ফিচার I ষোলোকলা পূর্ণ!
কনেসাজের এই প্রথা সাবেকিয়ানা প্রসূত। দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তাই প্রয়োজন ধৈর্যের। তবে আধুনিকায়নের ছোঁয়ায় নবলব্ধ কৌশল এখন অনেকটাই সংক্ষেপ। কনে কনে ভাবের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ না করেই
‘সোলাহ শৃঙ্গার’ খুব পরিচিত শব্দ। শুনলেই বিয়ের কথা মনে পড়ে। বোঝাই যাচ্ছে শব্দটি হিন্দি। এখানে শৃঙ্গার মানে অঙ্গসজ্জা আর সোলাহ মানে ষোলো। সহজ হিসাব, ষোলো রকম উপায়ে অঙ্গসজ্জার সব কৌশল। তবে ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি অনুসারে দেখা বা ধরা হলে হিসাবটি অত সহজ নয়। এর অর্থ অনেক নিবিড়, যার সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সাংস্কৃতিক আচার ও আবেগের। ভারতীয় নারীরা বিয়ের সময় মাথা থেকে পা পর্যন্ত তাদের সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ষোলো ধাপের আচার অনুসরণ করেন। যেকোনো ভারতীয় কনের জন্য এটি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ। কারণ, এই ষোলোটি সাজসজ্জার আচারই আসলে তাকে বিবাহিত হওয়ার অপার আনন্দে উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে। এর মাহাত্ম্য এতটাই যে এই অনুষ্ঠান চলাকালীন, বিয়ের আগে, নববধূকে দেবী লক্ষ্মীর দেবত্বের সঙ্গে সমানভাবে তুলনা করা হয়। লক্ষ্মী হলেন সনাতন ধর্মে সমৃদ্ধি, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী। প্রকৃতপক্ষে, পুরাণমতে এই আচার আসলে নারীর সৌন্দর্যের উদ্যাপন এবং একরকম বন্দনা।
বিবাহ ছাড়াও সোলাহ শৃঙ্গারের আচারটি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবে উদ্যাপিত হয়। মধ্যযুগের রানিরা তো একসময় যখনই প্রকাশ্যে উপস্থিত হতেন, তখনই সোলাহ শৃঙ্গার করতেন। তবে কালের পরিবর্তনে এরও বিবর্তন ঘটেছে। এটি তার পৌরাণিক সম্পর্ক, মর্যাদা—দুটোই হারিয়েছে বলা চলে। বর্তমানে পুরো আচারটির একটি সহজ রূপান্তর ঘটেছে। যেটি গিয়ে ঠেকেছে বিউটি পারলার আর স্যালনগুলোর দোরগোড়ায়। যেখানে প্রশিক্ষিত বিউটিশিয়ানরা এর মাধ্যমে নববধূকে নতুন সাজসজ্জার মোড়কে উপস্থাপন করেন বিয়ের মণ্ডপে। তাই আজকের দিনে নববধূদের জন্য সম্পূর্ণ ষোলোটি সাজসজ্জার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সোলাহ শৃঙ্গারের নিত্যনতুন কাস্টমাইজড পন্থা বরং আধুনিক নববধূদের মধ্যে জনপ্রিয়। যেটি সময়সাপেক্ষ নয়; জটিলতাবিহীন ও সাধারণ। মোটেই আগের সেই কঠিন নিয়মে বন্দী নয়।
ঐতিহ্যগতভাবে, সোলাহ শৃঙ্গারের জটিল প্রক্রিয়া শুরু হয় কনের চুলে তেল দেওয়া এবং ধোয়ার মধ্য দিয়ে। চুল শুকিয়ে গেলে একটি ঐতিহ্যগত হেয়ারস্টাইলে বেঁধে দেওয়া হয়। সেটি হতে পারে একটি খোঁপা বা লম্বা বিনুনি; যা পরে ফুল ও চুলের আনুষঙ্গিক গয়না দিয়ে চমৎকারভাবে অলংকৃত করা হয়। এরপর হলুদ, চন্দনগুঁড়া, বেসন ও তেলের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি উপটান মেখে উজ্জ্বল করা হয় কনের গায়ের রং, যা স্ক্রাব হিসেবে পুরো শরীরে ঘষে ঘষে প্রয়োগ করা হয়। তারপর আসে আনুষ্ঠানিকভাবে স্নানের পালা। স্নানের পরই একজন কনে আসলে তৈরি হয় সোলাহ শৃঙ্গারে অলংকৃত হবার জন্য।
জেনে নেওয়া যায় এর ষোলোটি পর্যায় বা প্রক্রিয়াগুলো আসলে কী—
বিন্দি বা টিপ
বিয়ের কনের বিন্দি পরা বাধ্যতামূলক। নববধূ তার দুই ভ্রুর মাঝখানে একটি বড় বিন্দি এবং ছোট লাল ও সাদা বিন্দি পরেন, যা তার ভ্রুর ওপরের প্রান্তগুলোকে সাজানোর জন্য বিকল্প রঙে প্রয়োগ করা হয়। বিন্দি বা টিপ হিন্দু নারীর বিবাহিত জীবনের প্রতীক এবং এর ধর্মীয় প্রভাবও রয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে, একসময় এটি সিঁদুরের পাউডারের সাহায্যে প্রয়োগ করা হতো। এখন সেটি বাধ্যতামূলক নয়; টিপ স্টিকার এবং মণি-কাটা বিন্দিগুলো বরং ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় কনেসাজে।
সিন্দুর বা সিঁদুর
সিঁদুর একটি লাল রঙের পাউডার, যা বরের হাত দিয়ে হিন্দু কনের চুলের বিভাজন বা সিঁথিতে প্রয়োগ করা হয়। এই আচারের একটি পবিত্র তাৎপর্য রয়েছে। হিন্দু বিবাহিত নারীমাত্রই সিঁথিতে সিঁদুর থাকবে—ব্যাপারটি ধর্মীয়ভাবে আবশ্যক। অনেকটা পশ্চিমা দেশগুলোতে ওয়েডিং রিংয়ের মতো। তা ছাড়া লাল রং বিবাহ এবং স্বামীর মঙ্গল বোঝায়।
মাং টিকা বা টিকলি
মাং টিকা একরকম চুলের অনুষঙ্গ, যা নববধূর কপালে শোভা পায়। অনেকটা আমাদের টিকলির মতো। এটি মূলত সোনা ও মূল্যবান রত্ন দিয়ে তৈরি করা হয়। মাং টিকা সাধারণত মাথার মাঝ বরাবর সিঁথি করা অংশে পরিধান করা হয় এবং কপাল পর্যন্ত প্রসারিত। এই অলংকারে কনের সৌন্দর্য বাড়ার কারণ, এটি তার মুখকে অনেক উজ্জ্বল করে বলে মনে করা হয়।
অঞ্জনা বা কাজলচোখ
চোখে কাজল পরার রীতিটিকে অঞ্জনা বলে। মূলত চোখের পাতার কিনারায় কাজল পরে চোখকে আকর্ষণীয় করে তোলাই এ ধাপের কাজ। একসময় কনের জন্য পরিষ্কার মাখন অথবা ঘি দিয়ে বাতি জ্বালিয়ে মাটির প্রদীপের কালি সংগ্রহ করে কাজল প্রস্তুত করার নিয়ম ছিল। এখন কাজল তৈরির সে নিয়ম হারিয়ে গেছে। আধুনিক ভারতীয় নববধূরা কাজল চোখের লুক অর্জন করার জন্য এখন শক্তিশালী কালো আইলাইনার ব্যবহার করেন।
নাথ বা নাকের অলংকার
নববধূ তার বাম নাসারন্ধ্রে একটি নাকের আংটি পরেন, যার নাম নাথ বা নথ। এটি সাধারণ গয়না নয়; কারণ, একে ধরা হয় তার বৈবাহিক জীবনের প্রতীক। আবার বলা হয়, এই অলংকারই কনেকে ঐতিহ্যবাহী জাতিগত ভারতীয় চেহারা এনে দিতে সাহায্য করে। অলংকৃত নথ, যা রত্ন বা মুক্তার গুচ্ছে তৈরি, তা একটি সোনার চেইন দিয়ে কানের পেছনে বেঁধে দেওয়া হয়।
হার
হার বা নেকলেস হলো আরেকটি অলংকরণ, যাকে ধরা হয় সমৃদ্ধির প্রতীক। সাধারণত, আধুনিক ভারতীয় কনে ঐতিহ্যবাহী কুন্দন বা পোলকা কাজের সঙ্গে একটি একক চটকদার নেকলেস পরতে পছন্দ করেন। সেটি সোনা, হীরা, মণি-মুক্তা—যেকোনো কিছু দিয়ে তৈরি হতে পারে। তা ছাড়া রয়েছে মঙ্গলসূত্র। স্বামীর কাছ থেকে পাওয়া একরকম স্যুভেনির এটি। অন্তত হিন্দু স্ত্রীরা এমনটাই মনে করেন। সহজ করে বললে, সোনা ও কালো পুঁতি দিয়ে তৈরি নেকলেসই এই মঙ্গলসূত্র।
কর্ণ ফুল বা কানের অলংকার
কানের দুলকেই বলা হয় কর্ণ ফুল। এই কানের দুল হলো ব্রাইডের মেকওভারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি হার বা নেকলেসের পরিপূরক হিসেবে পরিধান করা হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় কর্ণ ফুল হলো ঝুমকা। তা ছাড়া রয়েছে কুন্দন, মীনাকারি, হীরাখচিত ভারী ডিজাইনের কানের দুল, যা বেশির ভাগই তৈরি হয় সোনা এবং ক্ষেত্রবিশেষে রুপা দিয়ে।
মেহেন্দি
মেহেন্দি বা মেহেদি হলো ভারতীয় সংস্কৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আচার। সেটা বিয়ে, উৎসব বা যেকোনো অনুষ্ঠানই হোক না কেন। হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলমানরাও এটি অনুসরণ করেন। মেহেন্দি বা হেনা সেলিব্রেশনের কথা বলে, বর-কনের মধ্যে ভালোবাসার রেখা দীর্ঘায়িত করে। নানা রকম জটিল ডিজাইনে হাত ও পায়ে প্রয়োগ করা হয় মেহেদি। এটি এমন একটি উপাদান, যা নববধূকে অন্যদের চেয়ে আলাদা দেখাতেও সাহায্য করে। আজকাল অবশ্য নববধূর সঙ্গে তার সখীরাও বিয়েতে মেহেদিতে হাত রাঙান। তবে হিন্দুধর্মে মেহেদির লাল বা প্রায় ক্রিমসন মেরুন রংকে কনের জন্য শুভ মনে করা হয়। কারণ, এটি দম্পতিদের মধ্যে প্রেমের ইঙ্গিত দেয়।
চুড়িয়া বা চুড়ি
কনের জন্য স্বর্ণ ও কাচের চুড়ি উভয়ই পরা বাধ্যতামূলক। কারণ, এটি তার বরের দীর্ঘ জীবন ও সমৃদ্ধি নির্দেশ করে। বিবাহের এই দৃশ্যমান চিহ্নটি সাধারণত লাল বা সবুজ রঙের পরা হয়। তৈরি করা হয় লোহা, সিরামিক, সোনা, কাচ অথবা ধাতু দিয়ে। বিবাহিত নারী মানেই দুগাছা হলেও হাতে চুড়ি থাকা চাই। এ নিয়ম আগেও পালন করা হতো, এখনো ব্যত্যয় ঘটেনি।
বাজুবন্ধ বা আর্মলেট
বাজুবন্ধ যা আর্মলেট নামেও পরিচিত। এই অলংকার নববধূরা বাহুর ওপরের অংশে পরিধান করেন। রাজস্থানী এবং দক্ষিণ ভারতীয় নববধূদের বিশেষ করে পরতে দেখা যায়। বাজুবন্ধ সোনা বা রুপায় তৈরি হয়। যেটি অলংকৃত করা হয় নানা রকম রত্ন বা মুক্তা দিয়ে। সোলাহ শৃঙ্গার পরিপূর্ণ করার জন্য বাহুতে বাজুবন্ধ থাকা জরুরি।
আরশি ও হাতফুল
হাতফুল হলো আটটি আংটি (দুটি অঙ্গুষ্ঠ ব্যতীত) যা নববধূ তার দুই হাতে পরে। এগুলো হাতের ওপরের অংশে একটি কেন্দ্রীয় ফুলের অলংকরণের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। আঙুলে আটটি আংটি পরা ছাড়াও নববধূ আরশিও পরেন, যাকে বলা যায় থাম্ব রিং। আরশির ভেতর সাধারণত একটি আয়না সেট করা থাকে, যা কনেকে বরের এক ঝলক পেতে সাহায্য করে। আগে এর পেছনে খুব তাৎপর্যপূর্ণ কারণ ছিল। পর্দার কারণে কনে তার স্বামীকে দেখার সুযোগ পেতেন না। এই আরশি নামক অলংকার তাকে সেই সুযোগ করে দিত।
কেশপাশরচন বা চুলের অনুষঙ্গ
চুল সাজানোর কৌশল সাধারণত বিনুনি বা খোঁপায় চুল বাঁধার পরে কনেরা সোনার অলংকার এবং ফুল দিয়ে চুল অলংকৃত করে নেন। এর নামই কেশপাশরচন। ফুল হিসেবে সাধারণত জুঁই সনাতনভাবে ব্যবহার করা হয়। কারণ, এর দীর্ঘস্থায়ী সুবাস চুল ও কনেকে সুবাসিত করে তোলে।
কামারবন্দ বা কোমরের অনুষঙ্গ
কামারবন্দ হলো কোমরবন্ধ। যা একজন নারীর কোমরের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। এই অলংকার সোনার তৈরি এবং রত্ন দিয়ে অলংকৃত থাকে। এটি অনেকটা বেল্টের মতো, যা পোশাক বা শাড়িকে যথাস্থানে রাখতেও সহায়তা করে।
পায়েল ও বিছুয়া
পায়েল, আ্যাঙ্কলেট নামেও পরিচিত, যা অনেকটা নূপুরের মতো। মূলত রুপা বা সোনার নকশাদার চেইন যার সঙ্গে মুক্তা, পুঁতির ঝালর সংযুক্ত থাকে। যখন নববধূ এটি পরে পায়ে পায়ে হেঁটে বেড়ান, তা দেবী লক্ষ্মীর প্রবেশকে নির্দেশ করে বলে মনে করা হয়। আর বিছুয়া হচ্ছে পায়ের আঙুলের আংটি, যা রুপা বা সোনায় তৈরি। এগুলো সাধারণত পায়ের দ্বিতীয় আঙুলে পরা হয় এবং বিবাহিত জীবনের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে ধরা হয়। ভারতের অনেক অঞ্চলে, এটি কেবল ফ্যাশন অনুষঙ্গ হিসেবেও পরা হয়।
ইতর বা সুগন্ধি
ইতর বা ঘ্রাণ বা সুগন্ধি হলো সোলাহ শৃঙ্গারের অন্যতম উপাদান। কনের জন্য যা মাখা অত্যন্ত জরুরি। হিন্দু বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা দীর্ঘ সময় ধরে চলে। তাই ইতরের সুগন্ধই বিয়ের অনুষ্ঠানের দীর্ঘ সময় ধরে কনেকে সুগন্ধযুক্ত রাখে। বাংলায় ইতরকে আতর বলা হয়।
শাদি বা বিয়ের পোশাক
গয়নাগাটি পরা, সাজগোজ—সব শেষ; এবার বিয়ের বিশেষ পোশাক। সেখানেও নানা রকম নিয়ম আছে। ট্র্যাডিশনাল ব্রাইডাল ড্রেস হয় লাল, সবুজ, মেরুন ও সোনালি। তা সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি বা লেহেঙ্গা যা-ই হোক না কেন। পোশাকগুলো নানা কাজে অলংকৃত করে তৈরি করা হয়। বিয়ের দিনে কনেকে আরও বিশেষ দেখানোর জন্য।
সোলাহ শৃঙ্গার পর্ব শেষ। তবে বর্তমানের দিনের দৃশ্যকল্প একদমই ভিন্ন। কারণ, খোদ ভারতেই এই সোলাহ শৃঙ্গার আচার তার আগের রূপ থেকে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। পুরো ষোলোটি না থাকলেও কিছু দিক অবশ্য এখনো রয়েছে চর্চায়। তবে বাদ পড়েছে কোমরবন্ধ, বিছুয়া, আরশি, হাতফুল ইত্যাদি সব সেকেলে গয়না। হীরার গয়নার তুলনায় জনপ্রিয়তায় এগিয়ে গেছে চাঙ্কি আর ঐতিহ্যবাহী সোনার অলংকার।
রত্না রহিমা
মডেল: তুবা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: অদ্রিয়ানা
জুয়েলারি: গ্লুট টুগেদার ও ধৃতি
ছবি: কৌশিক ইকবাল