ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I স্বচ্ছতাই শক্তি
পোশাকেও। রানওয়ে থেকে রেড কার্পেটে তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ। ট্রাফিক-স্টপিং ফ্যাশনেবল লুকের জন্য বিশ্বজুড়ে তারকাদের শস্ত্র
শিয়ার ফ্যাব্রিক সেমিট্রান্সপারেন্ট। থিন থ্রেডে তৈরি। লো ডেনসিটির নিটিং প্রক্রিয়ায়। ফ্যাব্রিকের সীমানা ভেদ করতে পারে দৃষ্টি। স্বচ্ছ এই ফ্যাব্রিকের সঙ্গে পৃথিবীর প্রথম পরিচয় ১৭৯৮ সালে। না, কোনো ফ্যাশন শোর রানওয়েতে নয়। একটি চিত্রে। শিল্পকর্মে। ‘পোর্ট্রেট অব আ ইয়াং ওম্যান ইন হোয়াইট’ শিরোনামে, রংতুলিতে। তাতে দেখা যায়, সাদা স্বচ্ছ পোশাক পরে বসে আছেন একজন নারী। তার বুকের অংশ স্বচ্ছ কাপড়ের আড়ালে দৃশ্যমান। আর্ট ওয়ার্কটির শিল্পীর নাম জানা যায় না। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান সাহিত্যিক অটেসা মশফেগ তার ‘মাই ফিয়ার অব রেস্ট অ্যান্ড রিলাক্সেশন’ বইয়ের প্রচ্ছদে ব্যবহার করেন ছবিটি।
শিয়ার ফ্যাব্রিক নিয়ে কাজ করার অনুপ্রেরণায় বিশ শতক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তখনকার নারীরা ব্রেশিয়ারের বদলে ব্যবহার করতেন করসেট। সেখান থেকে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে জন্ম নেয় বক্ষবন্ধনী। ষাটের দশকে ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ইভ সাহ্ লহো তার নকশা করা পোশাকে ব্যবহার করেন ট্রান্সপারেন্ট ফ্যাব্রিক। সে সময় জনপ্রিয় হয় থাই বেয়ারিং মিনি স্কার্টস। আশি থেকে নব্বইতে ককটেল এবং নিট টপসে শিয়ার ফ্যাব্রিকের ব্যবহার দেখা যায়। অর্নামেন্টাল ও প্র্যাকটিক্যাল—দুই রকম কাজেরই মেলে দেখা।
ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশনের পরে ১৯১৩ সালে পোর্টল্যান্ডের মেয়র ফিনিফিনে ফ্যাব্রিকে তৈরি স্কার্ট ও টপ পরিধান করলে শাস্তিযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪২ সালে মিডিয়া সেন্সরশিপ বোর্ডও এ নিয়ে নতুন নিয়ম জারি করে। মানুষ তো বটেই, কার্টুন ক্যারেক্টারও আটকে যায় নিয়মের এই বেড়াজালে। জনপ্রিয় কার্টুন ক্যারেক্টার টুইটি বার্ড ‘আ টেল অব টু কিটি’র অ্যানিমেটর বব ক্ল্যাম্পেট প্রাথমিকভাবে পালকহীন টুইটির ফিগার এঁকেছিলেন। কিন্তু এ নিয়ে প্রশ্ন তোলে মোশন পিকচার প্রোডাকশন। তাদের প্রতিষ্ঠান সেন্সরশিপের যে গাইডলাইন মেনে চলে, সে অনুযায়ী আপত্তি তোলা হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, টুইটি বার্ড চরিত্রটি ‘টু নেকেড’। প্রদর্শনযোগ্য নয়। অ্যানিমেটর ক্ল্যাম্পেট তখন হলুদ পালকে গা ঢেকে দেন টুইটির।
বিভিন্ন জাদুকরি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে শিয়ার। শেষমেশ পরিণত হয়েছে পাওয়ারে। ষাট, সত্তর ও আশির দশকে জনপ্রিয়তা থাকলেও নব্বইতে তা পৌঁছে যায় শীর্ষে। এর মধ্যে ১৯৬২ সালে মেরিলিন মনরোর ‘হ্যাপি বার্থডে মিস্টার প্রেসিডেন্ট’খ্যাত জেন লুইয়ের ডিজাইন করা গাউনটি ছিল শিয়ারনেসের জনপ্রিয় হওয়ার বিশেষ কারণ। নতুন এক সাহসী যুগের সূচনা যেন। ১৯৯৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইনার হান্টার শাফারসের মাধ্যমে প্রাডার স্প্রিং কালেকশনে দেখা যায় শিয়ার। ১৯৯৮ সালে অভিনেত্রী ও অ্যাকটিভিস্ট রোজ মেকগাউয়েন এমটিভি ভিডিও মিউজিক অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন লেপার্ড প্রিন্ট থংয়ের ওপরে স্বচ্ছ গাউনে। পোশাকটির নকশাকে বলা হয় চেইন-মেইল-এস্ক ড্রেস। এমন পোশাকে উপস্থিতি সে সময়ের শিরোনামে পরিণত হয়। আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটান রোজ নিজেই। আমেরিকান টেলিভিশন প্রেজেন্টার হারভে ওয়েনস্টাইনের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানিয়েছিলেন, হলিউড মোগল হারভে ওয়েন্সটেইন তাকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন এবং সেই দুর্ঘটনার পরে তিনি প্রথম এই পোশাক পরে সবার সামনে আসেন। সে সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়েছিল, দেহের এই উন্মুক্ত প্রকাশই তো চাচ্ছে সবাই!’ একই সঙ্গে তিনি এটিকে পলিটিক্যাল স্টেটমেন্ট হিসেবে দাবি করেন। এই আলাপচারিতায় উঠে আসে, ‘রিভিলিং’ ড্রেস সংস্কৃতির পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখতে পারে। রোজের জন্য স্বচ্ছ সেই পোশাক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল, বলা যেতেই পারে। কারণ, পোশাকের এই সাহসী প্রকাশ তাকে নিপীড়নের বিষয়ে অকপট হতে সাহায্য করেছে।
এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ফল কালেকশনে ডিজাইনার অ্যালবার এলবাজ প্রকাশ করেন তার শিয়ার ফ্যাব্রিক কালেকশন। যেখানে শিয়ার ব্রা দেখা যায়। স্পষ্ট হয় নারীদেহের স্বাভাবিক সৌন্দর্য।
২০০৪ সালে সুপার বউল কনসার্টে জ্যানেট জ্যাকসন ড্রেস ম্যালফাংশনের কারণে কঠোর সমালোচনার শিকার হন। জাস্টিন টিম্বারলেকের হাতে লেগে জ্যানেটের টপের একটি অংশ খুলে এলে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে একটি নিপল। পরবর্তীকালে জ্যানেট গ্রামি অ্যাওয়ার্ড থেকে বঞ্চিত হন। এফসিসি, অর্থাৎ ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন এ জন্য ১৫ হাজার ডলার ফাইন দেওয়ার নোটিশ জারি করে। ব্ল্যাক লিস্টেড হন এই গায়িকা। পরে এফসিসির এমন সিদ্ধান্তের বিপক্ষে সুপ্রিম কোর্ট একটি রুল জারি করেন। ইউএস কোর্ট জ্যানেটের কস্টিউম ম্যালফাংশনের ঘটনাকে ন্যুডিটি গণ্য করে তাকে দোষী হিসেবে আর্থিক দণ্ড দেওয়ার বিষয়ে এফসিসির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। এ ঘটনা ‘নিপলগেট’ এবং ‘জ্যানেটগেট’ দুই শিরোনামেই আলোচনায় আসে। দেহের একটি অংশ দৃশ্যমান হওয়ার কারণে জ্যানেটকে অপরাধী বিবেচনা করা মেনে নিতে পারেননি সেলেবসহ সাধারণেরাও। প্রতিবাদ-আলোচনা—দুই-ই চলে সমানতালে।
পরে ২০১২ সালে ‘ফ্রি দ্য নিপল’ হ্যাশট্যাগে মুভমেন্ট শুরু হয়। এটি মূলত একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আন্দোলন। তখন ‘ফ্রি দ্য নিপল’ টাইটেলের একটি চলচ্চিত্রের প্রি-প্রোডাকশনের কাজ চলছিল। পুরুষের ক্ষেত্রে এমন নিপল দৃশ্যমান হওয়াকে স্বাভাবিক ধরে নেওয়া হলেও মেয়েদের জন্য শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হবে কেন, সেই প্রশ্ন থেকে আন্দোলনের সূচনা। হলিউড তারকারাও যোগ দেন তাতে। যেমন তারকা গায়িকা মাইলি সাইরাস, অভিনেত্রী চেলসিয়া, গায়িকা ও অভিনেত্রী রিহানা এবং মার্কিন মডেল ক্রিসি টেইজেনের সরব উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল সে সময়। রিহানা ধীরে ধীরে শিয়ার ড্রেসের অ্যাম্বাসেডর হয়ে ওঠেন। সিএফডির আইকন অব দ্য অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন সম্পূর্ণ স্বচ্ছ একটি পোশাকে। সেটি ডিজাইন করেছিলেন অ্যাডাম সালমান।
শিয়ারনেস ফুল ফোর্সে ফিরে আসে ২০২২ সালে। লাক্সারি ব্র্যান্ড শ্যানেল, প্রাডা, ফেরাগামো, ডায়ন লি, ওয়াই প্রজেক্টসহ আরও বেশ কিছু লেবেলের ট্রান্সপারেন্ট কালেকশন সে সময় নজর কাড়ে। কাইলি জেনার, কেন্ডাল জেনার, হেইলি বিবারের মতো সেলেবরা স্বচ্ছ পোশাক পরেছেন, পরছেন। পুরুষদের পোশাকেও দেখা গেছে এই ট্রেন্ড। আমেরিকান অভিনেতা অস্টিন বাটলার এবং কানাডিয়ান লিরিসিস্ট ও গায়ক শন মেন্ডেসকেও সে সময় ভিড়তে দেখা গেছে শিয়ার পাওয়ারের শিবিরে।
তারকাসহ ফ্যাশন-সচেতন অনেকের মনে জায়গা করে নিতে পারলেও এখনো সংবেদনশীলতার তকমা আছে শিয়ারের গায়ে। প্রচুর তিক্ত সমালোচনারও শিকার হয়েছে, হচ্ছে। শিয়ার ফ্যাব্রিকের সর্বাধিক ব্যবহার একসময় দেখা গেছে ড্রেসের চেস্ট পার্টে। আরও দৃশ্যমান করে তুলতে ইতিহাসজুড়ে নিপল সিম্বলাইজড হয়েছে অনেক রকমের মানে নিয়ে। ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবেও পেয়েছে গুরুত্ব। আমেরিকান মিডিয়ায় নিপল দৃশ্যমান হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি ছিল বহু বছর। এখন সেখানে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। অনেকে পুরো বডির জন্য শিয়ার ড্রেস বেছে নিচ্ছেন।
সমালোচনা যেমন হয়েছে, তেমনি ক্ষমতায়নের সুবাতাস নিয়ে এসেছে এই ট্রেন্ড। ইন্টারনেটে অনেক ধরনের মতামত রয়েছে এ নিয়ে। পক্ষে-বিপক্ষে। নিজেদের শরীর নিয়ে নারীরা যে সংকটে ভুগে থাকেন, তাতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন অনেক ফ্যাশনবোদ্ধা। নারীদের প্রতি গোঁড়া মানসিকতা প্রদর্শনের বিপক্ষে গড়ে উঠছে মত।
সারাহ্ দীনা
ছবি: ইন্টারনেট