রাণায়াম (দম বা শ্বাস-প্রশ্বাস সম্পর্কিত যোগচর্চা) করেন। সম্প্রতি ভারতের স্পিরিচুয়াল সিটি ঋষিকেশে ইয়োগা সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সেখানে জানতে পেরেছেন, ইয়োগার আসলে তিনটি পার্ট—মেডিটেশন, যা তিনি ২০০৬ সাল থেকে করে আসছেন; প্রাণায়াম, এবং সর্বশেষটি প্রচলিত শারীরিক কসরত, ইয়োগা বলতে সর্বসাধারণ যেটিকেই চেনে। মেডিটেশন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে করা চাই। সেই সঙ্গে বাকি দুটি পার্ট করা হয় প্রতিদিন সময়মতো। পুরো প্রক্রিয়ায় কিছুটা পানি পান করা চাই।
সাবা ব্রেকফাস্ট সারেন ১০-১১টার দিকে। মেনুতে থাকে কুসুমসহ ডিম, কলা আর একটি রুটি। খাবার ব্যাপারে তার বডি ক্লক খানিকটা ফিক্সড। বেলা ২টায় সারেন মধ্যাহ্নভোজ। পাতে রাখেন পর্যাপ্ত ভাত, সবজি, ডাল ও মাছ। এই তারকা বলেন, ‘অনেকের ধারণা, শুধুই ডায়েট কিংবা ইয়োগা করে বডি ফিট রাখা সম্ভব। আসলে তা নয়। পুষ্টিমান বিবেচনা করে খাবার খেলে তবেই শরীর ফিট ও সুস্থ থাকে। এই যেমন আমাকে এক বসায় কেউ চাইলেও একটির বেশি রুটি খাওয়াতে পারবে না। তবে সবজি খাই প্রচুর। এতে চুল, ত্বক থেকে শুরু করে দেহের সবকিছুর জন্য যেমন উপকার মেলে, তেমনি বাড়তি মেদ জমার শঙ্কা থাকে না। সেই সঙ্গে ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় থেকে এখনো প্রতিদিন দুধ, ডিম ও কলা খাই, যা বিশেষত নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষ উপকারী। ভাজাপোড়া পুরোপুরি এড়িয়ে চলি। প্রতিদিন ২ থেকে ৩ লিটার পানি পান করা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।’
এই অভিনেত্রীর জীবনের বড় অংশজুড়ে রয়েছে সন্তান স্বরবর্ণ। সে জীবনে আসার পর আট বছরে সাবার জীবনদর্শন অনেকখানি বদলে গেছে। বিয়ের আগেই, পরিবারের ছোট ভাই-বোনেরা বড় হয়েছে তার হাত ধরে। স্বরবর্ণকে সেভাবে সময় দিতে পারেননি। ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় সন্তানকে রেখে বাসার বাইরে, এমনকি জন্য শহর ও দেশের বাইরেও যেতে হয়েছে তাকে। তবে সন্তানের সঙ্গে ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার। জানালেন, নিজ সন্তান তাকে ‘সাবা’ বলেই ডাকে। সন্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘স্বরবর্ণ আমাকে মা বানিয়েছে, দায়িত্ব নিতে শিখিয়েছে। অনেক বন্ধুর সঙ্গে আমি দেশ-বিদেশে ঘুরেছি, স্কাই ডাইভিং থেকে শুরু করে নানা দুঃসাহসিক কাজ করেছি। আমার সন্তানের জন্যই এখন অনুভব করি, এত ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। দিন শেষে কেউ একজন আছে, যে আমার ওপর নির্ভর করে; আমিও ইমোশনালি কারও ওপর নির্ভরশীল।’ আরও বলেন, ‘বাচ্চা যত বড় হয়, তার সঙ্গে সম্পর্ক ও স্মৃতি তত বাড়তে থাকে; সম্পর্কের গভীরতাও। আমার ক্ষেত্রেও হয়েছে তা-ই।’
সাবার ফ্রেন্ড সার্কেল বেশ বড়। স্কুলজীবনে বন্ধুরাই ছিল তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংসারজীবন শুরু করার পর তাদের বেশির ভাগের সঙ্গে সেই বন্ধুত্ব আর টেকেনি। তবে সে সময়ের একজন বন্ধুর সঙ্গে এখনো টিকে আছে সুসম্পর্ক; যার নাম শাকিল। এ ছাড়া একই ধরনের জীবন-অভিজ্ঞতাসম্পন্ন অনেক নারীর সঙ্গে তার গড়ে উঠেছে অন্য রকম বন্ধুত্ব। ‘একসময় মনে হতো, ফ্যামিলির চেয়ে বন্ধুরা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে আমার অভিজ্ঞতা ভিন্ন। আরও পরে উপলব্ধি করেছি, মানুষ আসলে নিজেই নিজের প্রকৃত বন্ধু,’ বলে তিনি যোগ করেন, ‘অবশ্য এত চিন্তাভাবনা না করে জীবনে চলার পথে যার সঙ্গে যতটা সময় ভালোভাবে কাটানো যায়, তা-ই শ্রেয়।’
সাবার বাসা বেশ ছিমছাম ও গোছানো। বাসাজুড়ে সাদা রঙের আধিক্য। এতে তিনি চোখের প্রশান্তি খুঁজে পান। বাসার পরতে পরতে শোভা পায় নানা ওয়ালপেপার। ফার্নিচার বেশির ভাগই বোগো স্টাইলের। পছন্দসই ডিজাইনে কাস্টমাইজ করে বানানো।
ড্রেসআপ বা পোশাকের রং নির্বাচনে তিনি নিজের মেজাজের ওপর নির্ভরশীল। তবে স্যান্ডেল, জুতা, ব্যাগ, পারফিউম, ঘড়ি ও চশমার ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ফোকাস রয়েছে তার। নির্দিষ্ট কোনো ব্র্যান্ডে আটকে না থেকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন।
মেকআপেও ব্র্যান্ড প্রেফারেন্স তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে ত্বকের যত্নে সকালে ও রাতে মুখ ভালোভাবে ধুয়ে টোনার, ময়শ্চারাইজার ও সানস্ক্রিন ব্যবহার করা চাই। আর ঠোঁটের যত্নে ভেসলিন। সাবা বলেন, ‘আইল্যাশ একদম ব্যবহার করি না। মেকআপে মিনিমালিস্টিক। অনেক সময় কোনো মেকআপই করি না। তবে বাইরে কাজ থাকলে বেশির ভাগ সময় লিপস্টিকই ভরসা। আইব্রাও সব সময় পরিপাটি রাখি।’
সাবা জানালেন, সোশ্যাল মিডিয়ার তার পেজ মেইনটেইন করার জন্য রয়েছে আলাদা টিম। তবে চেষ্টা করেন সময় পেলে নিজে চেক করার। নিজস্ব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার বেশ উপভোগ করেন। অবশ্য ইদানীং বেশ মজা পাচ্ছেন ইনস্টাগ্রামে। ট্রেন্ডের সঙ্গে খাপ খাইয়ে টিকটক ব্যবহারও শুরু করেছেন সম্প্রতি।
অ্যাকসেসরিজের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় নোজ পিন, যা সব সময় সঙ্গে রাখেন। বাইরে গেলে ইয়াররিং ও ফিঙার রিংও পরেন। হেয়ার কাটে নির্দিষ্ট কোনো স্টাইল নেই। বব থেকে লং হেয়ার—সবই করেছেন। তবে বেশির ভাগ সময় চুল রাখেন মাঝারি আকারে।
তিনি বেশ ভ্রমণপিয়াসি। ১২-১৩টি দেশ ভ্রমণ করেছেন ইতিমধ্যে। স্মৃতি হাতড়ে জানালেন, লকডাউনের সময় একবার দুবাই ভ্রমণে বান্ধবী তিশা তার সঙ্গী হয়েছিলেন। শপিং করা তিশার খুব একটা পছন্দ না হলেও সাবার দিকে তাকিয়ে সম্মতি দিয়েছিলেন। চেক-ইন করতে গিয়ে টের পেলেন, তাদের ব্যাগের বাড়তি ওজন ৪ কেজি। পরে অন্য এক ব্যক্তির সহায়তায় সেই যাত্রায় বাড়তি চার্জ দিতে হয়নি। এ ছাড়া একবার ওমানে গিয়ে পড়েছিলেন বিপাকে। সেখানকার একটি দ্বীপে অন্য কিছু না পেয়ে চাটাইয়ের ওপর ইটে মাথা রেখে ঘুমাতে হয়েছিল তাকে। সকালে বোট এসে পৌঁছে দিয়েছিল কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। তবে দিন শেষে এসব স্মৃতি বেশ মজার বলেই গণ্য করেন সাবা।
ছোটবেলায় অসংখ্য বই পড়তেন। এখনো চেষ্টা করেন প্রতিদিন বই অথবা অন্য কিছু এক পাতা হলেও পড়ার। প্রিয় লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। গান শুনে অথবা সিনেমা কিংবা টিভি সিরিজ দেখে অবসর কাটাতে ভালোবাসেন। সুরেলা ধীরলয়ের গান পছন্দ। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে থাইল্যান্ডে আমেরিকান পপ-রক ব্যান্ড মেরুন ফাইভের কনসার্ট দেখা তার কাছে এক স্মরণীয় ঘটনা। বাল্যকালে শাহরুখ-অনুরাগী ছিলেন। এখন বেশি ভালো লাগে আয়ুষ্মান খুরানাকে। এ ছাড়া হলিউডে জর্জ ক্লুনির অনুরাগী তিনি।
নৈশভোজ ৭-৮টার মধ্যেই সেরে ফেলার চেষ্টা থাকে সাবার। রাতের মেনু বেশ ফ্লেক্সিবল; নির্দিষ্ট তেমন কিছু নেই। তবে ঘুমানোর আগে দুধ পান করা চাই।
জীবন নিয়ে সোহানা সাবার উপলব্ধি, সুস্থভাবে শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক ও শারীরিকভাবে কারও ওপর নির্ভরশীল না হয়ে জীবন কাটাতে পারলেই তিনি সুখী।
ফুয়াদ রূহানী খান
লোকেশন: লো মেরিডিয়ান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন