skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I নদী নিরবধি

যে খরস্রোতা নদ-নদীতে কালের পর কাল ধরে জেলেরা মাছ ধরতেন, নৌকাবাইচ হতো, উৎসবের আমেজে মেতে উঠতেন নদীপারের মানুষ, তা এখন স্মৃতিময় অতীত—এ বাস্তবতা সত্যি বেদনাদায়ক

নদী। কখনো বুনো জন্তুর মতো উত্তাল, কখনো শীতলপাটির মতো নিস্তরঙ্গ। কোথাও সুগভীর, কোথাও হাঁটুজল। বয়ে চলে নিরবধি। জোগায় পানি। জোগায় খাবার। ঘটায় প্রাণের সঞ্চার। এর অবদান অস্বীকার করার জো নেই। মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। বিশেষত আমাদের দেশে। কেননা, এই জনপদ তো নদীমাতৃক দেশ নামে পরিচিত। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি—সব মাধ্যমেই এর তাই বিপুল বন্দনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন, ‘হে বিরাট নদী,/ অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল/ অবিচ্ছিন্ন অবিরল/ চলে নিরবধি।/ স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;/ বস্তুহীন প্রবাহের প্রচণ্ড আঘাত লেগে/ পুঞ্জ পুঞ্জ বস্তুফেনা উঠে জেগে;/ আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে/ ধাবমান অন্ধকার হ’তে;/ ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে/ স্তরে স্তরে/ সূর্য্যচন্দ্রতারা যত/ বুদ্বুদের মত।’

দুই
বহুমাত্রিক প্রতিভাধর সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলে গেছেন, বাংলাদেশ প্রকৃতির প্রিয় সন্তান। চিরায়ত বাংলার দিকে তাকালে মেলে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ। নদী এর অন্যতম। চারপাশ দিয়ে অজস্র বাহুডোরে এই বদ্বীপকে যেন মায়ের মতো আগলে রেখেছে শাখা-প্রশাখাসহ প্রায় ৭০০ নদ-নদীর বিপুল জলরাশি। উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, এ দেশে নদীর মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ হাজার ১৫৫ কিলোমিটার। বড় তিন নদী পদ্মা, মেঘনা আর যমুনা থেকে শুরু করে, নামে ও বৈশিষ্ট্যে কত সুন্দর ও বিচিত্র এই সব নদ-নদী: অর্পণগাছিয়া, আত্রাই, আলাইকুমারী, আঠারবাঁকি, আড়িয়াল খাঁ, আন্ধারমানিক, ইছামতী, ইরামতি, কপোতাক্ষ, কয়রা, করুলিয়া, কাটাখালী, কালীগঙ্গা, করতোয়া, কাগেশ্বরী, কালাপানি, কীর্তনখোলা, খোলপেটুয়া, গলঘেসিয়া, গুলিশাখালী, গদাই, গভেশ্বরী, গোবরা, গোহালা, ঘাঘর, চিত্রা, টিয়াখালি, নবগঙ্গা, পানগুছি, ফটকি, বলেশ্বর, বিশখালী, বেগবতী, বেলুয়া, ভদ্রা, ভুবনেশ্বর, মংলা, মুক্তেশ্বরী, মধুমতি, মাদারগাঙ, মালঞ্চ, রূপসা, রাবনাবাদ, লোহালিয়া, সুগন্ধা, সন্ধ্যা, চিকনাই, চিকলী, চিরি, ডাহুক, তিস্তা, তুলসীগঙ্গা, দুধকুমার, ধরলা, ধাইজান, ধুম, নর্ত, পাথরঘাটা, পুনর্ভবা, ফুলকুমার, বাঙ্গালী, বুড়ি তিস্তা, মাইলা, মানস, সিমলাজান, হারাবতী, কর্ণঝরা, কুশিয়ারা, গুমাই, ঘোড়াউত্রা, চিতলখালী, ধলা, নরসুন্দা, বাউলাই, বিবিয়ানা, লংলা, লাউরানজানি, সুরমা, সোমেশ্বরী, ইলিশমারী, গাংডুবি, ঝিনাই, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, সাঙ্গু, হালদা, গোমতী, ঘুংঘুর, ডাকাতিয়া, বিজলি, তুরাগ প্রভৃতি।

তিন
নদীরও প্রাণ আছে! ২০১৯ সালে এক যুগান্তকারী রায়ে দেশের সব নদ-নদীকে লিভিং এনটিটি বা জীবন্ত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। রাজধানীর উপকণ্ঠে তুরাগ নদ রক্ষায় মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২৮৩ পৃষ্ঠার এ রায় দেওয়া হয়। আদালত বলেন, নদীর বাঁচা-মরার ওপর বাংলাদেশের অস্তিত্ব জড়িত। বাঁচলে নদী বাঁচবে দেশ, বাঁচবে প্রিয় বাংলাদেশ। দেওয়া হয় ১৭ দফা নির্দেশনাও। নদী বাঁচাতে কেন আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল, কিংবা এখনো হতে হয়, তা বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরকার পড়ে না; চোখ-কান একটু খোলা রাখলেই চলে। নদীমাতৃক দেশ বলে এত যে আমাদের গর্ব, নদীর সৌন্দর্যে এত যে বিমোহিত আমরা, একটু খেয়াল করলেই দেখা মেলে, দেশের বেশির ভাগ নদ-নদীই এখন বিপন্ন। আর তা যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মানবসৃষ্ট কারণে। নানাভাবে নদী দখলের এক নৃশংস প্রতিযোগিতা কালে কালে এই ভূখণ্ডে ঘটেছে, ঘটছে। যে নদীর কূলে গড়ে উঠেছে রাজধানী, সেই বুড়িগঙ্গার পাড়ে গেলে যেকোনো সংবেদনশীল মন হু হু করে উঠতে বাধ্য। তীর দখল, আবর্জনার স্তূপ…সব মিলিয়ে প্রবল দূষণে পানি হয়ে পড়েছে কালো ও দুর্গন্ধময়। একদার উত্তাল ও স্রোতস্বিনী অনেক নদীই এই বদ্বীপের বুক থেকে মানবদৃষ্ট দূষণ ও দখলে স্রেফ নালায় পরিণত হয়েছে, নয়তো গেছে হারিয়ে। অথচ নদীর সহজাত প্রবাহ অক্ষুণ্ন রাখা মানবসভ্যতার জন্য অপরিহার্য দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে এ দেশের নানা স্তরের মানুষই যে কালে কালে ব্যর্থ হয়েছেন ও হচ্ছেন, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। আশার কথা, বেশ কিছু পরিবেশবাদী সংগঠনের পাশাপাশি অনেক ব্যক্তিমানুষও নিজস্ব সচেতনতাবোধে চালিত হয়ে নদী বাঁচানোর আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। বাড়ছে সচেতনতা। আর তা না বাড়ানোর নেই বিকল্পও।

চার
নদী পরিবেশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আমাদের দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে নদীর। যে খরস্রোতা নদ-নদীতে কালের পর কাল ধরে জেলেরা মাছ ধরতেন, নৌকাবাইচ হতো, উৎসবের আমেজে মেতে উঠতেন নদীপারের মানুষ, তা এখন স্মৃতিময় অতীত—এ বাস্তবতা সত্যি বেদনাদায়ক। একে ঘিরে এক দলিলতুল্য উপন্যাস লিখে গেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মন, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে। যা অবলম্বনে একই শিরোনামে চলচ্চিত্র বানিয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। এর প্রেক্ষাপট নদীর স্বরূপ হারিয়ে যাওয়ার হাহাকার ঘিরে। এমন হাহাকার ক্রমাগত বাড়–ক, তা কারও চাওয়া হওয়া উচিত নয়।

পাঁচ
প্রতিবছরের সেপ্টেম্বরের শেষ রোববার পালিত হয় ‘বিশ্ব নদী দিবস’। নদী সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ইতিহাস বলে, ১৯৮০ সালে এ দিবসে সূচনা ঘটায় ব্রিটিশ কলম্বিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। ২০০৫ সালে দিবসটি অনুসমর্থন দেয় জাতিসংঘ।
ভালো থাকুক সকল নদ-নদী। থাকুক যত্নে।
সবার মঙ্গল হোক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top