ত্বকতত্ত্ব I সাজ নাকি সুরক্ষা!
টু ইন ওয়ানের এই ফর্মুলা জবরদস্ত। কিন্তু কাজের কতটুকু, সেটা যাচাই জরুরি
আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অনুষঙ্গ যে মেকআপ, তা কিন্তু ত্বকের সুরক্ষাকবচ হিসেবেও কাজ করতে পারে। সান প্রোটেকশন ফ্যাক্টর বা এসপিএফের কথা সবার জানা। কমবেশি অনেকে রোজকার দিনে তা ব্যবহারও করেন। এগুলো ছাড়া এসপিএফ যুক্ত মেকআপও ত্বককে সুরক্ষা দিতে পারে। তবে এ নিয়ে আছে নানা তর্ক-বিতর্ক।
স্কিন কেয়ারের জগতে এসপিএফকে বলা হয় গেম চেঞ্জার। পর্যাপ্ত এসপিএফ যুক্ত ভালো মানের সানস্ক্রিন বার্ধক্যের সূক্ষ্ম রেখা রোধে সহায়তা করে এবং ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা ধরে রাখে। সানস্ক্রিনে এসপিএফের মাত্রা যত বেশি হবে, সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে মিলবে তত বেশি সুরক্ষা। যেমন ১৫ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ত্বককে যথেষ্ট সুরক্ষা দেয়। কিন্তু এখনকার আবহাওয়া বিবেচনায় ৩০ বা ৫০ এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ছাড়া ত্বককে সুরক্ষিত রাখা বেশ কষ্টসাধ্য। তাই ত্বকের সুরক্ষায় এক্সট্রা প্রোটেকশন হিসেবে আজকাল বাজারে এসপিএফ যুক্ত প্রাইমার, ফাউন্ডেশন, লিপবাম, লিপস্টিক এমনকি লুজ পাউডারের মতো প্রসাধনী পাওয়া যাচ্ছে। এসপিএফ যুক্ত প্রসাধনী ত্বকে ঢাল হিসেবে কাজ করলেও তা কি এসপিএফের বিকল্প হতে পারে? আর যদি মেকআপে এসপিএফ থাকে, আলাদা করে সানস্ক্রিন ব্যবহারের প্রয়োজন আছে কি?
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন অনেকটাই দৃশ্যমান। দেশে আগে গ্রীষ্মকালে যতটা গরম পড়ত, ইদানীং তা আরও বেশি; সঙ্গে বেড়েছে রোদের প্রখরতা। পরিবেশে অতিবেগুনি রশ্মি আলট্রাভায়োলেট এ এবং আলট্রাভায়োলেট বি-এর পরিমাণ এতটাই বেড়েছে, আজকাল চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা দিনের বেলায় বাড়ির ভেতর থাকলেও সানস্ক্রিন ব্যবহারের পরামর্শ দেন। বাজারে মূলত দুই ধরনের সানস্ক্রিন পাওয়া যায়: ফিজিক্যাল বা মিনারেল সানস্ক্রিন ও কেমিক্যাল সানস্ক্রিন। দুটিই ত্বককে নানা উপায়ে সুরক্ষা দিতে পারে। জিঙ্ক অক্সাইড বা টাইটানিয়াম অক্সাইড যুক্ত মিনারেল সানস্ক্রিন ত্বক ও সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মির মধ্যে বাধা তৈরি করে। অন্যদিকে অক্সিবেনজোন এবং অকটিনোক্সেটের মতো কেমিক্যাল সমৃদ্ধ সানস্ক্রিন ত্বকে ইউভি রশ্মি আঘাত হানার আগেই তা শোষণ করে নেয়।
এবার প্রশ্ন হলো, এসপিএফ যুক্ত প্রসাধনী ব্যবহার করলে আলাদা সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে হবে কি না। একটু সহজভাবে চিন্তা করলেই পাওয়া যাবে উত্তর। ত্বক তো শরীরজুড়েই থাকে। সে ক্ষেত্রে শুধু একটি পণ্যের ব্যবহারে তা সম্ভব নয়। এসপিএফ যুক্ত মেকআপ ত্বকের সুরক্ষায় কার্যকর হলেও সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজন সানস্ক্রিন। কারণ, যখন মেকআপ ব্যবহার করা হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে মুখ ও গলার সব অংশে সমানভাবে ব্যবহার করা হয় না। কিন্তু সানস্ক্রিন ব্যবহারের সময় এটি মেকআপ বেসের তুলনায় বেশ ঘন স্তরে ব্যবহার করা হয়, যা ত্বককে সুরক্ষিত রাখে কার্যকরভাবে। আমেরিকার স্কিন ক্যানসার ফাউন্ডেশন অনুসারে, মানুষের ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেওয়ার জন্য দেহে কমপক্ষে ২ টেবিল চামচ এসপিএফ ব্যবহার করতে হবে। আর মুখের জন্য একটি ছোট কয়েনের আকারের সমপরিমাণ এসপিএফই যথেষ্ট। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ এ পরিমাণ মেনে সানস্ক্রিন ব্যবহার করেন না। এ ক্ষেত্রে সানস্ক্রিনের সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারে মেকআপ; বিশেষ করে গ্রীষ্মকালে। আমেরিকান একাডেমি অব ডার্মাটোলজি (এএডি) পরামর্শ দেয় ৩০ বা তার বেশি (৫০) এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহারের। একটি ৫০ এসপিএফ যুক্ত ভালো মানের সানস্ক্রিন অতিবেগুনি রশ্মি থেকে ৯৮ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম। কিন্তু এত বেশি পরিমাণ এসপিএফ যুক্ত প্রসাধনী সাধারণত পাওয়া যায় না। যেহেতু মেকআপে নানা ফাঁকফোকর থেকেই যায়, তাই সূর্য থেকে সুরক্ষায় একমাত্র ঢাল হিসেবে এটি ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
এ ক্ষেত্রে অনেকের ভ্রান্ত ধারণা আছে। সানস্ক্রিনের সঙ্গে এসপিএফ যুক্ত মেকআপ ব্যবহার করলে দুটোর এসপিএফের মাত্রা একত্র হয়ে অতিরিক্ত উপকারিতা মিলবে! ধারণাটি ভুল। এসপিএফ যুক্ত দুটি প্রসাধনী ব্যবহার করলে যে প্রসাধনীতে এসপিএফের পরিমাণ বেশি, শুধু সেটুকু সুরক্ষাই পাওয়া যাবে। যেমন: সানস্ক্রিন যদি ৩০ এসপিএফ যুক্ত হয়ে থাকে, আর ফাউন্ডেশনে থাকে ১৫ এসপিএফ, তাহলে ৪৫ এসপিএফের সমপরিমাণ সুরক্ষা নয়; বরং দুটির মধ্যে সানস্ক্রিনে এসপিএফ বেশি থাকায় শুধু ৩০ এসপিএফ সুরক্ষাই মিলবে।
এসপিএফ যুক্ত মেকআপ পরিপূর্ণ সুরক্ষা দেয় না মানে এই নয় যে, এ ধরনের মেকআপ ব্যবহার করা বৃথা। শুধু মনে রাখতে হবে, মেকআপ কখনো সানস্ক্রিনের প্রতিস্থাপক হতে পারে না। এসপিএফ যুক্ত মেকআপ কিনতে গেলে প্রথমেই দেখতে হবে পণ্যটি অতিবেগুনি রশ্মি থেকে সুরক্ষা দিতে কতটা সক্ষম। সূর্যের দুটি মূল ক্ষতিকর রশ্মির মধ্যে প্রধানত আলট্রাভায়োলেট এ অকালবার্ধ্যকের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে আলট্রাভায়োলেট বি ত্বকের উপরিভাগে রোদে পোড়া ভাবের জন্য দায়ী। দিনের পর দিন কোনো ধরনের সুরক্ষাকবচ ছাড়া এ দুটি রশ্মির সংস্পর্শে এলে ত্বকের ক্যানসার হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায় বহুগুণ। সাধারণত জিঙ্ক অক্সাইড, অ্যাভোবেনজোন বা ইক্যামসুলের মতো সক্রিয় উপাদানযুক্ত উচ্চ এসপিএফের সানস্ক্রিন কেনার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। মেকআপের বেস তৈরিতে সাধারণত ফাউন্ডেশন ব্যবহার করা হয়। তাই সবচেয়ে বেশি এসপিএফের ব্যবহারও হয় এতে। এ ছাড়া আইশ্যাডো এমনকি ব্রোঞ্জারেও ব্যবহার করা হয় এসপিএফ। তবে এসপিএফ যুক্ত প্রসাধনী বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পণ্য লিপজেল বা লিপবাম। আমাদের পুরো ত্বকে মেলানিন থাকলেও ঠোঁট এমন একটি অংশ, যেখানে এর পরিমাণ খুবই কম। মেলানিন ত্বককে রোদে পুড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে। ঠোঁটে এ সুরক্ষাকবচ না থাকায় এর প্রসাধনী এসপিএফ যুক্ত কেনাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ ছাড়া মেকআপের ধরনের ওপরও নির্ভর করে ত্বকে সূর্যরশ্মি ঠিক কীভাবে প্রভাব ফেলবে। সাধারণত গ্লসি বা শাইনি মেকআপ সূর্যের রশ্মি বেশি আকৃষ্ট করে। এর পরিবর্তে ওয়্যাক্সি বা ম্যাট ফিনিশের মেকআপ কিছুটা হলেও সুরক্ষা বেশি দেবে। তাই গ্রীষ্মকালে গ্লসি মেকআপ এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
ভালো মানের সানস্ক্রিন এবং এসপিএফ যুক্ত মেকআপ ব্যবহার করার পরও প্রশ্ন থেকে যায়, সানস্ক্রিন রিঅ্যাপ্লাই করা হবে কী করে! বেশির ভাগ ডার্মাটোলজিস্ট ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা পরপর সানস্ক্রিন রিঅ্যাপ্লাইয়ের পরামর্শ দেন। যত বেশি এসপিএফ যুক্ত সানস্ক্রিনই হোক না কেন, এর চেয়ে বেশি সময় ধরে তা কার্যকর থাকে না। সম্ভব হলে মেকআপ তুলে সানস্ক্রিন রিঅ্যাপ্লাই করে আবার মেকআপ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে একটা ট্রিক দারুণ কাজের। মেকআপের ওপরই স্পঞ্জ কিংবা বিউটি ব্লেন্ডার দিয়ে আলতো করে সানস্ক্রিন রিঅ্যাপ্লাই করা। অনেক সময় স্প্রে আকারে সানস্ক্রিন পাওয়া যায়; চাইলে সেগুলোও ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে মেকআপের ওপর সানস্ক্রিন অ্যাপ্লাইয়ের বেলায় ভারী সলিউশন ব্যবহার না করে হালকা সলিউশন ব্যবহার করলেই কাজটা সহজ হয়ে ওঠে।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
মডেল: সায়মা স্মৃতি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল