ফরহিম I গ্রুম সারভাইভাল গাইড
আপাদমস্তক সুন্দর দেখানোর সহজ সব নির্দেশিকা। সঙ্গে মনযতনের ফুলপ্রুফ ফর্মুলা। এমন বিশেষ সময় জীবনে তো আর প্রতিদিন আসে না
আচ্ছা, তাহলে বিয়ে করতে যাচ্ছেন? বিবাহের বিখ্যাত দিল্লি কা লাড্ডু খাওয়ার মতো সাহস সঞ্চয় হয়ে গেছে? তবে আর ভয় কিসের? তারপরেও নার্ভাস লাগছে? লাগবেই। নতুন যেকোনো কিছুতে একটু ভয় লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। কোনো সমস্যা নেই, সহজ সমাধান আছে। বিয়ের দিন কেউ যেন চোখ ফেরাতে না পারে, সে ব্যবস্থা করে ফেলব! নিজেকে নিজের কাছে কুল, হট হ্যান্ডসাম হাঙ্ক মনে হলে কনফিডেন্স চলে আসবে আপনাতেই। তাহলে শুরু করা যাক।
সবার আগে জানতে হবে নিজস্ব সৌন্দর্য ভাবনা। এ ব্যাপারে নেতিবাচক হওয়ার শঙ্কাই বেশি। কারণ, বেশির ভাগ ছেলেই এ নিয়ে সচেতন থাকেন না। কিন্তু বিয়ে বলে কথা! একটা বিশেষ দিন। আজকাল সচেতন-অসচেতন—সব বরই বিয়ের কনের মতো সেই এক দিনের জন্য হলেও ব্যাপক প্রস্তুতি নেন। খুঁটিনাটি বিষয়ের প্রতি নজর দেন, বিয়েতে তাদের যেন প্রেজেন্টেবল দেখায়, তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। তাই বিয়ের কয়েক মাস বাকি থাকুক বা কয়েক দিন—প্রস্তুতি সেরে নেওয়া চাই আগেভাগে।
ঝকঝকে দাঁত
মুক্তোঝরা না হোক, বিয়ের দিন হাসিটা অন্তত মনোমুগ্ধকর দেখাক। তবে দাঁত ঠিক আছে তো? রং, পজিশন—সবকিছু? যদি সব ঠিক থাকে, তাহলে দাঁতের হলদেটে ভাব কাটানোর জন্য প্রথমেই কিছুটা বিনিয়োগ করতে হবে। মেডিসিন শপে টিথ হোয়াইটেনিং কিট পাওয়া যায়। কিনে নেওয়া যেতে পারে; অথবা সাদা করার টুথপেস্টেও চলবে। তবে বাড়িতে বসে দাঁত সাদা করার জন্য কিট সবচেয়ে জনপ্রিয় বিকল্প। পদ্ধতিটি সম্পন্ন করতে ৫ থেকে ২১ দিন পর্যন্ত সময় লাগবে। তারপরই ফলাফল মিলবে। কমপক্ষে এক সপ্তাহ সময় হাতে থাকলে এগুলো বাজেটবান্ধব বিকল্প। তবে পেশাদার চিকিৎসার জন্য একবার হলেও দাঁতের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ, অনেক পেশাদার দন্তচিকিৎসক এককালীন চিকিৎসার অফার করেন, যা এই কিটগুলোর চেয়ে বেশি ও দ্রুত কার্যকর। তাই সময় যদি কম থাকে অথবা দাঁতে থাকে এমন কোনো শক্ত দাগ, যা মেটাতে হোম কিটগুলো দিয়ে সারানো যাবে না, সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই ভালো। অনেক ডেন্টিস্ট কাস্টম হোয়াইটেনিং কিটও অফার করে থাকেন, বাড়িতে বসে যা ব্যবহার উপযোগী। তাতে খরচ যে খুব বেড়ে যাবে এমন নয়; বরং এটি ওষুধের দোকানের কিটের চেয়ে ভালো এবং দ্রুত ফল মিলবে। আর বিয়ের জন্য যদি হাতে প্রচুর সময় থাকে, তবে সাদা করার টুথপেস্ট বা মাউথওয়াশ ব্যবহার শুরু করতে পারেন।
ওয়াক্সিং
মাত্র একটি দিনের জন্য এত হ্যাপা! কিন্তু একবার করার পর ত্বকের চাকচিক্য দেখে মনে হবে, সিদ্ধান্ত সঠিক। তাই সৌন্দর্যবিশেষজ্ঞরা আজকাল কনের মতো বরকেও তাদের প্রস্তুতির জন্য ওয়াক্সিংয়ের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। আপার ব্যাক, লোয়ার নেক কিংবা নিচের ঘাড়ে যদি অবাঞ্ছিত লোম থাকে, সেগুলো কিন্তু বিয়ের সময় দৃষ্টিকটু হয়ে ধরা দিতে পারে; বিশেষ করে ছবিতে। ব্যাপারটি নতুন সঙ্গিনীর ভালো না-ও লাগতে পারে। তাই সবকিছু পরিষ্কার দেখানোর জন্য ওয়াক্স করা খুব একটা দোষের নয়। সত্যি বলতে গেলে হাতের লোমের জন্য লজ্জিত হওয়ার কারণ নেই। কিংবা অন্য কোথাও থাকলেও তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু নিজেকে পারফেক্ট দেখাতে ওয়াক্সিং একবার ট্রাই করে দেখা যেতেই পারে। আর যদি খুব অস্বস্তি হয়, সে ক্ষেত্রে এটি নিয়ে না ভাবলেও চলবে।
ত্বকের যথা যত্নে
বিয়ের বিশেষ দিনটির জন্য ত্বক আকর্ষণীয় করে তোলা চাই। তার জন্য চাই একটি দুর্দান্ত স্কিনকেয়ার রুটিন। এ ক্ষেত্রে বিউটিশিয়ানদের পরামর্শ হলো, বিয়ের অন্তত দুই সপ্তাহ আগে থেকে ত্বকচর্চার যাত্রা শুরু করা। কারণ, চর্চায় ব্যবহৃত অনেক নতুন বিউটি প্রোডাক্টই ত্বককে জ্বালাপোড়ার ঝুঁকিতে ফেলে দিতে পারে। সেটি থেকে যেন নতুন বিপদ দেখা না দেয়, তার জন্য আগেভাগেই সেগুলো ট্রাই করে নেওয়া ভালো। যারা অত সব ঝামেলায় যেতে চান না, তারা সাধারণভাবে দিনে দুবার ক্লিনজার ব্যবহারের মাধ্যমে মুখ-ত্বক পরিষ্কার করে নিতে পারেন। ত্বক শুষ্ক হলে একটি ময়শ্চারাইজিং ক্লিনজার আর যদি ব্রেকআউটপ্রবণ হয়, সে ক্ষেত্রে স্যালিসিলিক অ্যাসিড বা টি ট্রি অয়েলযুক্ত ক্লিনজার বেছে নেওয়া ভালো। সেই সঙ্গে একটি নাইট ক্রিম ব্যবহার শুরু করা প্রয়োজন। রাতে যেমন মন ও শরীর বিশ্রাম পায়, তেমনি ত্বকও বিশ্রাম পাবে নাইট ক্রিমের ব্যবহারে। ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক পুনরুদ্ধার করতে এবং তেল-জলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটি কাজ করবে। বিয়ের দিন এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেকের মুখে ব্রেকআউটের প্রবণতা বা বলিরেখা দেখা দিতে পারে। মানসিক প্রেশার এবং কাজের চাপ ব্রেকআউটগুলোকে ট্রিগার করতে পারে। সমস্যা খুব গুরুতর হলে কোনো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া শ্রেয়।
মেকআপ
কনেই শুধু সাজবেন, বর নন? সেই দিন আর নেই! ছেলেরা আজকাল সমানতালে মেকআপ করছেন। বিয়ের দিন হলে তো কথাই নেই। গ্রুম মেকআপের জন্য রয়েছেন স্পেশাল মেকআপ আর্টিস্ট। আর কিছু না হোক, আকর্ষণীয় তো লাগতে হবে। সে ক্ষেত্রে মেকআপ গ্রুম লুক অর্জন করতে সাহায্য করবে। নিয়মিত মেকআপে অভ্যস্ত না হলে অবশ্যই এর জন্য একজন মেকআপ আর্টিস্ট বেছে নেওয়া উচিত। বেশির ভাগ বর এমন লুক পছন্দ করেন যেন দেখে মনে হয়, তারা একদমই মেকআপ করেননি। একজন সত্যিকারের শিল্পীই কেবল এই ন্যাচারাল নো মেকআপ লুকটি আনতে সহায়তা করতে পারেন। আর যারা ভাবছেন মেকআপ মেয়েলি, না করলেও চলবে; তাদের জানা প্রয়োজন, মেকআপের জাদুকরি ছোঁয়াতেই বিয়ের ছবিতে বরকে দুর্দান্ত দেখায়। অতিথিরা আলিঙ্গন দেওয়া এবং শুভকামনা জানানোর জন্য কাছে এসে চমকে যেতে পারে নতুন এ রূপে। তবে কথা আছে। বিয়ের দিন সত্যিই সুন্দর দেখাবে কি না, তা নিশ্চিত করতে আগেই একটি ট্রায়াল রান দেওয়া যেতে পারে। যারা মেকআপ পরে অভ্যস্ত নন, তাদের জন্য আগেভাগে করা এই অনুশীলন বিয়ের দিন আরও আত্মবিশ্বাসী এবং স্বাভাবিক বোধ করতে সাহায্য করবে।
ম্যানিকিউর ও পেডিকিউর
খুব জরুরি বিয়ের জন্য। কারণ, হ্যান্ডশেক থেকে শুরু করে আংটি পরা, খোঁজা—সবকিছুতেই হাত মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে; তাই সেটি পরিষ্কার, নিখুঁত থাকা আবশ্যক। এ ছাড়া বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসবে, স্যালনের চেয়ারে বসে এমন আরামের সময় প্রয়োজন হতে পারে যেকোনো বরের। পেডিকিউর ঐচ্ছিক, তবে এবড়োথেবড়ো রুক্ষ পা জুতায় ঢাকা থাকলেও তার অনুভূতি কিন্তু পুরোটা সময় অস্বস্তি দিতে পারে। পুরোপুরি কনফিডেন্ট ফিল করার জন্যও পায়ের দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া দরকার। সুতরাং সময় রাখা চাই ম্যানিকিউর ও পেডিকিউরের জন্য।
আগে সুস্থতা
মেকআপ-গেটআপে যতই টিপটপ দেখাক না কেন, আসল হলো শারীরিক সুস্থতা। শরীর সুস্থ থাকলে নিজে থেকেই ভালো বোধ করবেন বরেরা। চেহারায়ও তা প্রকাশ পাবে। তাই সুস্থ থাকা চাই। কীভাবে? একদম সহজ কিছু টিপস রয়েছে সে ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। হাইড্রেশন গুরুত্বপূর্ণ; কারণ, এটি বিয়ের জন্য প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেরা দেখাতে এবং অনুভব করতে সহায়তা করবে। দিনে অন্তত দশ গ্লাস পানি পান এমনিতেই যে কারও জন্য জরুরি। তবে বিয়ের এই বিশেষ দিনগুলো মোকাবিলায় একটি ভালো হাইড্রেশন রুটিন তৈরি করে নিতে পারলে ভালো। লেবু বা ফলের সঙ্গে মিশিয়ে ডিটক্স ওয়াটার তৈরি করে নেওয়া যেতে পারে, অথবা সব সময় পরিমাণমতো পানিভর্তি একটি বোতল সঙ্গে রাখতে পারেন। পাশাপাশি প্রয়োজন বিশ্রাম। কমপক্ষে আট ঘণ্টা ঘুম। রাতে ঘুম আসতে চায় না? অনেক কাজ? তবু জোর করে হলেও যতটা সম্ভব বিশ্রাম নেওয়ার চেষ্টা করা চাই। ভালো মেজাজ, চেহারায় ঔজ্জ্বল্য, তারুণ্যের আভা এবং বিয়ের সব কাজ সুন্দরভাবে সারার শক্তি পাওয়ার জন্য এটি ভালো টোটকা। আরও সহজ পরামর্শ চাই? একটি ঘুম-সহায়ক অ্যাপে মেম্বারশিপ নিতে পারেন। বিকেলে ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা জরুরি। স্ক্রিন টাইমও হওয়া চাই সীমিত। ঘুম আসতে বাধ্য!
ক্র্যাশ ডায়েট রদ
মিডিয়ার কল্যাণে এখন অনেকেই ভাবে, বিয়ের দিনে যতটা সম্ভব ফিট ও ট্রিম থাকা চাই। বলি, এর আদতে প্রয়োজন নেই! কেননা এই চক্করে ক্র্যাশ ডায়েট এবং সীমিত খাওয়ার ফলে ক্লান্তি, বিরক্তি এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি হয়, যা আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্য এবং বাহ্যিক চেহারাকে প্রভাবিত করে। যদিও স্বাস্থ্যকর আহার সব সময় ভালো, কিন্তু জোর করে এ সময় খাবারের ওপর চাপ দেওয়া আসলে একটি বিবাহ-সম্পর্কিত উদ্বেগ, যা আপনার এড়ানো উচিত। তার চেয়ে বরং সকালে জগিং করা যায়। স্লিম হওয়ার জন্য নতুন ওয়ার্কআউট রুটিন নিয়ে চাপ নেওয়ার সময় এখন নয়। তবে সাধারণ ব্যায়াম বা ফাস্ট ওয়ার্কআউট রক্ত প্রবাহে সাহায্য করতে পারে। শরীরের সুস্থতা রক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আভা এনে দেয় ত্বকে। এগুলো করাও যায় সহজে। লিভিং রুমে নাচ কিংবা সাধারণ যোগব্যায়ামের চেষ্টা করা যেতে পারে। গবেষকেরা বলছেন, সুন্দর দেখাবার জন্য প্রত্যেক বরের উচিত বিয়ের দিনে কিছু হালকা ব্যায়াম করা। কারণ, ওয়ার্কআউট-পরবর্তী আভা বেশ কয়েক ঘণ্টা স্থায়ী হয়। আর এটি মূল অনুষ্ঠানের জন্য পুনরুজ্জীবিত ও উদ্দীপিত বোধ করতে সহায়তা করে।
অনেকে আছেন, বিয়ের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে, তত নার্ভাস বোধ করা শুরু করেন। এ সমস্যা সবচেয়ে বেশি ঘটে বিয়ের দিন। কেবল কনে নয়, বরদেরও এই দিনে জ্ঞান হারানোর নজির আছে! বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাপারটি অস্বাভাবিক নয়। অতিরিক্ত চাপে এমন অবস্থা হয়। বিয়ের দিন এমন অনুভূত হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিজেকে স্থির রাখার চেষ্টা করা চাই। মেঝেতে বসে বা শুয়ে, হৃৎপিণ্ড ও পেটে একটি হাত রেখে পেটের ওঠানামা অনুভব করতে করতে গভীরভাবে শ্বাস নিতে হবে। পাশাপাশি মনের সঙ্গে কথা বলে বা অটো সাজেশন দেওয়া যেতে পারে নিজেকে। এটা কিছু না, ঠিক আছি, আমি প্রস্তুত, আমার সামনে সুন্দর দিন আসতে চলেছে, অথবা আজকের দিনটি দারুণ স্পেশাল হবে…এসব ছোট ছোট পজিটিভ বাক্যে। হাস্যকর লাগছে শুনতে? হাসির কিছু নেই। এটি একধরনের মনোব্যায়াম। এই অভ্যাস বিয়ের দিন প্রেশার রিডিউস করবে। সবচেয়ে বড় কথা, আনন্দের বড় মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার আত্মবিশ্বাস এনে দেবে।
রত্না রহিমা
মডেল: সাদাফ
মেকওভার: পারসোনা মেনজ
ছবি: কৌশিক ইকবাল