ফিচার I প্যান্টস্যুট শুধুই পুরুষের?
লিঙ্গ পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে এই পোশাক। পুরুষ-নারী বাইনারির বেড়াজাল ভেঙে ইনক্লুসিভ ফ্যাশনে তাই ক্রমেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই পাওয়ার ড্রেসিং স্টেপল
শুরুর স্মৃতি খুব একটা সুখকর নয় এই পোশাকের। ইতিহাস সাক্ষী, প্যান্টস্যুট ছিল কাটখোট্টা করপোরেট পরিবেশের প্রতিচ্ছবি। গুমোট আর গণ্ডিতে বাঁধা কর্মস্থলের পোশাক, পুরুষদের জন্য। পুরুষতন্ত্রের প্রতীক বলা হতো একে। তবে সময়ের বদল ঘটে ষাটের দশকে। যখন নারীরাও পরতে শুরু করেন এ পোশাক। লন্ডন বেসড ফল অ্যান্ড টাফিন, যুক্তরাষ্ট্রের লুবা মার্কসের মতো ডিজাইনারদের বরাতে নারীদের কাছে প্যান্টস্যুটের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়তে শুরু করে। ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ইভ সাহ্্ লহো এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৬ সালে তিনি নকশা করেন ‘লে স্মোকি’ নামের একটি সন্ধ্যাকালীন প্যান্টস্যুট, মেনজ টাক্সেডোর আদলে। ব্যস, তাতেই কেল্লা ফতে। হুড়মুড়িয়ে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এ পিসের। অবশ্য তাই বলে যে মানুষের বাঁকা চোখে তাকানো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তা নয়! ১৯৯৩ সালে ইউনাইটেড স্টেট সিনেট ফ্লোরে প্যান্টস্যুট পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। তবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যান সিনেটর বারবারা মিকালস্কি ও ক্যারল ব্রাউন। প্যান্টস্যুট পরেই দেখান প্রতিবাদ। পরবর্তী সময়ে নারী সাপোর্ট স্টাফরাও একইভাবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন নতুন নিয়মের বিরুদ্ধে। এরপর পরিবর্তিত হয় বিধি। প্যান্টস্যুট পরার অনুমতি মেলে।
হিলারি ক্লিনটনের রাজনৈতিক যাত্রাতেও প্যান্টস্যুট দারুণ চর্চার বিষয় হয়ে ওঠে। ক্রমেই নারীদের ফরমাল অ্যাটায়ার হিসেবে শক্ত অবস্থান তৈরি হয় বিতর্কিত এ পোশাকের। তবে ২০১৮-তে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে এর স্টাইলিংয়ে। আরও বেশি বৈচিত্র্য দেখা যায় কাট, প্যাটার্ন আর প্রিন্টে। ফলাফল ক্লাসি করপোরেট ওয়্যার হয়ে ওঠে আধুনিক নারীর ফ্যাশনেবল আউটফিট। টাইমলেস এই পিস পরা শুরু হয় বছরের যেকোনো সময়, যেকোনো আয়োজনে।
ইউনিসেক্স ফ্যাশনের যেকোনো একটি ট্রেন্ড ফলো করতে চোখ বুজে প্যান্টস্যুট বেছে নিচ্ছেন হালের ফ্যাশন-সচেতনেরা। পাওয়ার ড্রেসিং এসেনশিয়ালে পরিণত হওয়া প্যান্টস্যুট জায়গা করে নিচ্ছে সেলিব্রিটি, ইনফ্লুয়েন্সার এমনকি রাজপরিবারের ওয়্যারড্রোবেও। তাই যারা ওয়্যারড্রোব আপডেটের জুতসই বিকল্প খুঁজছেন, তাদের জন্য এর থেকে ভালো কিছু সম্ভবত আর হয় না।
এ বছর আবার ভোল পাল্টেছে প্যান্টস্যুট। ক্লাসিক বিজনেস স্যুট, সিঙ্গেল ও ডাবল ব্রেস্টেড জ্যাকেটের পাশাপাশি নজর কাড়ছে অ্যাসিমেট্রিক জ্যাকেট, আনইউজুয়াল প্যান্ট এবং অভিনব সব ট্রিমিং—সবটাই ক্রিয়েটিভ কাটের জাদু। কালার স্কিমের বৈচিত্র্যও চোখে পড়ছে বেশ। সাদা-কালো আর ধূসরের পাশাপাশি প্যালেটের চোখধাঁধানো উজ্জ্বল রংগুলো রাঙাচ্ছে প্যান্টস্যুটের মতো পাওয়ার ড্রেসকে।
থ্রিপিস স্যুট
প্যান্ট, ভেস্ট ও জ্যাকেটের ক্লাসিক কম্বিনেশন। খানিকটা ম্যাসকুলিন ধাঁচের। এবারের সিজনে এর রিল্যাক্সড ভার্সন মাতাচ্ছে ফ্যাশন দুনিয়া। তুলনায় একটু লম্বা ভেস্টের ব্যবহার অফিসে তো বটেই, প্যান্টস্যুটকে ব্যবহার উপযোগী করে তুলছে প্রতিদিনকার আউটফিট হিসেবেও। আরও ক্যাজুয়াল স্টাইলিংয়ের জন্য থ্রিপিসের মধ্যে থাকা ভেস্টকে বদলে খাটো টপের যোগ হতে পারে লুকে। ম্যাটেরিয়াল ও কাটের ওপর নির্ভর করবে আউটফিটে পরিধানকারীকে রোমান্টিক দেখাবে, নাকি বস লেডি। মজার ব্যাপার, তুড়িতেই স্টাইলে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে প্যান্টস্যুট। স্যুটের বোতাম বন্ধ হলেই অফিস রেডি অ্যাটায়ার, আর খুলতেই পার্টিতে পরার জন্য পারফেক্ট।
পাশাপাশি খাটো প্যান্ট
এ বছর প্যান্টস্যুটের প্যান্ট ফুল লেন্থ না হলেও অসুবিধা নেই। অনেক ফ্যাশন ব্র্যান্ডই এবার রানওয়েতে দেখিয়ে দিয়েছে শর্ট প্যান্টের সঙ্গতে স্যুট বিজনেস স্টাইলকে এতটুকুও প্রভাবিত করে না। প্রতিদিন পরার উপযোগী কিছু চাইলে ক্লাসিক স্ট্রেইট কাট প্যান্টের বদলে জগার্স আছে এমন প্যান্টস্যুট সেটগুলোই বেশি ভালো হবে। এ ধরনের প্যান্টের পায়ের কাছে থাকা ইলাস্টিক ডিটেইল নিমেষেই বিজনেস স্টাইলকে দেয় স্পোর্টি শিক লুক।
চলবে চওড়াও
যারা খাটো প্যান্টে স্বচ্ছন্দ নন, তাদের জন্য বিকল্প এটি। সাধারণ সটান সোজা এবং সামান্য টেপারড কাটের হয়ে থাকে। ভ্যালেন্তিনো আর এম্পোরিও আরমানির শোতে দেখা গিয়েছিল এমন স্টাইলের প্যান্টস্যুট। শ্যানেলও হেঁটেছে একই পথে। তাদের ফল-উইন্টার কালেকশনে স্যুটের সঙ্গে লুজ ফিটিং টুইড প্যান্ট তারই প্রমাণ। চওড়া প্যান্টের সঙ্গে স্যুট হিসেবে বেছে নেওয়া যাবে মানানসই ঢোলাঢালা ওভারসাইজ অথবা হাফ প্রাইমড ক্লাসিক স্টাইলেরগুলো। সবচেয়ে ফ্যাশনেবল সলিউশন চাই? চওড়া কাঁধের স্যুট বেছে নেওয়া যেতে পারে চোখ বন্ধ করে।
শর্ট স্যুটের সঙ্গত
শুধু প্যান্ট নয়, এ বছর স্যুটেও দেখা যাচ্ছে বৈচিত্র্য। ক্লাসিক লেন্থের অর্থাৎ ওয়েস্টলাইন পেরিয়ে যাওয়া স্যুটগুলোর বদলে ফ্যাশনেবল হয়ে উঠেছে ক্রপড স্টাইলেরগুলো। কাট এ ক্ষেত্রে হতে পারে ক্লাসিক, ক্রিয়েটিভ কিংবা ফরমাল শার্টের মতো।
ভেস্ট ভাও
এ ধরনের স্টাইলে স্যুট বাদ, বরং শুধু ভেস্টকেও টপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফিটেড ও লুজ—দুই ধরনের স্টাইলই তৈরি করছেন ডিজাইনাররা। সঙ্গে প্যান্ট হিসেবে অপশন রয়েছে মেলা। টাইট প্যান্ট, স্কিনি মডেল অথবা ওয়াইড বটম—চলবে সবই।
ক্রিয়েটিভ ডিজাইন
যারা স্ট্রিট স্টাইল ফ্যাশনের ফ্যান, তাদের জন্য ক্রিয়েটিভ কাটের প্যান্টস্যুটগুলোই যথার্থ। এ জন্য অনুপ্রেরণা নেওয়া যেতে পারে বাঘা ব্র্যান্ডগুলোর রানওয়ে থেকে। আলেক্সান্ডার ম্যাককুইনের স্লিটেড স্লিভ আর ওয়েস্টের প্যান্টস্যুটের প্রশংসায় মুখর ছিল পুরো ফ্যাশন বিশ্ব। আর এম্পোরিও আরমানি তো লেস-আপ স্যুট তৈরি করে আক্কেল গুড়–ম করে দিয়েছিল সবার। আভো-গার্ড, ডিকনস্ট্রাকটিভিজম, কনস্ট্রাকটিভিজম—এ বছর এগুলোরই ঝলক দেখা গেছে প্যান্টস্যুটে।
শাইন ব্রাইট
সন্ধ্যাকালীন প্যান্টস্যুটে সামান্য গ্ল্যামার যোগ করতে ডিজাইনাররা এবার সাহায্য নিয়েছেন গ্লিটারের। ডলশে অ্যান্ড গ্যাবানার স্যুটের লেপেলে ট্রিম করে বসানো হয়েছে সিকুইন। পাকো রিবানা তাদের প্যান্টস্যুট তৈরি করেছে মেটালাইজড স্পার্কলিং ফ্যাব্রিকে। ব্র্যান্ড ব্রুনেলো কুচিনেল্লির ডিজাইনাররা তো আরও একধাপ এগিয়ে। স্যাটিনে তৈরি করেছেন প্যান্টস্যুট, যার পুরোটা সিকুইনের ভারী আস্তরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। ব্যবহৃত হয়েছে রাইনস্টোনও। মাইকেল করস এর প্যান্টস্যুটে।
স্যাটিন, সিল্ক আর ডেনিম
শুধু যে স্যুট ফ্যাব্রিক অথবা মোটা টুইড ব্যবহার করতে হবে প্যান্টস্যুট তৈরিতে, তা কেন! স্যাটিনে তৈরি প্যান্টস্যুট রানওয়েতে প্রদর্শিত হয়েছে এ বছর। ফেন্দির স্প্রিং-সামার কালেকশনে। ভারী সিল্কের প্যান্টস্যুট নিয়ে এসেছিল গুচি। আর ডিওর তো অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছে। স্টাইলিশ ডেনিম প্যান্টস্যুট তৈরি করে। গরমে তালিকায় যোগ হতে পারে লিনেন ও কটন। শীতে উল।
বোল্ড কালার
ওয়্যারড্রোবে ধূসর, কালো ও বাদামির পাশাপাশি না হয় থাকল দু-একটা চোখধাঁধানো উজ্জ্বল রঙের প্যান্টস্যুট। কমলা, লাল প্যান্টস্যুটে আরও বেশি সাহসী দেখাবে যে কাউকে। থাকতে পারে হালের বারবিকোর ইন্সপায়ারড গোলাপির নানা শেড। হলুদও কিন্তু মন্দ দেখাবে না। খোদ ডিজাইনাররাই বলছেন সে কথা।
মনে রাখা চাই
ফুটওয়্যার বাছাইয়ের ক্ষেত্রে হতে হবে সাবধানী। প্যান্টস্যুটের কাট আর শিলুয়েট মাথায় রেখে। এলিগ্যান্ট ও ফরমাল ডিজাইনের সঙ্গে ক্লাসিক পাম্প ভালো দেখাবে। প্যান্টের দৈর্ঘ্য খাটো হলে চলতে পারে স্নিকার; এমনকি স্যান্ডেলও। আর খানিকটা আলাদা ডিজাইনের প্যান্টস্যুটগুলোর সঙ্গে পায়ে পরা যেতে পারে এসপাড্রিলস বা বোগ্রস। ফ্যাশনিস্তা হিসেবে পরিচিত মহলে চর্চিত হয়ে উঠতে।
টেইলারিংয়ের অপশন থাকলে কাস্টম মেড প্যান্টস্যুট বেছে নেওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের। তবে না থাকলে প্রথমে পরে দেখে নেওয়া চাই ঠিকঠাক ফিট হচ্ছে কি না। হাত ওপরে উঠিয়ে এবং সামনের দিকে ঝুঁকে দেখতে হবে শরীরে কোনো অস্বস্তি হচ্ছে কি না। ওভারসাইজড হলেও ট্রাই অন ইজ মাস্ট।
জাহেরা শিরীন
মডেল: মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস