যাপনচিত্র I অন্তর্মুখীর অন্দরমহল
সুনিধি নায়েক। কণ্ঠশিল্পী। গান নিয়ে নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন। কোক স্টুডিওর সিজন-টুতে জীবনসঙ্গী অর্ণবের সঙ্গে ‘সন্ধ্যাতারা’ গানটি গেয়ে রয়েছেন আলোচনায়। জানা যাক তার একান্ত জীবন
তিন বছর বয়স থেকে মায়ের কাছে সুনিধির গান শেখা শুরু। আট বছর বয়সে শ্রুতিনন্দনে গিয়ে শরণাপন্ন হন গুরুজি পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর। দীর্ঘদিন ভোকাল ট্রেনিং থেকে ক্ল্যাসিক্যাল- সবকিছুর দীক্ষা নিয়েছেন সেখান থেকেই। বাড়িতে চালিয়ে গেছেন ক্ল্যাসিক্যাল চর্চা। বাবার ইচ্ছাতেই রবীন্দ্রসংগীত শেখা ও চর্চা শুরু। মাধ্যমিকের পর ভর্তি হন বিশ্বভারতীতে। গ্র্যাজুয়েশন, মাস্টার্স- সবকিছু সেখান থেকেই করেছেন। বলে রাখা ভালো, সুনিধির রেজাল্ট ছিল চোখধাঁধানো। তিনি সেখানকার একজন ন্যাশনাল স্কলার।
সুনিধির বেড়ে ওঠা ভারতের কলকাতায়। পড়াশোনার পাশাপাশি গান শেখাতেন তখন। বাংলাদেশে আসার আগে তা-ই করে গেছেন অবিরাম। তিনি বলেন, ‘নতুন একটি দেশে এসে নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানো, ক্যারিয়ার গড়ে তোলা সবার মতো আমার জন্যও কঠিন ছিল। কলকাতার ভাষা ও মানুষের সঙ্গে এখানে মিল থাকলেও ভিন্নতাও আছে বেশ। পাশাপাশি অনেক কিছুতেই ছিল অনেক নতুনত্ব।’
কলকাতার সংগীতের সঙ্গে তুলনা করতে গিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে এ রকম শিল্পী বেশি, যারা নিজেরাই গান লিখেন, সুর করেন, মৌলিক গান বানান। এ দেশে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গান বানিয়ে ইউটিউব, নানা রকম স্ট্রিমিং সাইটে রিলিজ দিচ্ছেন, যা বেশ ইতিবাচক। অন্যদিকে, কলকাতায় অভিভাবক মহল থেকেই একধরনের তাড়না থাকে হিন্দুস্তানি ক্ল্যাসিক্যাল শেখানোর।’
ছোটবেলায় বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অদিতি মহসিনের গান শুনতেন বেশি। নতুনত্বকে গ্রহণ করতে ভালোবাসেন যে মানুষ, তার ব্যক্তিজীবন কেমন? জানালেন, সবকিছুর বাইরে সাংসারিক জীবনে অর্ণবকে ঘিরে সময় কাটে। অর্ণবের কী বেশি ভালো লাগে- এমন প্রশ্নের জবাবে বললেন, ‘হি ইজ আ গুড ফ্রেন্ড।’
সুনিধির জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে আছে তার পোষা কুকুর। ওই জার্মান শেফার্ডের নাম রেখেছেন কার্মা। দেড় বছর ধরে একই সঙ্গে ঘুমোতে যাওয়া, ঘুম থেকে ওঠা, খেলাধুলা চলে ওর সঙ্গে। নিজেই কুকুরটির গ্রুমিং, গোসল, নখ কাটা, ব্রাশ করানোর মতো দায়িত্ব সামলান। প্রাণীটির প্রতি এই গায়িকার রয়েছে এক দারুণ মমত্ববোধ।
রাত জেগে নানা রকম দাওয়াত অথবা পার্টি করা খুব একটা টানে না সুনিধিকে। যতটা জলদি সম্ভব ঘুমিয়ে পড়াই পছন্দ। খুব বেশি রাত জাগলেও তা ১২টা-১টা ছাড়িয়ে নয়। স্বভাবে তিনি খানিকটা অন্তর্মুখীও বটে! সচরাচর সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়েন। ৯টার দিকে সারেন ব্রেকফাস্ট। মেনুতে থাকে পাউরুটি, পিনাট বাটার, আমন্ড, বিভিন্ন ফল। এরপর ১১টার দিকে জিমে যাওয়া চাই তার।
শান্তিনিকেতনের প্রাকৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা সুনিধি ঢাকায় এসে সানলাইট থেকে দূরে থাকার কারণে ভিটামিন ডি-এর স্বল্পতায় ভুগেছিলেন বেশ। দুই বছর আগে একপ্রকার শয্যাশায়ীও হয়ে পড়েছিলেন। পরিত্রাণ পেতে শুরু করেন এক্সারসাইজ। নিজেকে সুন্দর ও পরিপাটিভাবে উপস্থাপন করা এবং সুস্থ রাখার তাড়না অবশ্য তার অনেক আগে থেকেই। জিমে গিয়ে প্রথম ৩৫ মিনিট কার্ডিও করে ২৫০ থেকে ৩০০ ক্যালরি বার্ন করার চেষ্টা করেন। কার্ডিও বলতে শুধু ট্রেডমিলেই সময় দেন। এরপর দেড় ঘণ্টা করেন ওয়েট লিফটিং। কিছুটা সময় ব্যয় করেন পিলাটিজ ও প্ল্যাঙ্কস করতেও। ব্যায়াম শেষে শাওয়ার নিয়ে ফেরেন বাসায়। তবে জিমে শাওয়ার নিতে না পারলে বাসায় এসে নেন। এরপর বেলা ২টায় সারেন মধ্যাহ্নভোজ। মেনুতে থাকে সামান্য পরিমাণে কার্ব, দুই টুকরো মাছ অথবা চিকেন। সবকিছুর পর সবজি খেতে ভালোবাসেন।
ঢাকাবাসী সুনিধিকে শান্তিনিকেতন অহর্নিশ ডাকে! সেখানে তিনি থাকতে শুরু করেছিলেন ২০১২ সাল থেকে। সুনিধি বলেন, ‘শান্তিনিকেতন এমন এক জায়গা, যেখানে একজন অসুস্থ মানুষ গেলেও সুস্থ হয়ে ওঠা সম্ভব! শান্তিনিকেতনের সীমানা এত বড়, সেখানে কোনো একটা কাজে হেঁটে গেলে আলাদা করে হাঁটার অথবা ব্যায়াম করার প্রয়োজন পড়ে না। আমি আর অর্ণব একটুখানি ছুটি বা অবসর পেলে এখনো সেখানে ছুটে যাই।’
ঘর সাজাতে ভালোবাসেন সুনিধি। এ ক্ষেত্রে সব সিদ্ধান্ত নিজেই নেন। বার কাউন্টার, বাবার পেইন্টিংসের পাশাপাশি কামরুল হাসান, যোগেন চৌধুরী, অর্ণবের পেইন্টিংসসহ বাহারি সব অনুষঙ্গে সাজিয়েছেন ঘর। ডোপামিন ডেকরের শখ তার তীব্র। বাসায় ব্রাইট লাইটের চেয়ে ওয়ার্ম লাইট রাখতে ভালোবাসেন বেশি।
সুনিধিকে দেখলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, তিনি শাড়ি পরতে পছন্দ করেন। শাড়ি পরাকে অনেকে ঝামেলার মনে করলেও সুনিধি এই কাজ করতে পারেন চোখের নিমেষে। শাড়ির বাইরে জিনস, ক্রপ টপস, টপস, ওয়ান পিসসহ কমবেশি সবকিছুতেই স্বচ্ছন্দ তার। প্রিয় রং নীল আর প্রিয় অ্যাকসেসরিজ আংটি।
নিজের স্টাইলের ব্যাপারে তিনি বেশ সচেতন। বেশি মেকআপ পছন্দ করেন না। স্কিন কেয়ারে সাবধানী। ডার্ক সার্কেলে কিছুটা ফাউন্ডেশন দিয়ে খানিক মেকআপ, এই তো! বাইরে গেলে ইয়ার রিং পরেন। সবকিছু মিলিয়ে বেশ মিনিমালিস্টিক।
সুনিধি হেয়ারকাট করেন ট্রেন্ড অনুযায়ী। আগে চুল বড় রাখলেও এখন মাঝারি রাখেন বেশি। সানগ্লাস ভীষণ পছন্দ। প্রিয় ব্র্যান্ড প্রাডা। সংগ্রহ করতে ভালোবাসেন স্যান্টেড ক্যান্ডেল, ইনসেন্স। সুনিধির স্টাইলে অন্য মাত্রা দিয়েছে তার শরীরে বার্তা ছড়ানো পাঁচটি ট্যাটু। প্রথম ট্যাটু করেছিলেন ২০১৬ সালে। এরপর থেকেই ট্যাটু করার নেশা চেপে বসে তার।
রান্না করা তার শখ। শান্তিনিকেতনে থাকার সময় থেকেই নিজের রান্না নিজে করেন। ব্যস্ততা ও সময়স্বল্পতার কারণে এখন অবশ্য রান্না করার সময় মেলে না তেমন। অর্ণব, পরিবার, বন্ধুবান্ধব- সবার চোখেই তার রান্না করা সেরা খাবার রাজস্থানী জাইসালমেরে মাটন কসা।
সুনিধি বেশ ভ্রমণপিয়াসি। তিন বছর ধরে, প্রতিবছর একাই চলে যান হিমালয় ট্রেকিংয়ে। এ পর্যন্ত একপ্লোর করেছেন পাঁচটি উপত্যকা। বাকি উপত্যকাগুলো এক্সপ্লোর করতে চান সবার আগে। এ নিয়ে হিমালয়ে গেছেন চারবার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পটভূমিতে বরফাবৃত পর্বতচূড়া, পাহাড়ের বুকে সবুজ বনাঞ্চল- হিমালয়ের এমন উপত্যকা সুনিধিকে বারবার সম্মোহিত করে।
অবসরে তার আরেকটি পছন্দের কাজ বই পড়া। প্রিয় লেখক সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এ ছাড়া সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সিরিজ, আগাথা ক্রিস্টির লেখা বই তার পছন্দের। গান শোনার ক্ষেত্রে পছন্দের শিল্পী টেইলর সুইফট, সেলেনা গোমেজ, অ্যাকোন, ব্রুনো মার্স, মাইকেল জ্যাকসন।
মাঝেমধ্যেই চোখ রাখেন মুভি ও টিভি সিরিজে। সম্প্রতি দেখা ‘মেইড ইন হেভেন’ তার অসম্ভব পছন্দের টিভি সিরিজ। বলিউড সিনেমা অনেক পছন্দের। শাহরুখ খানের তিনি ভীষণ অনুরাগী। পছন্দের অভিনেত্রী দীপিকা পাড়–কোন। সেলিব্রিটি ক্রাশ রবার্ট প্যাটিনসন। পছন্দের ব্যক্তিত্ব বাবা।
সুনিধি রাতের খাবার সারেন সাড়ে এগারোটায়। পাতে রাখেন সামান্য ভাত, চিকেন অথবা মাটন আর সবজি। এভাবেই যাচ্ছে দিন এই তারকার।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন