স্বাদশেকড় I রিসোটো রাজত্ব
মূলত ইতালীয় খাবার। সূক্ষ্ম দানাদার চালে তৈরি, যা অ্যামাইলোপেকটিন নামক নরম স্টার্চে আবৃত থাকে। ঠিকঠাক প্রস্তুত করা গেলে স্টার্চ দ্রবীভূত এবং থালার অন্যান্য উপাদান মিশ্রিত হয়। ফলে মেলে ক্রিমি রিসোটো
যে চাল থেকে রিসোটো তৈরি করা হয়, তা মূলত এশিয়ায় উদ্ভূত। প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে এশিয়ার অন্যতম প্রধান খাদ্যশস্য ধান প্রায় সাড়ে চার হাজার মাইলের বেশি দূরের গমকেন্দ্রিক ইউরোপীয় দেশ ইতালিতে পৌঁছেছিল? তা জানতে ইতিহাসের পাতায় একটু ঢুঁ মারা যাক! সিল্ক রোড বাণিজ্যের ফলে আরব ব্যবসায়ীরা এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্যে চাল নিয়ে যাওয়ার কারণেই মূলত এটি সম্ভব হয়েছিল। মুরস ও সারাসেন জনগোষ্ঠী ইউরোপে বসতি স্থাপনের পর ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ইতালির সিসিলিতে প্রচলন শুরু হয়েছিল চালের। সেখান থেকে এই খাদ্যশস্য নেপলস অঞ্চলে এবং পরবর্তীকালে নেপলসের আরাগোনা ও মিলানের স্ফোরজার মধ্যকার সংযোগ এলাকার বদৌলতে উত্তর ইতালির পো উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ে। সমতল জমি, পানির সহজলভ্যতার কারণে পো ছিল এ জন্য সবচেয়ে আদর্শ স্থান। এখনো পো ভ্যালি ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী অঞ্চল। বলাই যায়, পো এলাকায় ব্যাপকভাবে চাল উৎপাদন উত্তর ইতালিজুড়ে ভাত খাওয়ার ব্যাপক প্রচলন ঘটানোর নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে।
শহরগুলোতে চালের চাহিদা ক্রমবর্ধমান হওয়ার কারণে উত্তর ইতালিতে পঞ্চদশ শতাব্দীতে ধানখেত হিসেবে ব্যবহারের জন্য লম্বার্ডি সমতলভূমি পরিষ্কার, পুনরুদ্ধার ও প্রস্তুত করা হয়েছিল। পো উপত্যকায় ধানখেত তৈরির সামর্থ্য স্থানীয় কৃষকদের ছিল না। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করতে এগিয়ে এসেছিলেন উদীয়মান পুঁজিপতিরা। উত্তর ইতালির চাল-সম্পর্কিত প্রাচীনতম উল্লেখগুলোর অন্যতম হলো ১৪৭৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর লেখা একটি চিঠি। ইতালির ফেরারা শহরের তৎকালীন ডিউককে ১২ বস্তা চালের বিষয়ে ওই চিঠি লেখেন মিলানের ডিউক গ্যালেজো মারিয়া ফোরজা।
ভেনিশিয়ান প্রজাতন্ত্রের সময়ে [৬৯৭—১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দ; বর্তমানে মূলত উত্তর-পূর্ব ইতালির অন্তর্গত] লা সেরেনিসিমা নগর তার নাগরিক ও শত্রু—উভয়ের কাছেই সুপরিচিত ছিল। সেখানে রাষ্ট্রীয় ভোজ ছিল একটি উল্লেখযোগ্য আয়োজন। মাস্টার শেফরা তাতে চমৎকার মিনিস্ট্রা ডি রিসো প্রস্তুত করতেন। কালের পরিক্রমায় বিকশিত এই খাবারকেই আমরা রিসোটো নামে চিনি।
ইতালির পো উপত্যকা এবং স্পেনের ভ্যালেন্সিয়া শহর—উভয় স্থানেই রুটির পাশাপাশি অন্যতম প্রধান খাদ্য হিসেবে জায়গা করে নেয় ভাত। লম্বার্ডিতে রিজিকালচার (ধান চাষ) হিসেবে লাভের পরিমাণ রাখা হয়েছিল চড়া। কৃষকেরা সংগঠিত না থাকায় তাদের দাসের মতো ব্যবহার করা হতো; এর মধ্যে শিশুরাও ছিল। ১৫৯০ সালের লম্বার্ড অধ্যাদেশের এই প্রথা বন্ধ করতে চেয়ে তারা বর্বর নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিলেন। বলে রাখা ভালো, রোমান সাম্রাজ্যকালে এসব অঞ্চলে ভাত পরিচিত ছিল শুধুই ঔষধি হিসেবে। ফলে ইসলামের উত্থানের আগপর্যন্ত ভূমধ্যসাগর-পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অঞ্চলে ধান চাষের নিয়মিত কিংবা ব্যাপক প্রচলন ঘটেনি।
এদিকে, রিজিকালচারের উৎপত্তি ভারত, আসাম, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও চীনে। এটি ধীরে ধীরে পশ্চিমে কৃষি ও রন্ধনসম্পর্কীয়—উভয় ক্ষেত্রেই নিজ গতিপথ তৈরি করতে থাকে। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এবং ভারতে পিলাফ স্টাইলে ভাত রান্নার চল ছিল, যার অর্থ নরম ভাত, যেখানে চালের সঙ্গে অন্য কোনো খাদ্যশস্য মেলানো হতো না। সেই চল এখনো ব্যাপকভাবে রয়েছে। তবে উত্তর ইতালিতে ভাত এমনভাবে রান্না করা হয়েছিল, যেখানে অন্যান্য খাদ্যশস্য আগে থেকেই রান্না করে মেশানো হতো। সেটিই রিসোটো!
ইতিহাস বলে, চতুর্দশ শতাব্দীতে একজন অজ্ঞাতনামা খাদ্যবিশারদের লেখা রন্ধনবিষয়ক পাণ্ডুলিপি ‘লিব্রো পার কুওকো’তে একটি রেসিপির উল্লেখ করা হয়, যার নাম রিসো ইন বোন মানেরা। এটি ছিল বাদাম-দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে, দুধে রান্না করা একধরনের ভাত।
ইতালির মিলানে আবহাওয়া ও পরিবেশ অনুকূল থাকায় ধান চাষ একসময় ছড়িয়ে পড়ে। নতুন এ খাবার মাত্রাতিরিক্ত দামে বিক্রি করার কারণে ইতালিজুড়ে চালের জনপ্রিয়তা প্রাথমিকভাবে ধনীদের মধ্যে বাড়তে থাকে। বহির্বিশ্ব স্বল্প দানাদার ইতালীয় চালের গুণাগুণ আবিষ্কার করার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থ বিনিয়োগ শুরু করে। ফলে আরও বেশি ধান রোপণ শুরু হয়ে যায় দেশটিকে। আর ব্যাপক উৎপাদনের কারণে দামও কমে আসে। ফলে সবার কাছেই চাল আরও সহজলভ্য হয়ে ওঠে।
প্রারম্ভিক ব্যবহার থেকেই চাল একটি রন্ধনসম্পর্কীয় ঐতিহ্যে বিকশিত হয়েছে, যার একটি প্রকাশ রিসোটো। সবচেয়ে বিখ্যাত রিসোটোর মধ্যে অন্যতম ‘রিসোটো আল্লা মিলানিজ’। খাবারটির প্রথম রেসিপির উল্লেখ পাওয়া যায় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দশকে প্রকাশিত রান্নার বইগুলোতে। তবে অনেকের মতে, এর ইতিহাস আরও প্রাচীন। কথিত আছে, ১৫৭৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ফ্ল্যান্ডার্সের মাস্টার গ্লাসমেকার ভ্যালেরিওর মেয়ের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল তার বাবার সহকারীর সঙ্গে, যাকে ভ্যালেরিও ডাকনাম দিয়েছিলেন ‘জাফেরানো’ বা জাফরান। কেননা জাফরান নামক মসলাটি ওই যুবক এতই পছন্দ করতেন যে সঙ্গে রাখতেন সব সময়। এমনকি মিলানের ক্যাথেড্রালের কাচের সোনায় দাগ লাগাতেও এটি ব্যবহার করতেন। তার বিয়ের দিন ভ্যালেরিওর কাচ নির্মাতাদের দল রান্নাঘরে ঢুকেছিল, সম্ভবত কিছু খাবার চুরি করার জন্য; একই সঙ্গে জাফেরানো নিয়ে রসিকতা করাও উদ্দেশ্য ছিল তাদের। এর ফলে যা ঘটে, তাকে জাদু বলা যেতেই পারে! ভ্যালেরিওর কাচ নির্মাতারা বিয়ের অতিথিদের ভাতের মধ্যে মাখনের পাশাপাশি জাফরানের একটি বড় স্তূপ ঢেলে দেন; ফলে ভাতটি কমলা বর্ণ ধারণ করে। পাতে কমলা বর্ণের ভাত পেয়ে অতিথিরা চমকে যান। কেউ কেউ কৌতূহলের বশে এর স্বাদ গ্রহণও করেন। মুহূর্তেই এই সুগন্ধে পুরো রুমের অতিথিরা রোমাঞ্চিত হয়ে পড়েন। যদিও চালের সঙ্গে জাফরানের যোগ, যাতে মিলানের বিশেষ এই রিসোটোর আদি রূপের উৎস-সম্পর্কিত এই গল্পের চল মুখে মুখে থাকলেও এর কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা মেলেনি।
এদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চাল শুধু ফুটন্ত পানিতে রান্না করা হতো। প্রথম পরিবর্তন ঘটে ১৭৭৯ সালে, যখন চাল প্রথমবারের মতো সামান্য মাখনে ভাজা এবং ঝোল দিয়ে ভেজানো হয়। পরে তাতে এক চিমটি কাটা পেঁয়াজ যোগ করা হয়। ১৮০৯ সালে রান্নার বই প্যাডেলার রিসো গ্যালোতে প্রথম এই রেসিপি অন্তর্ভুক্ত হয়। এতে চাল মাখনে ভাজা এবং তাতে ধীরে ধীরে সসেজ, পেঁয়াজ ও জাফরান যোগ করার উল্লেখ ছিল।
কিছুদিন পরেই মিলানে সবচেয়ে বিখ্যাত রিসোটো ডিশ ‘রিসোটো আল্লা মিলানিজ’ আবিষ্কৃত হয়। স্প্যানিশ ডিশ পায়েলার মতো এতে ধীরে ধীরে জাফরান মেশানো হয়। ১৮২৯ সালে রিসোটো আল্লা মিলানিজ নামটি নুওভো কুওকো মিলানিজ ইকোনমিকো রেসিপি বইয়ে প্রথমবারের মতো পাওয়া যায়। শুরুর দিকে চাল সেদ্ধ না করে মাখন ও ঝোল ধীরে ধীরে ঢেলে রান্না করা হয়েছিল। এরপর গরুর অস্থিমজ্জা, সারভেলাটা (পনির ও গরুর মাংসে ভরা সসেজ) ও জাফরান যোগে বাড়ানো হয়েছিল স্বাদ। প্রশ্ন উঠতে পারে, জাফরান কেন মেশানো হয়? অঞ্চলটি প্রায় দুই শতাব্দী ছিল স্প্যানিশ শাসনের অধীনে। তাতে পায়েলাসহ বিভিন্ন ভাতজাত খাবার মিলানে প্রধান খাবারে পরিণত হয়েছিল। স্টার্চ ছোট চালের সঙ্গে মেশানো পায়েলার ধীর রান্নার রীতিটি মূলত স্থানীয়। তবে একজন অজ্ঞাত শেফ চাল, মুরগির স্টক, জাফরান, পেঁয়াজ, মাখন, ওয়াইন, পারমেসান ও ফ্ল্যাট লিফ পার্সলে যোগে তৈরি করেছিলেন রিসোটো আল্লা মিলানিজ।
১৮৩৯ সালে ফিলিপাইনের একজন ধর্মযাজক স্থানীয় জাতের কিছু ধান পাঠান ইতালিতে। তা থেকে দেশটিতে ধানের নতুন হাইব্রিড তৈরির সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর মধ্যে ছোট দানাদার কার্নারোলি ও আরবোরিও ছিল রিসোটো তৈরির উপযুক্ত জাতের চাল। এসব চাল চর্বি বা মাখন যোগে নরম করা, এবং ধীরে ধীরে ঝোল, পানি বা ওয়াইন যোগে রান্না করার উপযোগী। সম্পূর্ণভাবে পানি শোষণ করে একটি ক্রিমি সামঞ্জস্য বজায় রাখত এই চালগুলো, তাতে রিসোটো প্রস্তুত সহজ হয়ে উঠত। বর্তমানে সিসিলির আরানসিনি এবং পুগলিয়ার টিয়াল্লার মতো খাবারেও চাল বা ভাত থাকে। অন্যদিকে, আজও ইতালির উত্তরাঞ্চলে গভীরভাবে প্রোথিত রয়েছে রিসোটোর শিকড়।
গত শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে, ফ্যাসিবাদী শাসন জাতীয় খাবার হিসেবে রিসোটো চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এর প্রচারে একটি ‘ন্যাশনাল রাইস বোর্ড’ও করেছিল প্রতিষ্ঠা। ‘ইট রাইস অ্যান্ড রাইস ইজ হেলথ’-এর মতো শিরোনামে রেসিপি বই প্রকাশিত হয়েছিল সে সময়। স্কুলের ক্যানটিন, মেস ও হলের চিরচেনা খাবারে পরিণত হয়েছিল রিসোটো। স্বয়ংসম্পূর্ণতার সঙ্গে প্রচারণাটির আদর্শগত দিকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। আজকের দিনে পাস্তা ছাড়া ইতালির খাদ্যসংস্কৃতি কল্পনা করা যেমন কঠিন, সেই সেই সময়ে সরকার ইতালীয় জাতির ‘আলসেমি, নৈরাশ্য, নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা’র জন্য পাস্তাকেই দায়ী করেছিল! ১৯৩১ সালে ইল ম্যানিফেস্টো দেলা কুচিনা ফিউতুরিস্তার মাধ্যমে পাস্তা বিলুপ্তির আহ্বান জানানো হয়; কারণ, দেশটির ফ্যাসিবাদী সরকার মনে করেছিল, আধুনিক জীবনযাত্রার গতি ও গতিশীলতার সঙ্গে পাস্তা অনুপযুক্ত। এসব ধারণা অবশ্য ফ্যাসিবাদী শাসন অবসানের সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়ে গেছে। তাই বলে হারায়নি রিসোটো। কেননা, শুধু স্বৈরশাসকের চাপিয়ে দেওয়ার কারণে নয়, ঐতিহ্য ও স্বাদের কারণেও এ খাবারের জনপ্রিয়তা এতটুকু হয়নি ম্লান।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট