টেকসহি I পার্ল অব জয়
পরিবেশ-সচেতন? রয়েছে ক্ল্যাসিক পার্লপ্রীতিও? থাকছে সুখবর
শৈলী আর সৌন্দর্যের প্রতীক বলা হয় মুক্তাকে। সেই ক্লিওপেট্রার সময়কাল থেকে আজ পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা কমেনি একটুও। আধুনিক জুয়েলারি ট্রেন্ড অনুসারে রত্ন হিসেবে হীরা, জহরতকে পেছনে ফেলে বেশ এগিয়ে আছে মুক্তা। অবশ্য অনেক কারণে। সাবেক ফার্স্ট লেডি প্রয়াত মিসেস জ্যাকি কেনেডি কিংবা প্রিন্সেস ডায়ানার মতো সেলিব্রিটিরা মনে করতেন, মুক্তা সব সময় মানানসই। উপলক্ষ যেমনই হোক, যেকোনো পোশাকের সঙ্গে মানিয়ে তো যায়ই, পাশাপাশি এর আশ্চর্য আধ্যাত্মিক ক্ষমতা চেহারায় ঝলমলে উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। কালে কালে পার্ল ফ্যানের কাতারে শামিল হয়েছেন কোকো শ্যানেল ও রিহানার মতো স্টাইলিশ আইকন। আসলে মুক্তার সৌন্দর্য বা ক্ষমতা নিয়ে কোনো বিতর্ক কোনোকালেই ছিল না, এখনো নেই; বরং নতুন করে এই রত্নের গায়ে লেগেছে পরিবেশবান্ধব তকমা।
পরিবেশ-সচেতন হওয়াটা আজকাল স্টাইলিশ দেখানোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ। একদল জোর গলায় দাবি করছে, দামি রত্নের মধ্যে একমাত্র মুক্তাকেই পরিবেশবান্ধব হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। তাদের দাবির পেছনে চমৎকার সব কারণ রয়েছে; তবে বিপক্ষের যুক্তিও কম নয়। এই পক্ষে-বিপক্ষের যুক্তিতে, মুক্তা সত্যিই পরিবেশবান্ধব রত্ন কি না এবং মুক্তার ডিজাইন টেকসই গয়না হিসেবে যোগ্য কি না, বিতর্ক শুরু হয়েছে এ নিয়ে। মাঝখান থেকে মুক্তা জনপ্রিয়তার কাতারে আরও এক ধাপ ওপরে উঠে গেছে।
মুক্তা কেন পরিবেশবান্ধব- এই প্রশ্নের উত্তরে চাষ করা মুক্তা-ভক্তদের প্রধান দাবি, খামারে নিষ্ঠুরতামুক্ত পরিবেশে ঝিনুকের বংশ বৃদ্ধি করা হয়। তবে পিইটিএ (পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট ফর অ্যানিমেলস) তাতে একদমই একমত নয়। কারণ, মুক্তা সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় চাষিদের অনেকটা অস্ত্রোপচার করেই ঝিনুকের খোলস খোলার কাজ সারতে হয়। তারপর ভেতরে ম্যানুয়ালি পুরে দেওয়া হয় একধরনের উত্তেজক। পিইটিএর ধারণা, এর ফলে ঝিনুকের ওপর চাপ তৈরি হয়। জটিল মনে হচ্ছে? আসলে, ব্যাপারটি ভালোভাবে বোঝার জন্য সবার আগে মুক্তা কীভাবে তৈরি হয়, তা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ। মিঠাপানির মুক্তা চাষ করার সময়, ঝিনুকের ভেতরে উত্তেজনা তৈরির জন্য যা ঢোকানো হয়, তা সংগৃহীত হয় অন্য ঝিনুকের ম্যান্টেল টিস্যু থেকে। লবণাক্ত পানির পার্ল কালচারিংয়ের সময় আরেকটি ঝিনুকের মোলাস্ক টিস্যু ঢোকানো হয়। চাষের এই প্রক্রিয়ার ফলে অর্ধেক ঝিনুক বেঁচে থাকে। একবার মুক্তা তোলা হয়ে গেলে সংগৃহীত ঝিনুকের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ ‘পুনর্ব্যবহার’ করা হয়। এগুলো আবারও একইভাবে পুরো মুক্তা চাষ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যায়। অন্যগুলোকে বাতিল করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এইভাবে মুক্তা চাষের প্রক্রিয়া কতটা নৈতিক।
সেই বিতর্কে যাওয়ার আগে বলে নেওয়া ভালো, সব মুক্তার খামার একইভাবে পরিচালিত হয় না। কেউ কেউ মুক্তা চাষে পরিবেশবান্ধব পন্থা অবলম্বন করেন। তারা আইনি বিধিনিষেধ ও নৈতিকতা সম্পর্কে যত্নশীল। তাদের লক্ষ্যই থাকে উচ্চ মানের মুক্তা উৎপাদন করা, যা পরে টেকসই গয়না বা সাসটেইনেবল জুয়েলারিতে ব্যবহৃত হয়। অনেক মুক্তাচাষিই শুধু বাজারে বিক্রি করা যায় এমন মুক্তা চাষের ব্যবসা করছেন। অতএব দীর্ঘ, ক্লান্তিকর প্রক্রিয়াজুড়ে তারা ঝিনুকের লালন-পালন যত্নসহকারে করেন নিজ নিজ স্বার্থেই। একবার ঝিনুকের খোসার ভেতরে উত্তেজক পদার্থ পুরে দেওয়া হলে, প্রাণীটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য লালার স্তর তৈরি করতে ১২ থেকে ২৪ মাস সময় নেয়। পরিবেশপ্রেমীরা বিশ্বাস করেন, এত দীর্ঘ সময় ঝিনুকদের জন্য খুব অস্বস্তিকর হতে পারে। তবে বিশেষজ্ঞ মুক্তাচাষিরা জোর দিয়ে বলছেন, এটি মোটেই সত্য নয়। ঝিনুকের স্নায়ুতন্ত্র নেই। ফলে তারা ব্যথা অনুভব করে না। বরং মুক্তাচাষিদের বিশ্বাস, লালা স্তরগুলো আসলে নিছক অটো ইমিউন প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিঃসৃত হয়। এটি অনেকটা শরীরে অনুপ্রবেশকারীদের রুখতে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়ার মতো কাজ করে এবং শ্বেত রক্তকণিকাগুলোকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়।
অনেকে আবার প্রশ্ন করেছেন, কালচারড পার্ল কি পরিবেশের জন্য ভালো? বিশেষ ধরনের এ মুক্তা আসে এমন সব ঝিনুক থেকে, যেগুলো ঝুড়িতে বা জালে চাষ করা হয়। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা খুব জরুরি। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে দায়িত্বশীল পরিচ্ছন্নতার অনুশীলনের বিষয়টি যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। তাতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, কীভাবে পরিবেশবান্ধব ঝিনুক পরিষ্কারের বিষয়টি অনুশীলন করা যায়। সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি হলো ঝিনুককে অগভীর পানিতে নিয়ে যাওয়া। এভাবে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক প্রাণী এবং নানা প্রজাতির মাছের সরাসরি সংস্পর্শে আসার সুযোগ মেলে। এগুলো ঝিনুকের গায়ে থাকা পরজীবী খেয়ে ফেলে এবং প্রাকৃতিকভাবে তাদের খোলস পরিষ্কার করে। পুরো প্রক্রিয়াটি এভাবে ঘটলেই এটিকে পরিবেশবান্ধব রত্ন উৎপাদন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে যথার্থ উপায় বলা যেতে পারে। এ ধরনের খামারগুলো প্রকৃতপক্ষে ইকো-সিস্টেমের সঠিক মূল্যায়ন করে। ঝিনুক তাদের চারপাশের পানি থেকে ভারী ধাতু এবং নাইট্রোজেন অপসারণ করার সময় প্রাকৃতিকভাবে ওয়াটার ফিল্টার করে। তাই আবার কেউ কেউ দাবি করেন, মুক্তার খামারগুলো আসলে ‘দূষিত পানির জন্য জৈব-সমাধান’ হিসেবে কাজ করে।
তাহলে কি মুক্তাকে পরিবেশবান্ধব রত্ন বলা যায়?
আসলে, পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে কে কীভাবে ‘টেকসই গয়না’কে সংজ্ঞায়িত করেন, তার ওপর। যদি সত্যিই বিশ্বাস করা হয়, এই ছোট সামুদ্রিক প্রাণীর ভেতর উত্তেজক পদার্থ ঢুকিয়ে দেওয়ার ফলে তারা চাপ অনুভব করে, তাহলে এ-ও বিশ্বাস করতে হবে, সমুদ্রে প্রক্রিয়াটি যখন প্রাকৃতিকভাবে ঘটে, তাদের কিন্তু একই চাপ অনুভূত হয়। তাহলে? যেভাবেই হোক, একটি ব্যাপার কিন্তু নিশ্চিত, হীরার চেয়ে মুক্তা অবশ্যই বেশি পরিবেশবান্ধব। কারণ, কমবেশি সবারই জানা যে হীরার খনি আন্তর্জাতিক মাদক ব্যবসা এবং আফ্রিকায় হীরা যুদ্ধের জন্য দায়ী। আর এতে অবশ্যই পরিবেশবান্ধব কিছু নেই। সেই তুলনায় পার্ল ইন্ডাস্ট্রি অনেক বৈচিত্র্যময়। তবে মনে রাখা চাই, সব মুক্তাচাষি টেকসই ফ্যাশনের নির্দেশিকা অনুসরণ করেন না। একজন পরিবেশ-সচেতন ব্যক্তি হিসেবে, ক্রেতাদের বরং নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে, মুক্তার খুচরা বিক্রেতা কিংবা যে গয়নার ব্র্যান্ডের কাছ থেকে মুক্তা কেনা হচ্ছে, তারা ঝিনুক বা পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে এমন কোনো চর্চা করে কি না? সহজ ভাষায়, মুক্তা ‘গ্রিন জেমস্টোন’ কি না, তা নিশ্চিত করার জন্য জানতে হবে, চাষিরা কীভাবে মুক্তা চাষ করছেন। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় গয়নার দোকানে কথা বলা যেতে পারে। তাদের সংগ্রহে রাখা মুক্তাগুলো কোথা থেকে আসে এবং কীভাবে এর চাষ করা হয়, তা জানতে পারলেই বোঝা যাবে, মুক্তাগুলো কতটুকু পরিবেশবান্ধব।
রত্না রহিমা
ছবি: ইন্টারনেট