ফিচার I ক্যালিগ্রাফিতে মন্ত্র
অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে পোশাকের অলংকরণে। ধর্মীয় অনুভূতি উসকে তো দেবেই, সনাতনী উৎসবের মেজাজের সঙ্গেও মানিয়ে যাবে পুরোপুরি। যারা দেখবেন, মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই
ভারতের ২২টি ভাষার মধ্যে সংস্কৃত একটি। তাই এ থেকে সৃষ্ট ক্যালিগ্রাফি যে মূলত ভারতীয় ধারার, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্যালিগ্রাফি হচ্ছে লেখার একটি কৌশল। শব্দটি ইংরেজি, যা দুটি গ্রিক শব্দের সমন্বয়ে গঠিত- কালোস ও গ্রাফিয়েন। এই দুই মিলে অর্থ দাঁড়ায় ‘সুন্দর লেখা’। শিল্প বললেও ভুল হবে না। হাতে লেখার মাধ্যমে চমৎকার সব প্রতীক রচনা করা হয় এবং সেগুলো নিখুঁতভাবে প্রকাশ পায় ক্যালিগ্রাফিতে। শব্দ, হরফের অবস্থান, লেখার দক্ষতা ও কৌশল- এসবের সমন্বয়ে সম্পন্ন হয় পুরো প্রক্রিয়া।
পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ক্যালিগ্রাফি জায়গা করে নেয় বাইবেল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে অনুলিপি করতে গিয়ে। একইভাবে ভারতের সংস্কৃত সাহিত্য থেকে অন্যান্য সাহিত্যে ক্যালিগ্রাফির উত্থান ঘটে।
লেখক দিব্যজ্যোতি মজুমদার ‘টাইপ ও মোটিফ ইনডেক্স’ শিরোনামের বইয়ে লিখেছেন, লোককথা আর লোকশিল্পের মাধ্যমে কোনো একটি দেশের জনগোষ্ঠীর জীবন এবং সমাজভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। টাইপ ও মোটিফ পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী সমাজের মধ্যে মানসিক ও মানবিক সেতুবন্ধনের স্বরূপ উপলব্ধিতে সহায়তা করে। ক্যালিগ্রাফিতে সংস্কৃত ভাষার মন্ত্রে সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীদের সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটেছে। ভারতীয় উপমহাদেশের জনপদের বিশ্বাস, ধ্যান ও ভাবনা খুঁজে পাওয়া যায় এতে।
পোশাকশিল্পের মোটিফে জীবনযাপনের সুস্পষ্ট প্রভাব চোখে পড়ে। বাংলাদেশে মন্ত্রের ক্যালিগ্রাফি এবং তা থেকে উৎসাহিত মোটিফ নিয়ে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনার। তাদের মধ্যে রয়েছেন রঙ বাংলাদেশের স্বত্বাধিকারী সৌমিক সাহা, ডিজাইনার শুভাগত শুভ এবং ভারতীয় ডিজাইনার সঙ্গীতা গুপ্তা। সৌমিক সাহার কাছ থেকে জানা যায়, আমাদের দেশে মন্ত্রের ক্যালিগ্রাফি নিয়ে মূলত দুভাবে কাজ হয়। একটি হচ্ছে সরাসরি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত মন্ত্র কাপড়ে তুলে ধরা। অপরটি বিভিন্ন সংস্কৃত শব্দের প্রতীক; যেমন ওম, স্বস্তিকা দিয়েও অলংকরণ সম্পন্ন করা। তিনি বলেন, ‘পূজা উপলক্ষে পোশাকে সংস্কৃত ভাষায় মন্ত্র নিয়ে নিয়মিত কাজ করি। মন্ত্রের ক্যালিগ্রাফিক ফর্ম পোশাকে ফুটিয়ে একটি পুরো কালেকশন আমরা একবার তৈরি করেছি। এ ছাড়া রঙ বাংলাদেশের শারদীয় কালেকশনে পূজাসংশ্লিষ্ট মোটিফের সঙ্গে দেবী নাম, মন্ত্র ইত্যাদির ব্যবহার করছি।’
তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার শুভাগত শুভর কাজেও দেখা যায় সংস্কৃত শব্দের ছোঁয়া। তিনি দেবী দুর্গার নামের ক্যালিগ্রাফি ফুটিয়ে তুলেছেন শাড়িতে। কাজের মাধ্যম সম্পর্কে এই তরুণ তুর্কি বলেন, ‘আমি প্রথমে আর্টওয়ার্ক করে তারপরে সেটিকে ডিজিটাল ফর্মে কনভার্টের মাধ্যমে কাজ সম্পন্ন করে থাকি।’
বাংলাদেশের ফ্যাশন বাজার পর্যবেক্ষণ করে, পোশাকে মন্ত্রের ক্যালিগ্রাফির প্রকাশে ‘ওম’-এর ব্যবহার দেখা যায় সবচেয়ে বেশি। এর পাশাপাশি ত্রিনয়ন, মায়া, জায়া, শান্তি, দেবী, লক্ষ্মী, শক্তি, শ্রদ্ধা শব্দগুলোও চোখে পড়ে হরহামেশা। শুধু ধর্মীয় অনুভূতির কারণে এই মোটিফগুলো ফ্যাশনে জায়গা করে নিয়েছে, তা নয়। এসব শব্দের দর্শন মানুষের জীবনে মিশে গেছে পছন্দের শব্দ হিসেবে।
ভারতীয় পোশাক নকশাকার সঙ্গীতা গুপ্তা বিভিন্ন নকশায় ব্যবহার করেন ওম। ঢাকাস্থ ইন্ডিয়া হাউসে একটি প্রদর্শনীর মাধ্যমে হস্ত তাঁতে তৈরি খাদি কাপড়ে ইন্ডিগো ব্যবহারে বিভিন্ন কাজ প্রদর্শন করেন তিনি। প্রদর্শনীর বেশ কিছু কাজে মোটিফ হিসেবে ‘ওম’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। এ বিষয়ে তিনি বললেন, ‘আমি সরাসরি তুলি ব্যবহার করে কাপড়ে ওম লিখে থাকি। ইন্ডিগো নিয়ে আলাদা একটি কালেকশন রয়েছে। সেখানেও “ওম” লিখে নকশা করেছি। কোনো মোল্ড ব্যবহার না করে সরাসরি তুলিতে সম্পন্ন হয়েছে সেই নকশা।’
মন্ত্র এবং সংস্কৃত শব্দের ক্যালিগ্রাফি পোশাকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম সংযোজন চোখে পড়ে। রংতুলি, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট, ডিজিটাল প্রিন্টের মূল নকশায় এমব্র্রয়ডারি, জারদৌসি, স্টোন ওয়ার্কের কাজ দেখা যায়। রঙের ক্ষেত্রে লাল, কালো ও ম্যাট গোল্ডেনের ব্যবহারই বেশি।
এবারের পূজা উপলক্ষে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোতে মিলবে ক্যালিগ্রাফি কালেকশন। মন্ত্রের এমন মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনে ক্রেতা আকর্ষিত হবে বলে আশা করছেন ডিজাইনাররাও।
সারাহ্ দীনা
মডেল: বুশরা ও সজিব
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: বিশ্বরঙ
ছবি: কৌশিক ইকবাল