মনোযতন I পোস্ট-ভ্যাকেশন ব্লুজ
ছুটি মানেই আনন্দের। কিন্তু ছুটি থেকে আবারও নৈমিত্তিক রুটিনে ফেরা অনেক সময় হয়ে ওঠে যাতনার। তা থেকে রেহাই পাওয়ার রয়েছে উপায়। লিখেছেন আশিক মুস্তাফা
গাঁও-গেরামের কোথাও কোথাও এখনো তলিয়ে আছে পানির নিচে। এদিকে খাঁ খাঁ রোদ্দুর ডুবিয়ে দিচ্ছে ঘামের অতলে। প্রকৃতির এই হুটহাট পরিবর্তন আমরাই ডেকে এনেছি। গাছ কেটে, নদী শুকিয়ে, পাহাড়ে বাগানবাড়ি করে দেখাচ্ছি নিজেদের ক্ষমতা। ওদিকে তলিয়ে যাচ্ছি বৃষ্টি-রোদের বিরূপ খেলায়। প্রচণ্ড রোদের কাঁধে হাত রেখে শিস দিয়ে চলে নাগরিক জ্যাম। তবু ক্লাস আর অফিসে ছুটতে হয়। কেউ ব্যক্তিগত গাড়ি, কেউ রিকশা, কেউবা সাইকেল, কেউ আবার প্রিয় বাইকে চেপে; আবার কেউ ছোটেন লোকাল বাসের পিছু।
বলি, যে যেভাবেই ছোটেন না কেন, মাথায় রাখা চাই নিজের কথা। নিজেকে ঠিক রাখতে পারলেই বহু প্রতিকূলতা উড়িয়ে দিতে পারবেন এক তুড়িতে! মাত্র পাঁচ বা তিন দিনের একটি ছুটি যেকোনো যান্ত্রিকতায় আবদ্ধ অনুভূতিকে স্বাধীনতা ও সুস্থতায় রূপ দিতে ইতিবাচক ও তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলে। এমনকি ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফেরার পরও এই উপকারী প্রভাবগুলো বেশ কিছুদিন আপনার ভেতর কাজ করে।
ভ্রমণ কে না ভালোবাসে? তবে ভ্রমণ মানে শুধু সৈকতের নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে নিয়ে প্রিয় পানীয়তে চুমুক দেওয়া নয়। নয় অস্তগামী সূর্যকে হাঁ করে গিলে ফেলার ভঙ্গিমাকে ফ্রেমবন্দি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা। ভ্রমণের রয়েছে এমন কিছু উপকারিতা, যা আমাদের জীবনযাপনকে সহজ ও সুন্দর করে।
৯টা-৫টার গোলকধাঁধা
যারা ৯টা থেকে ৫টার গোলকধাঁধার নৈরাশ্যে দিন কাটাচ্ছেন, তাদের জন্য ভ্রমণ এক দারুণ ওষুধ! ভ্রমণ মানেই বৈচিত্র্যের অবগাহন। দৈনন্দিন জীবনের তাড়াহুড়ো থেকে বেরিয়ে আসতে তাই এর বিকল্প মেলা ভার। দীর্ঘমেয়াদি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কর্মক্ষেত্র থেকে পাওয়া ছুটি নারীদের হতাশার ঝুঁকি কমিয়ে দেয় ২৯ ভাগ। সেই সঙ্গে বাড়িয়ে দেয় কর্মগতি। এ ছাড়া প্রচুর গবেষণায় দেখা গেছে, ছুটি কাটিয়ে এলে কমে যায় স্ট্রেস; বাড়ে কর্মক্ষমতা এবং শরীরে আসে সুস্থতা।
তবে মুদ্রার উল্টো পিঠও মাথায় রাখা চাই। বলছি, ফের ৯টা-৫টার গোলকধাঁধায় ফিরতে অনীহার কথা। রঙিন একটি সময় কাটিয়ে এসে সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেতে হবে, ভাবতেই মেজাজটা সারেগামাপার সড়কে চড়ে বসে! সেই সঙ্গে খাবারে অনীহা। ঘুমের রুটিনেও উলট-পালট। কী যেন এক আতঙ্ক ঘুরপাক খায় মনে; কিন্তু বুঝতে পারছেন না, সেটা কী। কিংবা প্রায়ই অফিস নিয়ে দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙে। কারও সঙ্গে কথা বলতেও ভালো লাগে না। কাছের মানুষেও আসে বিরক্তি। ভ্রমণের পর যদি এসব বিষয় কাজ করে, বুঝতে হবে অবকাশ-পরবর্তী বিষণ্নতায় ভুগছেন, যার পোশাকি নাম পোস্ট-ভ্যাকেশন ব্লুজ। পোস্ট-হলিডে ব্লুজও বলে কেউ কেউ।
পরিচয় সন্ধান
ব্লু বা নীল রং আমাদের কাছে প্রায়ই স্যাডনেস বা দুঃখের বার্তা নিয়ে হাজির হয়। কিংবা আমরা এই রংকে পর্যবেক্ষণ করি বেদনার দৃষ্টিতে। যদিও এই ব্লু রঙের বিষয়টি আসলে তেমন কিছুই নয়; বলতে গেলে অনেকটা আপেক্ষিক। দুঃখ বা মন খারাপের কারণ অনীহা বা উদ্যমহীনতা—যেকোনো কিছুই হতে পারে। ঠিক তেমনই অবকাশ-পরবর্তী কাজে ফেরার অনীহা থেকেই যে শব্দগুচ্ছ উঠে এসে পুরো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে গড়ে দেয় নিজস্ব আঙ্গিক, তাকে বলা যেতে পারে পোস্ট-ভ্যাকেশন ব্লুজ। আরেকটু যদি বাড়িয়ে বলি, বিষয়টি এমন দাঁড়ায়, কর্মব্যস্ত দিনগুলো থেকে একটি বিরতি নিয়ে ছুটি উপভোগ করে কাজে ফেরার কথা ভাবলেই যেন গায়ে জ্বর আসে। এই জ্বর জ্বর ভাবেরই পোশাকি নাম এটি।
লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে
মোটাদাগে অবকাশ-পরবর্তী বিষণ্নতার লক্ষণগুলোতে চোখ রাখা যাক:
একধরনের দুঃখ অনুভব করা কিংবা মন খারাপ থাকা;
ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব করা;
মানসিক চাপ অনুভব করা;
কাজে মনোযোগ দিতে না পারা;
মনে দুশ্চিন্তা ভর করা;
মেজাজে নেতিবাচক পরিবর্তন;
অনীহা বা উদ্যমহীনতা কিংবা কাজে বিরক্তি অনুভব করা।
এসব লক্ষণ ব্যক্তিগত জীবন, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। আর তা যে নেতিবাচক, বলাই বাহুল্য! তাই বলে ঘাবড়ে যাবেন না। এই ব্লুজের চোখ রাঙানি পাশ কাটানো সম্ভব পাঁচটি ধাপে:
ছুটির পরের ছুটি
অনেকে সাধারণত ছুটি কাটিয়ে এসে সরাসরি কাজে জড়িয়ে পড়েন। এমনটা করবেন না। এতে ইতিবাচক প্রভাবের চেয়ে নেতিবাচক প্রভাবই বেশি পড়বে। তাই ছুটি থেকে ফিরে দু-এক দিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর কাজে যোগ দেওয়া উত্তম। প্রয়োজনে এই এক-দুই দিনের ছুটিটা আগেই নিয়ে রাখুন। এতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম মেলার পাশাপাশি জেটল্যাগ কাটিয়ে ওঠাসহ লাগেজের জিনিসপত্রের গতিপথও ঠিক করে নিতে পারবেন।
কফির টেবিলে রিমঝিম বৃষ্টি
ছুটি থেকে ফিরে এসে একটু থিতু হয়ে বিকেল কিংবা সন্ধ্যাটা কাটাতে পারেন প্রিয় কোনো মানুষের সঙ্গে। বাইরে তখন হয়তো রিমঝিম বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি দেখে সদ্য স্মৃতি হয়ে যাওয়া ভ্রমণের ঝাঁপি খুলে বসতে পারেন কফির কাফে চুমুক দিতে দিতে। সেই সঙ্গে দুজন মিলে কাজের পরিকল্পনার পাশাপাশি আরেকটি ভ্রমণের পরিকল্পনাও সেরে নিতে পারেন।
ঘুম ও ডায়েটে ভারসাম্য
ছুটিতে ঘুমের রুটিন ঠিক না থাকাই স্বাভাবিক। তাই ছুটি কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আগে ঘুমে মন দিন। ঘুম ঠিকঠাক হলে দুনিয়াটাও স্বাভাবিক লাগে। অন্যথায় হায়, সকলই বৃথা! ঘুম শেষে খাবারের বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারেন। মনে রাখা চাই, ঘুম ও খাবারের রুটিন ঠিক না থাকলে মেজাজ বিগড়ে যেতে পারে। আর এই বিগড়ানো মেজাজ আপনাকে নিয়ে যেতে পারে ব্লুজের দিকে। তাই ঠিকঠাক ঘুম আর পুষ্টিকর খাবারে নিজেকে সটান দাঁড় করিয়ে ভাবতে পারেন অফিস কিংবা কাজের কথা।
স্মৃতিমেদুরতার প্রস্তুতি
বাড়ি ফেরার পর ছুটিতে যেসব স্থানে গিয়েছেন, সেই স্মৃতিচারণা মানে সেই স্থান সম্পর্কে লেখার পাশাপাশি ছবির অ্যালবাম গুছিয়ে নিন। গুগল ড্রাইভ কিংবা পিসিতে তা কপি করে রাখুন। এই কাজ অন্য রকম আনন্দ দেবে। সেই সঙ্গে দীর্ঘদিন পরেও এসব লেখা আর ছবি ভোগাবে দারুণ স্মৃতিমেদুরতায়!
শরীর ও মনের অবস্থান
ওপরের বিষয়গুলো ঠিকঠাক হয়ে গেলে শরীর আর মনকে আরও সক্রিয় করতে যোগব্যায়াম, ধ্যান এবং শিথিলকরণের মতো বিষয়গুলোতে নাক গলাতে পারেন। এসব অনুশীলন শরীরের পাশাপাশি মনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করবে।
ছুটি রাঙাতে
গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৭০ শতাংশ লোক তাদের জীবনের ৯০ ভাগ সময় দালানের ভেতরে কাটান। সেটি হতে পারে অফিস কিংবা বাসায়। তাই নিয়মিত ভ্রমণের বের হওয়া শ্রেয়। ১০ ভাগ সময়টা বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে নিজেকে রাঙিয়ে তুলতে পারেন। এ ছাড়া ভ্রমণকে আরও ইতিবাচক করে তুলতে যা যা করতে পারেন—
শারীর ও স্বাস্থ্যের পরিবর্তনে: আমরা যখন প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটাই, প্রকৃতিকে পাঠ করি, তখন আমাদের মেজাজের পরিবর্তন হয় এবং চাপ নেওয়ার ক্ষমতা বাড়ে। তাতে ঘুমটাও ভালো হয়। সেই সঙ্গে শারীর ও স্বাস্থ্যের ঘটে ইতিবাচক পরিবর্তন। তাই ভ্রমণে গিয়ে নিন প্রকৃতির পাঠ।
থেরাপিউটিক প্রভাবের জন্য: প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে যখন প্রাকৃতিক উপাদান দেখি, শুনি, গন্ধ নিই এবং স্বাদ গ্রহণ করি, তখন আমরা আসলে একধরনের থেরাপিউটিক প্রভাব পাই।
কৃতজ্ঞতা ও মননশীলতার অনুশীলন: ছুটির দিনগুলোতে অনুভূতির পরিবর্তন ঘটানোর চেষ্টা করুন। এতে ব্যক্তিত্বে ভালো আচরণের পাশাপাশি তৈরি হবে কৃতজ্ঞতাবোধ। সেই সঙ্গে গড়ে তুলতে পারেন মননশীলতার অভ্যাস।
ঘাসের গন্ধ নিতে: পাখির কথা শোনার জন্য কিংবা কাটা ঘাসের ঘ্রাণ নিতে জানালা খুলুন। এতে ভ্রমণ আরও আরামদায়ক হবে। এ ছাড়া যেখানেই থাকেন, জায়গাটি পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করুন। শুধু নির্দিষ্ট স্পট নয়, আশপাশও ঘুরে দেখার গড়ে তুলুন অভ্যাস।
সৃজনশীলতায় মন: চাইলে ছবি আঁকতে পারেন। ভাস্কর্য বা স্মরণীয় দৃশ্য এঁকে রাখলে ছুটি কাটানোর দীর্ঘদিন পরও অবকাশকালীন স্থানে ফিরে যেতে পারবেন মনোজগতে ভর করে।
অভিজ্ঞতা ও পর্যালোচনা: অভিজ্ঞতা মনে টাটকা থাকা অবস্থায় অনলাইন ভ্রমণ পরিষেবাগুলোতে পর্যালোচনা দিতে পারেন। বিভিন্ন টিপস এবং সতর্কতামূলক বিষয়গুলোও তুলে ধরতে পারেন।
এসব বিষয় ছুটি-পরবর্তী ব্লুজ থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই এসবে মন দিতে পারেন।
দাগ কাটাতে
এত কিছুর পরও ছুটির পরে যে অস্বস্তি অনুভব করছেন, তা যদি কয়েক দিন পরে আপনাআপনি মিলিয়ে না যায়, তাহলে মনের ক্যানভাসে পড়া সেই অদৃশ্য অথচ অনুভবক্ষম কালশিটে দাগ কাটাতে বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হওয়াই বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান কল্লোল বলেন, ‘ছুটি যতই দীর্ঘ বা উপভোগ্য হোক না কেন, ছুটির পরে হতাশা বোধ করা একদম স্বাভাবিক। তবে অবকাশের পরে ব্লুজ এড়াতে বিশ্রামকে অগ্রাধিকার দেওয়ার চেষ্টা করুন। বাড়ি ফেরার পর নিজেকে দৈনন্দিন রুটিনে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালান। এতে কাজ না হলে কোনো অভিজ্ঞ থেরাপিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
একজন ভালো থেরাপিস্ট এক বা একাধিক সেশনের মাধ্যমে আপনাকে রুটিনে ফিরতে সাহায্য করতে পারেন। তবে বেশি সমস্যায় পড়লে একাধিক সেশনে ফিরে আসতে পারবেন স্বাভাবিক জীবনে। এর জন্য অস্থির হওয়ার কিছু নেই।
ছবি: ইন্টারনেট