কুন্তলকাহন I সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে
ঠাকুরবাড়ির সেই বিখ্যাত দোতলার দক্ষিণের টানা বারান্দা। শেষ দুপুরের এলিয়ে পড়া রোদের লুটোপুটি তাতে। একে একে অন্দরমহলের সেই বারান্দায় উপস্থিত ঠাকুরবাড়ির নারীরা। দাসীদের হাতে তাদের সাজের বাক্স। গোধূলিবেলার আগে নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়ার এই তো মোক্ষম সময়। চুলে তেল মেখে, নানান ছাঁদের খোঁপা বেঁধে তাতে গুঁজে দেওয়া সোনা বা রুপার কাঁটা। জড়িয়ে নেওয়া ফুল। এর আগের প্রস্তুতিও বিশদের গণ্ডি পেরোনো। পিছিয়ে ছিলেন না পুরুষেরাও
সে সময় চুলের যত্ন নিতে শিখিয়েছিলেন এ বাড়ির বাসিন্দারা। ভালো করে চুল আঁচড়ানোটা ছিল যত্নের প্রথম ধাপ। বাড়িতে ছিল পরিচারিকার দল। তারা স্নানের পর আর বিকেলে মেয়েদের চুল ভালোভাবে আঁচড়ে দিতেন। এরও নিয়ম ছিল। প্রথমে পাঁচ আঙুলে ধীরে ধীরে বিলি কেটে জট ছাড়িয়ে তারপর ছোট, সরু, বড়- নানা রকম চিরুনি দিয়ে ভালো করে আঁচড়ানো হতো। বিকেলে সবাই নিয়ম করে চুল বাঁধতেন। চুলে দেওয়া হতো নানা রকম তেল। গোছা বাড়ানোর জন্য দেওয়া হতো ম্যাকাসর তেল। তালিকায় আরও ছিল জবাকুসুম, আমলা, লক্ষ্মীবিলাস, কেশরঞ্জন, কুন্তলীন। তা ছাড়া ঘন চুলের জন্য বাড়িতে বানানো হতো বিশেষ ধরনের তেল। তার জন্য বড় বাজার থেকে আনা হতো একরকম মসলা। চিনামাটির পাত্রে সেই মসলা, খুদে মেথি আর আধখানা করে কাটা শুকনা আমলকী নারকেল তেল মিশিয়ে রোদে দিয়ে রাখা হতো কিছুদিন। তেলটা ধীরে ধীরে লাল রং হয়ে যেত। মসলাটার একটা সুগন্ধ থাকত। তারপর সেই তেল ছেঁকে বোতলে ভরে নিয়মিত দেওয়া হতো চুলে। এ ছাড়া নারকেল তেলে মেথি মিশিয়েও চুলে মাখা হতো। মাখানোর পদ্ধতিও ছিল বিশেষ। চুল সরিয়ে সরিয়ে মাথায় বিলি কেটে তেল দেওয়ার রেওয়াজ ছিল।
সপ্তাহে এক দিন মাথা ঘষা হতো। তবে কোনো সাবান বা শ্যাম্পু দিয়ে নয়। তার বদলে ব্যবহার করা হতো বেসন বা রিঠা। বেসন প্রথমে ছেঁকে নিয়ে তারপর তার সঙ্গে কয়েকটা জবাপাতা থেঁতো করে মিশিয়ে সেটা বিলি কেটে মাথায় মাখিয়ে দিতেন পরিচারিকারা। গোটা মাথায় ভালো করে মাখিয়ে অপেক্ষা করা হতো। তারপর প্রচুর পানি দিয়ে চুল ধুয়ে দিতেন তারা।
রিঠা ভিজিয়ে রাখা হতো আগের দিন রাতে। পরদিন ওই পানিতে রিঠা রগড়ে ফুটিয়ে তা দিয়েও মাথা ঘষা হতো। এ ছাড়া মাথা ঘষার জন্য বেনেদের দোকানে পাওয়া যেত একধরনের শিকড়। এর সঙ্গে ছোট মেথি আর আমলকী একসঙ্গে বেটে তা-ও ব্যবহার করা হতো। খুব তেলচিটে হয়ে গেলে চুলের ফাঁকে ফাঁকে ঘষে নিতেন শুকনা বেসন। তাতে সাময়িকভাবে চুলে একটা জেল্লা আসত। চুল আর শরীরকে চকচকে করার জন্য তারা গোসলের পানিতে মেশাতেন সুগন্ধি টয়লেট ভিনিগার; যা শরীরকে করে তুলত চনমনেও।
ভেজা চুল শুকানোর এক বিশেষ রীতি ছিল ঠাকুরবাড়িতে। প্রথমে রোদে পিঠ দিয়ে চুল ফাঁক করে করে কিছুটা শুকিয়ে নেওয়া হতো। তারপর ধুনচিতে কাঠকয়লার আগুনে ধুনো দিয়ে তার ওপর দেওয়া হতো জালির ঢাকা। এর ওপর চুল রেখে সারা হতো শুকানোর কাজ। এতে ধুনোর সুগন্ধ হতো। চুল শুকিয়ে গেলে হাতে করে জট ছাড়িয়ে নেওয়া হতো। লক্ষ রাখা হতো যেন চুলে একটুও টান না পড়ে কিংবা চুল ছিঁড়ে না যায়। তারপর সরু চিরুনি দিয়ে ভালো করে আঁচড়ে নেওয়া হতো। এ কাজে দাসীরা সাহায্য করতেন কিংবা মেয়েরা একজন আরেকজনের চুলে লাগাতেন হাত।
পুরুষেরাও করতেন চুলের পরিচর্যা। নানা কথা প্রসঙ্গে ডা. পশুপতি ভট্টাচার্য একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার চুল এমন চকচকে রেশমের মতো থাকে কেমন করে?’ উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘আমি তেলও মাখি না, পারতপক্ষে সাবানও মাখি না। তেল দিলে চুলে জট পাকায়, আর সাবানে সব রুক্ষ হয়ে যায়। আগে শ্যাম্পু করেছি। আমেরিকাতে পেয়েছিলাম একরকম চমৎকার তরল সাবান, তাতে চুল খুব ভালোই থাকত, মসৃণতা বজায় থাকত। কিন্তু সে জিনিস আর পাই না। এখন তাই নিজের শ্যাম্পু নিজেই আবিষ্কার করেছি।’
কী সেই আবিষ্কার- প্রশ্ন করা হলে কবি উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি চুলে মাখি সর্ষে বাটা, আধা বাটা করা সর্ষে আমার জন্য রাখা থাকে। গায়েও তাই মাখি ডালবাটার সঙ্গে মিশিয়ে। ওতে চুল ও চামড়াÑ দুটোই মোলায়েম থাকে।’
তথ্যসূত্র: শান্তা শ্রীমানী, ঠাকুরবাড়ির রূপ-কথা
জাহেরা শিরীন
মডেল: পুষ্পিতা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: কৌশিক ইকবাল