স্বাদশেকড় I স্যান্ডউইচ স্বাদ
ফাস্ট ফুড হিসেবে বেশ কদর এর। সুস্বাদু, তাই ভোজনরসিকদের প্রিয় খাবার। নেওয়া যাক এর ইতিহাসের পাঠ
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী। হিলেল দ্য এল্ডার ছিলেন ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী রাব্বি বা ধর্মযাজক। তার হাত ধরেই সে সময়ে প্রথম নথিভুক্ত স্যান্ডউইচটির আবির্ভাব ঘটে। দুটি মাতজোর [রুটিবিশেষ] মাঝখানে কাটা বাদাম, আপেল, মসলা ও ওয়াইনসিক্ত ভেষজ দিয়ে স্যান্ডউইচ খাওয়ার প্রথার সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তিনি। মাতজোর ভেতর ভরাট উপাদান মিসরীয়দের অত্যাচার থেকে ইহুদিদের মুক্তি পাওয়ার আগে কষ্টের একটি অনুস্মারক হিসেবে কাজ করেছিল। পাশাপাশি মিসরীয় ভবন নির্মাণে তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে ব্যবহৃত মর্টারের প্রতিনিধিত্বও করেছিল। ইহুদি ধর্মে হিলেলের প্রভাব ও মর্যাদার কারণে এই প্রথা সেডার বা ধর্মীয় আহারে যুক্ত করা হয়েছিল। তার নামে এর নামকরণ করা হয়েছিল হিলেল স্যান্ডউইচ।
ষষ্ঠ থেকে ষোড়শ শতাব্দী—মধ্যযুগে স্তূপ করা মাংস ও অন্যান্য উপাদান রাখার জন্য প্লেটের বদলে একধরনের মোটা বাসি রুটি ব্যবহার করা হতো, যেটির ছিল মোটা ব্লক। নাম ছিল ট্রেঞ্চার। এর ওপর থেকে ওই সব খাদ্য উপাদান আঙুল অথবা ছুরির সাহায্যে খেতেন ভোক্তারা। ট্রেঞ্চার পুরু ও বাসি রস, চর্বি ও সস শোষণ করে নিত। মূলত পাত্র হিসেবেই ব্যবহৃত হতো এই রুটি। এর ওপর পরিবেশন করা অন্যান্য খাবার খাওয়া শেষে কেউ কেউ ট্রেঞ্চারও খেয়ে নিতেন। তবে ক্ষুধা মিটে গেলে গ্রেভি-সিক্ত রুটিটি পোষা কুকুরকে খেতে কিংবা দরিদ্র মানুষকে ভিক্ষা হিসেবে দিয়ে দিতেন অনেকে। এ সময় ভিক্ষার অনুষঙ্গ হিসেবে পোশাক, খাদ্য ও অর্থের পাশাপাশি স্যান্ডউইচের ট্রেঞ্চার বেশ গ্রহণযোগ্যতা পায়।
ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে স্যান্ডউইচের চিত্র বুঝতে হলে নজর দেওয়া যেতে পারে ২০০৪ সালে প্রকাশিত মার্ক মর্টনের গবেষণাগ্রন্থ ‘ব্রেড অ্যান্ড মিট ফর গড’স সেক’-এর পাতায়। তিনি লিখেছেন, বর্তমান স্যান্ডউইচের সেই আদি রূপকে আসলে কী বলা হতো? আর্ল অব স্যান্ডউইচ আবির্ভাবের অনেক আগে রচিত শত শত পাঠ্য, বেশির ভাগ নাটক পর্যালোচনার পরে একটি সম্ভাব্য উত্তর পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, স্যান্ডউইচটি শুধুই ‘ব্রেড অ্যান্ড মিট’ বা ‘ব্রেড অ্যান্ড চিজ’ নামে পরিচিত ছিল। এই দুটি বাক্যাংশ ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজি নাটকে পাওয়া যায়। যেমন ধরুন, ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকের ‘লাভ অ্যান্ড ফরচুন’ নামের এক নাটকে একজন যুবক ব্রেড অ্যান্ড মিট ফর গড’স সেক বলে মিনতি করে। প্রায় একই সময়ে জর্জ পিলের ‘দ্য ওল্ড ওয়াইভস টেল’ নাটকের একটি চরিত্র স্বীকার করে নেয়, ‘আমি এক টুকরা ব্রেড অ্যান্ড চিজ নিয়ে ফিরে এসেছিলাম।’ শেক্সপিয়ার তার ‘দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর’ নাটকেও এই বাক্যাংশ ব্যবহার করেছেন, যেখানে নিম নামে একটি চরিত্র ঘোষণা করে, ‘আমি ব্রেড অ্যান্ড চিজের রসিকতা পছন্দ করি না।’ এর সামান্য পরে ‘দ্য নেভ ইন গ্রেইন’ নাটকে এক হকারকে ‘ব্রেড অ্যান্ড চিজ ম্যান’ নামে অভিহিত করা হয়। থমাস হেইউডের ‘দ্য রেপ অব লুক্রেস’ নাটকের সপ্তদশ শতাব্দীর সংস্করণে রাস্তার পথচারীদের কান্না নিয়ে গানের লিরিকে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘ব্রেড অ্যান্ড মিট…ব্রেড অ্যান্ড মিট’। একই যুগের আরও কয়েক ডজন নাটকে ‘ব্রেড অ্যান্ড মিট’ ও ‘ব্রেড অ্যান্ড চিজ’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৭৬২ সালের ২৪ নভেম্বর ব্রিটিশ লেখক, পণ্ডিত ও ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবন ‘স্যান্ডউইচ’ শব্দটির প্রথম লিখিত রূপ প্রকাশ করেন। দেশের সেরা ও ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে দু-একটি আহার দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি কোলাহলপূর্ণ কফি রুমে ছোট ছোট ন্যাপকিনে ঢাকা ছোট টেবিলে বসে তারা ঠান্ডা মাংস বা স্যান্ডউইচ খেয়ে সময় কাটাতেন। সেই সঙ্গে সেখানে নানা চলতি বিষয় ও বিভ্রান্তিকর রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতেন।’ গিবন আরও লেখেন, ‘আমি কোকোয়া ট্রিতে খেতাম। ব্রিটিশ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে জড়ো হতেন আড্ডা দিতে। যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষদের মধ্যে বিশ বা ত্রিশজন বসে আছেন, সামনে ছোট টেবিলে খাবার…একটু ঠান্ডা মাংস বা স্যান্ডউইচ।’
বলে রাখি, পল মল ও সেন্ট জেমস স্ট্রিটে অবস্থিত কোকোয়া ট্রি ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর লন্ডনের একটি ফ্যাশনেবল জেন্টলমেন’স গেমিং ক্লাব। সে সময়ে লন্ডনের গেমিং হাউসগুলোতে শুধু বাছাই করা ব্যক্তিবিশেষদের প্রবেশাধিকার ছিল, যেখানে একই ধরনের রুচি ধারণ করা সম্ভ্রান্ত শ্রেণির পুরুষেরা জড়ো হতে পারতেন। ১৭৪৬ সালে কোকোয়া ট্রি ক্লাব রাজনীতিবিদদের আড্ডাস্থলে পরিণত হয়, বিশেষ করে দ্বিতীয় চার্লসের কনজারভেটিভ রয়ালিস্ট সমর্থক গ্রুপ টোরিসের সদস্যরা ছদ্মবেশ নিয়ে চকলেট খেতে খেতে রাজনৈতিক চক্রান্ত সাজাতেন সেখানে। ১৭৫০ সালের পর জনসাধারণের পদচারণে মুখরিত স্থাপনাগুলোই শুধু টিকে ছিল। বেশির ভাগ উচ্চমানসম্পন্ন চকলেট হাউস পরিণত হয়েছিল ব্যক্তিগত ক্লাবে, যা মূলত উঁচু শ্রেণির লোকদের মধ্যে কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ ছিল।
এমনও বলা হয়, প্রথম স্যান্ডউইচ আবিষ্কার করেছিলেন লন্ডনের শেক্সপিয়ার ট্যাভার্নে অবস্থিত অভিজাত গেমিং ক্লাব, বিফ স্টেক ক্লাবের শেফরা। ওই ক্লাবের কার্যক্রম একচেটিয়াভাবে মাত্র ২৪ জন সদস্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এর ২৫তম সদস্য হয়েছিলেন তৎকালীন প্রিন্স অব ওয়েলস। সেখানে প্রচুর অ্যারাক-পাঞ্চের সঙ্গে গরুর মাংসের স্টেক খাওয়া হতো। ক্লাবের সদস্যরা নভেম্বর থেকে জুনের শেষাবধি প্রতি শনিবার বিকেল ৫টায় বৈঠক করতেন। একজন করে বন্ধুকে আমন্ত্রণেরও অনুমতি ছিল সদস্যদের।
জন মন্টাগু (১৭১৮-১৭৯২), ফোর্থ আর্ল অব স্যান্ডউইচ। ছিলেন অ্যাডমিরালটির (ব্রিটিশ নৌ বিভাগ) ফার্স্ট লর্ড। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আলাস্কা, হাওয়াই এবং পলিনেশিয়া অভিযানকারী ক্যাপ্টেন জেমস কুকের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। তার নামানুসারে হাওয়াইয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপের নামকরণ করেন কুক, স্যান্ডউইচ আইল্যান্ড। প্রখ্যাত ক্যাপ্টেন কুক আলাস্কা উপসাগরে প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডের প্রবেশপথে একটি বড় দ্বীপের নামকরণও করেছিলেন মন্টাগু আইল্যান্ড।
মন্টাগু ছিলেন তুখোড় জুয়াড়ি। সাধারণত রেস্তোরাঁয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জুয়া খেলতেন। তাতে এতই মগ্ন হয়ে পড়তেন, কখনো কখনো খাবারের জন্য উঠতেও রাজি হতেন না। কথিত আছে, নিজ কর্মীকে দুই টুকরো রুটির মাঝে আটকে রেখে মাংস আনার নির্দেশ দিতেন তিনি। মন্টাগু যেহেতু ছিলেন ফোর্থ আর্ল অব স্যান্ডউইচ (ব্রিটিশ মর্যাদাপূর্ণ উপাধিবিশেষ), তাই তার দেখাদেখি অন্যরাও ‘স্যান্ডউইচ’ অর্ডার করতে শুরু করেছিলেন! সেই স্যান্ডউইচে আসলে টোস্ট করা রুটির দুটি স্লাইসের মাঝখানে লবণ মেশানো গরুর মাংসের টুকরো থাকত। খাবারটি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব মন্টাগুকে দেওয়ার সকল উৎসের উল্লেখ পাওয়া যায় তার জীবনীকার এন এ এম রজারের লেখা ‘দ্য ইনসেটিয়েবল আর্ল: আ লাইফ অব জন মন্টাগু: ফোর্থ আর্ল অব স্যান্ডউইচ’ বইয়ে। অন্যদিকে, ভ্রমণবিষয়ক বই ‘গ্রোসলি’তে গসিপের আকারে বলা হয়েছে, ১৭৬৫ সালে খুবই ব্যস্ত জীবন কাটে মন্টাগুর; তাই ডেস্কে বসেই সহজে খেয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে খাবারটি বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
‘গ্রোসলি টু’র এক অনুচ্ছেদে লন্ডনের বর্ণনায় রয়েছে, ‘একজন প্রতিমন্ত্রী পাবলিক গেমিং টেবিলে চার থেকে বিশ ঘণ্টা পার করে দিতেন। খেলায় এতই মগ্ন থাকতেন, পুরো সময়টাতে টোস্ট করা রুটির দুই টুকরোর মধ্যে যোগ করা সামান্য গরুর মাংস খেতেন। খেলা বন্ধ করে বা থামিয়ে দিয়ে নয়, খেলতে খেলতেই খেতেন তিনি। আমি লন্ডনে থাকার সময় এই নতুন খাবার খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এর উদ্ভাবক হিসেবে ওই মন্ত্রীকেই সবাই বিবেচনা করে।’
গসিপভিত্তিক এই লেখার পক্ষে অবশ্য অকাট্য কোনো প্রমাণ নেই। এটির কোনো ভিত্তি রয়েছে বলেও মনে হয় না। কেননা ১৭৬৫ সালে মন্টাগু ছিলেন খুব ব্যস্ত এক মন্ত্রী। তবে তিনিই যে স্যান্ডউইচ খাবারটির মূল আবিষ্কারক, সে ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা মোটামুটি নিশ্চিত। লবণ যোগে গরুর মাংস ব্যবহার করে স্যান্ডউইচ খেতে পছন্দ করতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, তিনি তার ডেস্কে নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্য খাবারটি আবিষ্কার করেছিলেন।
১৮৪০ সালে আমেরিকায় স্যান্ডউইচের প্রবর্তন ঘটে ব্রিটিশ নারী এলিজাবেথ লেসলির (১৭৮৭-১৮৫৮) সৌজন্যে। তার রান্নার বই ‘দ্য ডিরেকশন অব কুকারি’তে হ্যাম স্যান্ডউইচের একটি রেসিপি রয়েছে, যেটিকে তিনি একটি প্রধান খাবার হিসেবে হাজির করেছিলেন। আমেরিকান ডায়েটে স্যান্ডউইচ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উনিশ শতকে। এ সময় বেকারিগুলো প্রিসলিসড রুটি বিক্রি শুরু করে। এইভাবে স্যান্ডউইচ তৈরি করা হয়ে ওঠে খুব সহজ। এসব স্যান্ডউইচ সাধারণত শ্রমিক ও স্কুলপড়–য়াদের জন্য সহজে বহনযোগ্য খাবার হিসেবে সমাদৃত হয়।
বাংলাদেশে গৃহজাত স্যান্ডউইচের প্রচলন ঘটে গত শতকের নব্বইয়ের দশকে; আর তা স্যান্ডউইচ বানানোর মেশিন সহজলভ্য হওয়ার কারণে। তবে বিভিন্ন ফাস্ট ফুড শপে এর ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে ২০০০ সালের পর থেকে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট