নখদর্পণ I ভাইটাল ভিটামিন
এর অভাবে সৌন্দর্য নষ্ট হয়। আর উপস্থিতি নিশ্চিত করে নখের সুস্বাস্থ্য। নজর দিতে হবে প্রতিদিনকার ডায়েট চার্টে
নখ কেরাটিনে তৈরি। ত্বক ও চুলের মতো তাই এতেও শক্তিশালী প্রোটিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এর ওপরের অংশে থাকে নেইল প্লেট। ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের মতে, প্রতি মাসে ২ থেকে ৩ মিলিমিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে নখ। ফলে ভিটামিন ও মিনারেলের অভাব সবার প্রথমে নেইল অ্যানাটমিতে প্রভাব ফেলে। পরবর্তী সময়ে নেইল প্লেটের কেমিক্যাল প্রোফাইলও আক্রান্ত হয়। এতে নখের গ্রোথ কমে যায়। শুষ্কতায় আক্রান্ত হয়। ভঙ্গুর ভাব দেখা দেয়। দাগ তৈরি হয় এবং রং বদলে যায়।
সচেতন ডায়েট প্ল্যানের মাধ্যমে নখের স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য—দুটোই বজায় রাখা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ভিটামিন ও মিনারেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রতিদিনের খাবারের রুটিনে তাই এগুলোর উপস্থিতি জরুরি।
ভিটামিন বি কমপ্লেক্স
ভিটামিন বি কমপ্লেক্সকে বায়োটিন, ভিটামিন বি সেভেন, কো-এনজাইম এবং ভিটামিন এইচও বলা হয়। নেইল গ্রোথের জন্য অতি প্রয়োজনীয় উপাদান এটি। নখকে শক্ত করতে কার্যকর। এর অভাবে নেইল বেডে রিজ, অর্থাৎ লম্বা লম্বা দাগ তৈরি হয়। এই খাদ্যপ্রাণ সম্পর্কে রিকমেন্ডেড ডায়েটারি অ্যালাওয়েন্স অর্থাৎ আরডিএতে কোনো নির্দেশনা নেই। কিন্তু এডিকুয়েট ইনটেকের (এআই) হিসাব অনুযায়ী, প্রতিদিন দেহে অন্তত ৩০ মাইক্রোগ্রাম বায়োটিন প্রয়োজন। এডিকুয়েট ইনটেক বলতে বোঝানো হয় খাদ্যপ্রাণের সেই পরিমাণকে, যা প্রতিদিন গ্রহণ করে একটি সুস্থ জনগোষ্ঠী জীবনধারণ করছে। আবার হেলথ লাইন ডটকমের মাধ্যমে ৩৫ জন মানুষের ওপর চালানো এক গবেষণার তথ্যমতে, সপ্তাহে ২৫০০ মাইক্রোগ্রাম বায়োটিন গ্রহণ করলে ৬৩ শতাংশ মানুষের বি কমপ্লেক্সের অভাবে তৈরি হওয়া সমস্যা কমে আসে। ডিমের কুসুম, দুগ্ধজাতীয় পণ্য, ইস্ট, স্যামন মাছ, অ্যাভোকাডো, মিষ্টিআলু, বাদাম, সিডস ও ফুলকপিতে এই ভিটামিন পাওয়া যায়।
ভিটামিন বি১২ ও বি৯
ভিটামিন বি১২ দেহে আয়রনের উপস্থিতি বাড়িয়ে লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে কাজ করে। এর অভাবে নখের রং পরিবর্তিত হতে শুরু করে। নীলচে কালো পিগমেন্ট দৃশ্যমান হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে অনেক সময় কালো রেখা, বাদামি পিগমেন্টেশনও দেখা যায়।
ভিটামিন বি৯ নখের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এর কাজ অনেকটাই ভিটামিন বি১২-এর মতো। লোহিত রক্ত কণিকা তৈরির পাশাপাশি নতুন কোষের গঠনেও অবদান রাখে। ২.৪ মাইক্রোগ্রাম বি১২ প্রতিদিন গ্রহণ করলে এ সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে। সূর্যমুখীর বীজ, শসাদানা, কলিজাতে পাওয়া যাবে ভিটামিন বি৯।
ভিটামিন সি
নখে কোলাজেন তৈরিতে কাজ করে ভিটামিন সি। মজবুত করে তোলে, ফলে সহজে ভাঙে না। এটি এমন এক ধরনের প্রোটিন, যেটা নখের শেপ ঠিক রাখে। টিস্যুর অখণ্ডতায় কাজ করে। পর্যাপ্ত ভিটামিন সি না পেলে নখ ভাঙতে পারে। আরডিএর মতে পুরুষ দেহে প্রতিদিন ৯০ মিলিগ্রাম এবং নারী দেহে ৭৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। সিট্রাসি ফ্রুট যেমন কমলা, স্ট্রবেরি, কিউই এ ক্ষেত্রে সেরা সোর্স। আর রেড বেল পেপার তো একটি কমলার দ্বিগুণ পরিমাণ ভিটামিন সি সমৃদ্ধ বলে জানা যায়।
ফলিক অ্যাসিড
ফলিক অ্যাসিড নখের সুস্থতার জন্য জরুরি। ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড প্রতিদিন খাদ্যে উপস্থিত থাকলে এ-সংক্রান্ত সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে এ চাহিদা সবার সমান নয়। গর্ভবতী নারীদের দেহে ফলিক অ্যাসিডের চাহিদা তুলনামূলক বেশি। গাঢ় সবুজ সবজি, সিট্রাসি ফ্রুট, বিন, মটর, ডাল, ডিম ও দুধে ফলিক অ্যাসিডের উপস্থিতি থাকে।
আয়রন
দেহকোষে অক্সিজেন বহন করতে ভূমিকা রাখে। নখের ম্যাট্রিকস অংশ, যা নেইল প্লেইট প্রস্তুত করে, সেখানেও পৌঁছে দেয়। অ্যানিমিয়া অথবা আয়রনের ঘাটতিতে নখে লম্বালম্বি দাগ দেখা যায়। আকারে দেখা যায় পরিবর্তন। এমনকি অবতল অংশ চামচের মতো আকার ধারণ করতে পারে। আরডিএর মতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দিনে ৮ মিলিগ্রাম আয়রন প্রয়োজন। নারীর ১৮ মিলিগ্রাম; যদিও মেনোপোজের পরে এই চাহিদা কমে পুরুষের সমান হয়। প্রাণিজ খাবারে আয়রনের উপস্থিতি থাকে। গরু আর মুরগির মাংস, মাছ ও ডিমে এর উপস্থিতি বেশি। গাঢ় সবুজ শাকসবজি, বাদাম, বীজ, বিন এবং অন্যান্য ফর্টিফাইড খাবারেও আয়রন থাকে। ভিটামিন সি আছে এমন ফল যেমন কমলা, স্ট্রবেরি, পালংশাক ও বিন দেহে আয়রনের মাত্রা বাড়ায়।
ম্যাগনেশিয়াম
নখ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রোটিন সিনথেসিসে ভূমিকা রাখে, যা নতুন নখের গঠনে কাজ করে। এর অভাবে ভার্টিক্যাল লাইন তৈরি হয়। আরডিএর দেওয়া তথ্যমতে একজন পুরুষের গড়ে দৈনিক ৪০০ থেকে ৪২০ মিলিগ্রাম ম্যাগনেশিয়াম প্রয়োজন। মেয়েদের দেহে প্রয়োজন ৩১০ থেকে ৩২০ মিলিগ্রাম। হোল গ্রেইন আটা ম্যাগনেশিয়ামে সমৃদ্ধ। গাঢ় সবুজ শাকসবজি, আমন্ড, বাদাম, ব্ল্যাক বিনে যথেষ্ট পরিমাণ ম্যাগনেশিয়াম মিলবে।
ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড
আর্দ্রতার অভাবে নখ শুষ্ক হয়ে ওঠে। ভেঙে যায়। উজ্জ্বলতা হারায়। ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড দেবে হারানো আর্দ্রতা। নেইল বেডের উজ্জ্বলতা বাড়াবে। নখে কোনো প্রদাহ তৈরি হলে তা কমাতেও কার্যকর এটি। নখে প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়। এডিকুয়েট ইনটেকের মতে পুরুষ দেহের জন্য ১.৫ গ্রাম এবং নারীর জন্য ১.১ গ্রাম ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড যথেষ্ট।
জিংক
এর প্রভাবে নখ সুস্থভাবে বেড়ে ওঠে। কারণ, এটি গ্রোথ ও ডিভিশন সেল নিয়ে কাজ করে। শরীরে এর নিয়মিত সরবরাহ না থাকলে নেইল প্লেটে সাদা দাগ দেখা যায়। অ্যানিমেল প্রোটিনের বাইরে সয়া, চিকপি, ব্ল্যাক বিন ও বাদামে পর্যাপ্ত জিংক মেলে।
পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ ডায়েটের মাধ্যমে নখের স্বাস্থ্য ঠিক রাখা সম্ভব। মজবুত, উজ্জ্বল নখের জন্য যা প্রয়োজন, তা মিলবে সহজলভ্য খাবারেই। আবার বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি করা সাপ্লিমেন্টও রয়েছে। তবে সর্বাধিক কার্যকারিতার উদাহরণ পাওয়া যায় বায়োটিন সাপ্লিমেন্টের ক্ষেত্রে। বাদবাকির জন্য সরাসরি খাবারে ভরসা রাখা যেতে পারে। ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের ‘ভিটামিন অ্যান্ড মিনারেলস: দেয়ার রোল ইন নেইল হেলথ অ্যান্ড ডিজিজেস’ শিরোনামে পেপারের মাধ্যমে জানা যায় ভিটামিন ই, ভিটামিন সি (অ্যাসকরবিক অ্যাসিড), ভিটামিন এ, রেটিনল, রেটিনাল, সিলিকন, জিংক, আয়রন, কপার, সেলেনিয়াম আর ভিটামিন বি১২ এর সাপ্লিমেন্টের কার্যকারিতা সম্পর্কে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সারাহ্ দীনা
ছবি: সংগ্রহ