কভারস্টোরি I বেনারসি: বাংলা থেকে বাংলাদেশ
এই বঙ্গের সম্পদ ঢাকার মিরপুরের বেনারসি। পরিচিত লোকশিল্প। জৌলুশে ভরপুর। কিন্তু ইতিহাস নিয়ে রহস্য। আর নানা মুনির নানা মত। সীমান্তহীনে সীমান্ত খোঁজার মিথ। আবার জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেও হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। গ্রন্থ, গবেষণাপত্র, সাক্ষাৎকার আর জরিপে আদি আখ্যানের খোঁজ করেছেন সারাহ্ দীনা
ইরান থেকে বেনারস
বেনারসি। নামেই লুকিয়ে আছে অনেক কথা। প্রথমবার এই শাড়ির নাম শুনে মনে হয়, উৎপত্তি হয়েছে বেনারসে। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। এমন বুননের শাড়ি পার্সিয়াতে অর্থাৎ ইরানে তৈরি হয়েছিল প্রথম। সেখান থেকে যাত্রা ভারতে। ইনায়াত খানের লেখা ‘শাহজাহাননামা’ বইয়ের মাধ্যমে জানা যায়, মোগল সাম্রাজ্যের অধিপতিরা রানিদের জন্য শাড়ি আনাতেন বিভিন্ন দেশ থেকে। এর মধ্যে একটি ইরান। হাতে বোনা ইরানিয়ান শাড়ির প্রতি অনুরক্ত ছিলেন রাজপরিবারের নারীরা। তাদের মধ্যে নূর জাহান অন্যতম। বাদশা জাহাঙ্গীরের স্ত্রী। নিজেও ছিলেন সৃজনী। জানতেন কীভাবে ফ্যাব্রিকে নকশা করতে হয়। কদর করতেন সৃজনশীলতার। সে সময়কার শাড়ির বিশেষত্ব ছিল রং এবং নকশা—দু জায়গাতেই। বেশির ভাগ শাড়ি ছিল সাদামাটা।
জানা যায়, আইভরি হোয়াইট শেডের শাড়ির আধিপত্য ছিল তখন। পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছিল টকটকে রক্ত লাল। মোটিফে ছিল ফুলেল নকশা। নিত্যদিন তিনি অন্তত তিনবার পোশাক বদল করতেন। সেগুলো পুনর্বার ব্যবহার করতেন না। দিয়ে দিতেন তার খেদমতকারীদের। এভাবে রানির বহুমূল্যের শাড়ি রাজবংশের বাইরে পৌঁছায়।
ভারতের বেনারসে তাঁতিরা একই বয়নকৌশলে শাড়ি বুনতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে বাড়ে ব্যাপকতা। বয়ন-বাণিজ্য কলেবরে বাড়লে স্থানের নাম অনুসারে নামকরণ হয় ‘বেনারসি শাড়ি’। বানারস নামেও পরিচিতি ছিল। ‘কাশি’ ডাকারও প্রচলন ছিল অনেক দিন অব্দি।
বেনারসি বয়ান
ভারতীয় উপমহাদেশে বেনারসির যাত্রা শুরু প্রায় পাঁচ শ বছর আগে। সেখানে প্রস্তুত করা শাড়ি ছিল আনকোরা। ইরানের শাড়ির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য পাওয়া যায় এর। তাঁতিরা তাদের নিজস্বতা প্রকাশ করেন অলংকরণে। বদলে যায় রং, মোটিফ—দুই-ই। শাড়ি রাঙাতে ব্যবহার করা হতো ন্যাচারাল ডাই। মাখন রঙা এবং লাল শাড়ি ছিল বেশি। পাশাপাশি ছিল গোলাপি শাড়ি।
বেনারসি মূলত ওয়েফট বুননের শাড়ি। ওয়ারপে বোনা বেনারসিও মেলে, তবে পরিমাণ হাতে গোনা। সুতার অবস্থানের ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। বেনারসি শাড়ি তৈরি করা হয় রেশম সুতায় মূলত দুটি ফিলামেন্ট একসঙ্গে টুইস্ট করে। সঙ্গে সোনালি ও রুপালি জরি থাকে অলংকরণে। শাড়ি বুননের দায়িত্বে থাকেন কারিগর। তারা কাজ সম্পন্ন করেন হস্ততাঁত এবং বিভিন্ন ছোট যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে। বেনারসের শাড়ির মূল উপাদান রেশম সুতা। মালদা, চীন, জাপান থেকে আমদানি করা হতো এই উপকরণ। সেখান থেকে বিভিন্ন রকমের শাড়ি তৈরি করতেন তাঁতিরা। সুতার মধ্যে বাংকাস, সুবহানি আর আংরেজি ধরনেরগুলো ছিল হালকা ওজনের। মসৃণ এই রেশম সুতা মূলত ব্যবহৃত হতো টারবান ও রুমাল তৈরিতে। মুক্তা নামের সিল্ক সুতা ব্যবহার করা হতো ব্রোকেড তৈরিতে। এর কারণ ছিল এটির অমসৃণতা। স্যান্ডাল নামের সুতা পাওয়া যেত হলুদ ও সাদা রঙে। ঘুঙ্গারু রেশমেও তৈরি হতো সিল্ক। এই সুতাকে আবার বিভিন্ন ভাগ করা হতো—চিনিয়া, কাতান, পাট, ওয়েস্ট সিল্ক, তসর সিল্ক। চিনিয়া ব্যবহারে বানানো হতো ফুলেল নকশার জন্য ফ্যাব্রিক। কাতান হালকা আর পাট ব্যবহার করা হতো ভারী ফ্যাব্রিক তৈরিতে।
আনকোরা অলংকরণ
চিত্রলেখা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিন অন আর্ট অ্যান্ড ডিজাইনে প্রকাশিত বেনারসি-সম্পর্কিত একটি জার্নালে জানা যায়, বেনারসির অলংকরণে দেখা যেত মোগল সাম্রাজ্য থেকে উৎসাহিত ফ্লোরাল প্যাটার্ন। প্রমাণ হিসেবে তারা লিখেছেন সম্রাট আকবরের চিত্রশিল্পের কথা। সেখানে দেখা গিয়েছিল অর্ধপ্রস্ফুটিত ফুল; যা পরে বেনারসি শাড়ি অলংকরণের মোটিফ হিসেবে দেখা যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্যানভাসে এঁকেছিলেন ডাঁটাসহ আফিম গাছের ফুল। সেখান থেকেও মোটিফ এসেছে এই শাড়িতে। সম্রাট শাহজাহান পাতার ডিটেইল ফুটিয়ে তুলতেন রংতুলিতে। এই পাতাও খুঁজে পাওয়া গেছে বেনারসির অলংকরণ উপাদান হিসেবে। এ শাড়ি অলংকরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ কলকা। জমিনে, পাড়ে—দুই জায়গাতেই দেখা মেলে। ফুলেল নকশাও বেনারসি শাড়িতে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। কখনো পাড়ে, কখনোবা জমিনে। এই শাড়ির পাড় ‘বেল’ নামে তাঁতিদের কাছে পরিচিত। বেল ফুলের নকশা করা হলে তাকে বলা হয় বেল বুটি। আর ফুল-পাতার মিশ্রণের ভারী অলংকরণকে বলে জংলা।
মূলত জরি ব্যবহার করে জমিন ও পাড়ে নকশা ফুটিয়ে তোলা হতো। সেই ধারা এখনো আছে। মোগল আমলে রুপার তারে স্বর্ণের পাতলা রাংতা মুড়ে নিয়ে তৈরি করা হতো জরি। সে জায়গা অবশ্য এখন অনেকটাই কৃত্রিম উপাদানের দখলে।
বেনারস থেকে বাংলা
মোগল সাম্রাজ্য থেকে শুরু হয় বেনারসি শাড়ির যাত্রা। এরপর ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁতিরা ছড়িয়ে পড়েন। বেনারসি তাঁতিদের একটি বড় অংশ ছিল মুসলমান। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রথম সমস্যার সম্মুখীন হয় এ শিল্প। রেশম ও অলংকরণের বেশির ভাগ উপাদানের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি এই এলাকার তাঁতশিল্পকে বিপর্যস্ত করে। তাঁতিরা অর্থনৈতিক সমস্যা থেকে মুক্তির আশায় উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েন। ইংরেজ শাসনামলে মুসলিম তাঁতিদের কিছু অংশ পূর্ব পাকিস্তানে নিবাস গড়ে তোলেন। আর কিছু চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের নারিন্দা, ইসলামপুর, নবাবগঞ্জ, সিদ্দিক বাজার, বেচারাম দেউড়ি, দক্ষিণ মৈশুন্ডি ও নবাবপুরে বেনারসি বয়নে পটু তাঁতিরা হস্ততাঁত স্থাপন করেন। ধীরে ধীরে এই স্থানগুলোতে জনসমাগম ঘটে। তাঁতশিল্পীদের কাজের জন্য শব্দহীন পরিবেশের উপযোগিতা আছে। মুখরতা তাদের শিল্পমন প্রকাশের অন্তরায়। তাই স্থান পরিবর্তনের পরিকল্পনা আঁটেন তারা। নতুন আবাসস্থলের খোঁজে একসময় বর্তমানের মিরপুর ১০ এবং মিরপুর ১-এ এসে থিতু হন। তারই পরিক্রমায় আশপাশের জায়গাতেও তাঁতিরা আবাস গড়তে শুরু করেন। মিরপুরের সেকশন ১০, ১১ এবং ১২ জুড়ে গড়ে ওঠে বেনারসিপল্লি; যা এখন মিরপুর ১৪ অব্দি বিস্তৃত।
এখন এই বেনারসিপল্লিতে একই সঙ্গে ১১ হাজার তাঁতি ও নকশাকার অবস্থান করেন। পাশাপাশি অন্যান্য কাজে নিয়োজিত কর্মীরাও থাকেন। পল্লির পুরো এলাকার এক অংশে তাঁতিদের বসবাস, কারখানা; আরেক অংশে শোরুম। যেখানে কেনাবেচা সম্পন্ন করেন ক্রেতা-বিক্রেতা।
বয়ন-বুনন
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের প্রথম দিকে মিরপুরের নিজস্বতা ছিল সুতি বেনারসি বুননে। আর বেনারসি কাতান তখন তৈরি হতো পাকিস্তানে। এর পেছনে ছিল রাজনৈতিক কারণ। তখন বেনারসি কাতান তৈরিতে যেসব উপাদান প্রয়োজন হতো, তার সব কটি স্থানীয়ভাবে উৎপাদন সম্ভব ছিল না। আমদানি করতে হতো বিভিন্ন দেশ থেকে। বঙ্গভঙ্গের পর থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশে বসবাসরত তাঁতিদের জন্য অন্য দেশ থেকে পণ্য আনয়নের জন্য এলসির ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না। সেখানে জায়গা নিয়েছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান অংশের তাঁতিরা। তারা সহজেই পাকিস্তানের ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি করতেন কাতানের জন্য প্রয়োজনীয় সুতা, ডাই। নিজেরাই বুননের অংশে কাজ করতেন। আর পূর্ব পাকিস্তানের তাঁতিরা তাদের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে কিনে নিতেন। অর্থাৎ বেনারসি বুননের কাতান আমদানি করতেন। দাপ্তরিক জটিল প্রক্রিয়া এবং অতি উচ্চ বিনিময়মূল্যের কারণে ধীরে ধীরে কাতান থেকে সরে আসতে থাকেন তারা। নিজেদের বয়নকৌশল ধরে রাখতে সুতি সুতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তৈরি করেন সুতি বেনারসি শাড়ি। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে উপকরণ আমদানি সহজ হতে থাকে। বাংলাদেশে বেনারসি, কাতান বুনন শুরু হয়। প্রথম দিকে হালকা হলুদ সিল্ক সুতা ব্যবহারে হস্ততাঁতে সম্পন্ন হতো বুনন। নকশার জন্য তৈরি করা হতো লেখচিত্র। আর অলংকরণের জন্য জরুরত পড়ত জরির।
বিভিন্ন ধরনের সিল্ক সুতা ব্যবহার করা হতো কাতান তৈরিতে; যেমন তন্দুরি, বাঙ্কাস, মুক্তা, স্যান্ডাল ছিল এই তালিকায়। বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন টেকনোলজির ‘ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েডিং কস্টিউম ফ্রম বেঙ্গল টু বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণার মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৫৮ থেকে ২০১৬ সালে মিরপুরে বুনানো বেনারসি শাড়ি বিভিন্নভাবে রূপ বদলেছে। এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মিরপুর বেনারসি শাড়ি নিজস্বতা তৈরিতে সফল হয়েছে। ১৯৫৮ সালে লাল শাড়ির সঙ্গে সোনালি পাড় ছিল জনপ্রিয়। পাড়ের প্রস্থ খুব বেশি জায়গা নেয়নি। ১৯৬৫ সালে মাঝারি আকারের চওড়া পাড় আসে বাজারে। জমিনে তখনো লাল রঙের জয়জয়কার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পরিবর্তন এসেছে ধারাবাহিকভাবে। রং, মোটিফ, পাড়—সবখানেই। লালের পাশাপাশি মেরুন আর ম্যাজেন্টার ক্রেতাচাহিদা তৈরি হয় ধীরে ধীরে। আশির দশকে পাড়ের প্রস্থ আরও বাড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দখল করে নেয় শাড়ির অর্ধেক অব্দি। এ সময়টাতে বুটি মোটিফের জায়গায় জনপ্রিয়তা পায় জংলা ছাপা। নব্বইয়ের শেষের দিকে পাড় আর আঁচলে কনট্রাস্ট কালার জায়গা করে নেয়। শাড়ির রং ও পাড়ের পরিবর্তনের কারণ হিসেবে জানা গেছে ক্রেতাচাহিদার প্রতিফলন।
মিরপুর বেনারসিপল্লিতে শাড়ি বুনন করা হয় হস্ততাঁতের মাধ্যমে। এভাবে একটি শাড়ি তৈরিতে প্রয়োজন অন্তত দুই মাস। কখনো কখনো নকশার ভিন্নতার কারণে প্রয়োজন হয় ছয় মাসের।
বাংলাদেশের এই অঞ্চলের তাঁতিরা পিওর সিল্ক ব্যবহার করে কাতান তৈরিতে দক্ষতা রাখেন। সেরিকালচারের মাধ্যমে রেশম চাষ করে, সেখান থেকে প্রাপ্ত রেশম সুতা ব্যবহার করে বোনা হয় শাড়ি। ইদানীং সুতা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। খাঁটি রেশম সুতার বাজারদর বেশি হওয়ায় ম্যানমেইড সিনথেটিক সুতায় আগ্রহী হচ্ছেন অনেকে। ন্যাচারাল ডাইয়ের জায়গা নিয়েছে রাসায়নিক ডাই। একচ্ছত্র আধিপত্য এই রঙের।
বেনারসি বিপণন
বেনারসিপল্লির শুরুর সময়ের সঙ্গে বর্তমান বাজারের বিপণনব্যবস্থার ফারাক আকাশপাতাল। শুরুর দিকে শাড়ি বিক্রি হতো গদিঘর নামের একটি বিশেষ স্থানে। সেখানে থাকতেন মহাজন। কারিগরেরা শাড়ি বুনে দিয়ে যেতেন। আর সংগ্রহ করে নিতেন ব্যবসায়ীরা। নিয়মিত ক্রেতাদের বাড়ি বাড়ি শাড়ি নিয়ে যাওয়া হতো। সেখানেই সম্পন্ন হতো বিক্রি-বাট্টা। এরপর কালের পরিক্রমায় এসেছে পরিবর্তন। গড়ে উঠেছে শোরুম। বর্তমানে এই পল্লিতে শোরুমের সংখ্যা শতাধিক। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (বুয়েট) তিনজন শিক্ষার্থীর সম্পন্ন করা গবেষণা, ‘মিরপুর বেনারসি পল্লি অব বাংলাদেশ: লিভিং অ্যান্ড লাইভলিহুড অব ওয়েভারস’-এর মাধ্যমে জানা যায়, ২০১৪ সালে এই শিল্পের বার্ষিক আয় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা।
ডিজাইনার লেবেলে মিরপুর বেনারসি
মিরপুর বেনারসি শাড়ি নিয়ে এখন কাজ করছেন ফ্যাশন ডিজাইনাররাও। তাদের একজন সাফিয়া সাথী। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যদি ১০ জন কনে বিয়ের পোশাকের জন্য আসেন, তাদের মধ্যে অন্তত ৭ জন বিয়ের যেকোনো একটি অনুষ্ঠানে মিরপুর বেনারসি পরতে চান। কনেদের চাহিদার কথা জেনে আমরা নিজেরাই এই শাড়ির কালেকশন রেখেছি। এখানে বেশির ভাগ শাড়ির রং লাল আর পাড় সোনালি। কারণ ক্রেতাচাহিদা। নকশায় আমরা প্রাধান্য দিই ফ্লোরাল অর্থাৎ বুটি ও জংলা মোটিফ। পিওর সিল্কে তৈরি শাড়ির মূল্য ম্যানমেইড ফাইবারে বোনা শাড়ির চেয়ে বেশি। আমরা নিয়মিত পিওর বেনারসি তৈরি করি। এর বুননেও যথেষ্ট সময় দরকার পড়ে। ক্রেতাসন্তুষ্টিতে বুঝতে পারি, হাই কোয়ালিটির পিওর সিল্ক বেনারসি কাতানের চাহিদা বেশি।’
বিয়েতে-উৎসবে
মিরপুরের বেনারসি শাড়ি আমাদের দেশের মেয়েদের উৎসবের পোশাক হিসেবে সমাদর পেয়েছে, এখনো পাচ্ছে। কনের পোশাক হিসেবে এই শাড়ির ব্যবহার দেখা যায় স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী ১৯৫৮ সাল থেকে। এখনো সেই চাহিদা শেষ হয়ে যায়নি। টিম ক্যানভাস ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের কনেদের কাছে মিরপুর বেনারসি শাড়ির চাহিদা জানতে একটি জরিপ পরিচালনা করে। ৫০ জন নারীর কাছে জানতে চাওয়া হয় তাদের বিয়ের পোশাকের বিষয়ে। তাদের মধ্যে ৪৬ জন বিয়ের অন্তত একটি অনুষ্ঠানে জামদানি পরেছেন। ৪৩ জন বেছে নিয়েছেন লাল জমিনের সোনালি পাড়ের শাড়ি। কেউ পরেছেন মেরুন জমিনের রুপালি পাড়, আবার কেউ ম্যাজেন্টা জমিনের সবুজ পাড়; আর বাকিরা উজ্জ্বল বেগুনি রং জমিনের সোনালি পাড়ের শাড়ি।
বেনারসি সংকটে
বেনারসি শাড়ির ব্যাপক চাহিদা প্রমাণিত হওয়ার পরও এর ভবিষ্যৎ ভাবনা আনন্দের নয়; বরং দুশ্চিন্তার। মিরপুর বেনারসিপল্লিতে হস্ততাঁতের ব্যবহারে শাড়ি তৈরি করা হয়। তাতে প্রয়োজন দীর্ঘ সময়ের। শতভাগ রেশম সুতায় তৈরি শাড়ির চাহিদা থাকলে সে রকম সুতা পাওয়া কষ্টসাধ্য। এক কেজি পিওর সিল্কের দাম অন্তত সাড়ে ৮ হাজার টাকা। এই ওজনে ওয়াক্সের পরিমাণ ২০-২৫ শতাংশ। যা তাঁতে ব্যবহারের আগে সুতা থেকে আলাদা করা হয়। অর্থাৎ কেনা সুতার পরিমাণ কমে যায়। এ ছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে, আবার লাভের পরিমাণও সামান্য। যে শাড়ি তৈরিতে প্রয়োজন ৬৫ হাজার টাকা, তার বিক্রয়মূল্য ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। আর এই শাড়ি তৈরি বাবদ একজন শ্রমিক আয় করেন দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। মাস শেষে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে সক্ষম হন তারা।
হস্ততাঁতে তৈরি মিরপুর বেনারসি শাড়ির পাশাপাশি বেশির ভাগ শোরুমে বিক্রি হচ্ছে আমদানি করা পাওয়ার লুমে তৈরি শাড়ি। এগুলো দামে সস্তা হওয়ায় ক্রেতারা আকর্ষিত হচ্ছেন। কিন্তু এগুলোর বাহ্যিক সৌন্দর্য হাতে তৈরি মিরপুর বেনারসির কাছাকাছি হলেও ব্যবহার করলে ফারাকটা অনুভূত হচ্ছে। ফলে আস্থা হারাচ্ছেন ক্রেতা। হস্ততাঁতের জায়গা করে নিচ্ছে পাওয়ার লুম। দ্রুততম সময়ে শাড়ি তৈরির পাশাপাশি খরচ পড়ছে কম। তাই মূল্য তুলনামূলক কমই হাঁকছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু মানের দিক থেকে হস্ততাঁতের সঙ্গে বিস্তর ফারাক রয়েছে শাড়িগুলোর।
বিয়ে ও উৎসবকেন্দ্রিক বাজারে বেনারসির ক্রেতাচাহিদা যথেষ্ট। প্রয়োজন দেশীয় পণ্যের স্বার্থ রক্ষায় সচেতনতা। বিদেশি পণ্যের আগ্রাসন থেকে নিজস্বতাকে রক্ষা। এ জন্য সুতাসহ যাবতীয় কাঁচামালের আমদানি সহজ ও সুলভ হলে মিরপুর বেনারসিপল্লির তাঁতিসহ অন্য তাঁতিরাও উপকৃত হবেন। দেশের শিল্প বাঁচবে; বাঁচবে বছর-পুরোনো সংস্কৃতি আর সমৃদ্ধির ঐতিহ্য।
তথ্যসূত্র
১। শাহজাহাননামা: ইনায়াত খান
২। বেলাল আহমেদ: জারীন সিল্ক ইন্ডাস্ট্রি
৩। গবেষণাপত্র:
মিরপুর বেনারসিপল্লি অব বাংলাদেশ: লিভিং অ্যান্ড লাইভলিহুড অব ওয়েভারস—ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কেমিক্যাল অ্যান্ড প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ
দ্য ডিক্লাইন অব বানারাসি সিল্ক হ্যান্ডলুম কটেজ ইন্ডাস্ট্রি: আ কেস স্টাডি অব ব্রোকেড উইভিং কমিউনিটি ইন বানারাসি—চিত্রলেখা ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিন অন আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন
ডেভেলপমেন্ট অব ওয়েডিং কস্টিউম ফ্রম বেঙ্গল টু বাংলাদেশ: ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব টেক্সটাইল সায়েন্স
মডেল: বিদ্যা সিনহা সাহা মিম ও সনি পোদ্দার
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সানায়া কুটর
জুয়েলারি: আমিসে
ছবি: কৌশিক ইকবাল