ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I দ্য ওয়্যারেবল আর্ট
‘এপিটম অব কমপ্লেক্স’খ্যাত ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অপরিহার্য এই হাই-এন্ড সেক্টরে লেগেছে বদলের বাতাস। দশক ধরে প্রচলিত বিধি আর কঠোর মানদ- ছাপিয়ে প্রাধান্য পাচ্ছে পরিধানযোগ্যতা। রানওয়ে রিপোর্টগুলোতে তারই পষ্টতা। জাহেরা শিরীনের বিশ্লেষণে
তাই বলে আন্ডারস্টেটেড এই কালেকশনগুলোর আপাত-সরলরূপে বোকা বনে যাওয়ার কিন্তু সুযোগ নেই। যদি মনে করা হয়, ওত কতুর মানেই শুধু চমৎকার সুন্দর সব পোশাক, ব্যাপারটা মোটেই তেমন নয়। বিহাইন্ড দ্য সিন আরও বিশদ।
প্রসঙ্গ প্যারিস
যোগসূত্র ওত কতুরের সূচনা থেকেই। ‘আ ফ্রেঞ্চ অ্যাকসেপশন’ বলা হয় হাই-এন্ড এই ফ্যাশনকে। উৎপত্তি তো বটেই, প্রথম কতুর হাউসও স্থাপিত হয় প্যারিসে, ১৮৫৮ সালে। চার্লস ফ্রেডরিক ওয়াথ তৈরি করেছিলেন এটি। ফাদার অব ওত কতুর বলা হয় তাকে।
হাই-এন্ড এই সেক্টরের জন্য সৃষ্ট প্রতিটি পোশাক যেন ফ্রেঞ্চ সফিস্টিকেশনের উপাখ্যান। কিছুটা অধরা, দুর্লভ আর গড়পড়তা মানের ঊর্ধ্বে। কিন্তু এ বছর পাল্টে গেছে সেই চিরাচরিত চেনা পরিচিত রূপ। ‘বিক্রির জন্য নহে’ বোর্ড হটিয়ে ব্র্যান্ডগুলো তাদের কতুর ওয়্যারকে করে তুলেছে আরও বেশি পরিধানযোগ্য। প্যারিসের রানওয়ে ছিল ওয়্যারেবল কতুরের দখলে। কোয়াইট লাক্সারি ট্রেন্ডকে দারুণ টক্কর দিয়েছে আন্ডারস্টেটেড প্রতিটি পোশাক। ৩ থেকে ৬ জুলাই- চার দিনে ৩২টি কতুর শোর আয়োজন করা হয় এবারকার প্যারিস ফ্যাশন উইকে। শ্যানেল আর ডিওরের মতো ওত কতুর মেম্বার যাদের প্যারিসে নিজস্ব অ্যাটেলিয়ে আছে, তাদের পাশাপাশি এতে অংশ নেয় জর্জিও আরমানি, ভ্যালেন্তিনো আর ফেন্দির মতো প্যারিসের বাইরের করেসপন্ডিং মেম্বাররাও। ছিল নবাগত সৌদি বেসড ফ্যাশন লেবেল আশি এবং আমেরিকান ডিজাইনার থম ব্রাউনি। এবারের কতুর উইকে প্রথমবারের মতো দেখা যায় সিএফডিএ (কাউন্সিল অব ফ্যাশন ডিজাইনারস অব আমেরিকা) চেয়ারম্যান চার্লস দ্য ভিলমরিনকে। নিজস্ব লেবেলের বিশ বছর পূর্তি উদ্্যাপনে। কতুরের ক্লায়েন্টের যে কমতি নেই, তা আবার প্রমাণিত এই শোতে। তবে পার্সোনালাইজেশনের চাহিদা বেড়েছে, তা অকপটে স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মত, ‘কতুর ইজ দ্য আলটিমেট পার্সোনালাইজেশন’।
বার্নস্টেইনের সিনিয়র লাক্সারি গুডস অ্যানালিস্ট লুকা সোলকার বক্তব্য অনুসারে কতুর মার্কেটের সামগ্রিক অবস্থা দারুণ। বিশেষ করে বাঘা ব্র্যান্ডগুলোর। এর পেছনে মূল কারণ হাই-এন্ড ক্রেতাদের বিশ্বস্ততা। এবারকার প্যারিস ফ্যাশন উইকে ডিওরের কতুর শোতে তাদের ওমেনস কালেকশনের আর্টিস্টিক ডিরেক্টর মারিয়া গ্রাজিয়ার নকশায় অনুপ্রেরণা ছিল পুরাকালের সব শিলুয়েট। টিউনিক, পেপলাম, কেপ আর স্টোলের আধুনিকায়ন চোখে পড়েছে কালেকশনজুড়ে। সঙ্গে সরলতার সুস্পষ্ট প্রভাব। তৈরিতে ব্যবহৃত হয়েছিল স্ট্রেচ ফ্যাব্রিক, যা কতুরের প্রথাবিরুদ্ধই বলা যায়। শ্যানেলের এবারের কতুর শোর মূল উদ্দেশ্য ছিল সফিস্টিকেশন আর সিম্পলিসিটির প্রদর্শন। হাউসটির আর্টিস্টিক ডিরেক্টরের ভাষ্যমতে পার্সিয়ান নারীদের প্রতিচ্ছবি রানওয়েতে প্রদর্শনের প্রচেষ্টা ছিল তাদের। নির্বিকার কিন্তু সুরুচিপূর্ণ। শো ওপেনিংয়ে প্রদর্শিত হয় ম্যাসকুলিন ওভারকোট। কোনো মডেলকে দেখা গেছে কুকুর সঙ্গে নিয়ে মঞ্চে হেঁটে বেড়াতে, তো কারও হাতে ছিল ফলের ঝুড়ি।
ব্যালেন্সিয়াগার শোতেও বদলের প্রভাব ছিল পরিষ্কার। স্ট্রাকচারড শিলুয়েটের ক্যাজুয়াল ওয়্যার, তা-ও আবার ডেনিম জিনস, কতুর রানওয়েতে এর আগে কিন্তু খুব একটা দেখা যায়নি। ব্র্র্যান্ডের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর ডেমনা তার তৃতীয় এই শোতে আরও প্রদর্শন করেন স্ট্রাকচারড লেস ড্রেস আর হাজারো ক্রিস্টালে জড়ানো প্যাটার্নবিহীন ড্রেস। মেনজওয়্যার কালেকশনে নজর কেড়েছিল ট্রম্প লয়েল শিলুয়েট। ‘লেস ইভনিং, মোর ক্যাজুয়াল’ লুকের জন্য। তবে দেখতে সাধারণ জিনসগুলোও তৈরি হয়েছিল জটিল সব প্রক্রিয়ায়। দুই থেকে আড়াই মাস সময় নিয়ে। ওত কতুরের কামালই বলা চলে। জঁ পল গঁতিয়ে দারুণ চমক দেখিয়েছিল এবার কতুর শোতে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে বেজেছে শহুরে সব শব্দ। মূলত শহরজুড়ে হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্যপট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মঞ্চে। তবে যেনতেন রাস্তা নয়, ফ্যান্টাসি স্ট্রিট ধরে। কতুর বলে কথা! হাই লেভেল সফেস্টিকেশন না থাকলে কি চলে?
এবারের প্যারিস ফ্যাশন উইকের কতুর শোগুলোতে অতিথি ছিলেন প্রায় সাড়ে চার শ জন, যাদের এক-তৃতীয়াংশ খরিদ্দার। নীতি অনুসারে এক্সক্লুসিভিটি বজায় রাখতে একটি প্রদেশে একটি কতুর পিস বিক্রির নিয়ম। কিন্তু এবারের আসরে চাহিদা বাড়ায় তা বজায় রাখতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে ব্র্যান্ডগুলোকে। ক্রেতা চাহিদার পাশাপাশি ডিজাইনাররাও চেয়েছেন ক্লজেটে বন্দী থাকার বদলে ক্লায়েন্ট আর তারকাদের গায়ে উঠুক তাদের পোশাক। হয়ে উঠুক আরও বেশি পরিধানযোগ্য।
কতুরকথা
দ্য শম্বর সিন্ডিকেট দ্য লা কতুর নির্ধারণ করে থাকে পোশাকের কতুর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। এ ছাড়া অফিশিয়াল ক্যালেন্ডারের জন্য কারা নির্বাচিত হচ্ছে, এমনকি অতিথিদের তালিকাও। ১৯১১ সালে চার্লস ফ্রেডরিক ওয়াথ যে নীতিমালা তৈরি করেছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে আজও মেনে চলে কমিশন। নৈপুণ্যের ঐতিহ্য অটুট রাখতে। গাইডলাইন অনুসারে শুধু বেসপোক পোশাক তৈরি করা হয় প্রাইভেট ক্লায়েন্টদের জন্য। অন্তত বিশজন কারিগর থাকা চাই ওয়ার্কশপে। কালেকশনে থাকতে হবে অন্তত পঞ্চাশ ধরনের অরিজিনাল ডিজাইন, ডে এবং ইভনিং লুকের জন্য। যা প্রদর্শিত হয় জানুয়ারি ও জুলাইতে। পুরোদস্তুর হাতে তৈরি এসব পোশাক বানানোর কাজে নিয়োজিত থাকেন ইন্ডাস্ট্রির প্রথম সারির সুদক্ষ কারিগরেরা। ওয়ান-অব-আ-কাইন্ড বলে অনেক বেশি তৈরি হয় না, বরং একটি পিসকেই দেওয়া হয় শিল্পের মর্যাদা; যা ক্লায়েন্টদের কাছে অনেকটা বিনিয়োগের মতোই। আজীবনের জন্য। টিকটক কিংবা ইনস্টা ফিডে দেখে আবেগে কিনে ফেলা নয়! কারণ, ওয়্যারেবল এসব আর্ট বিকোয় বিলিয়ন ডলারে। পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৪০০০ হাই প্রোফাইল ক্লায়েন্টের ভাগ্যে জোটে এগুলো। বিয়ে, জন্মদিন থেকে ফেস্টিভ্যাল দ্য কান আর মেটগালার মতো জাঁকালো ইভেন্টে চোখে পড়ে ওত কতুর পিসগুলো।
ছবি: ইন্টারনেট