ফিচার I তাসির এ মোগল
জমকালো আর আড়ম্বরে পরিপূর্ণ। তবেই না তা বিয়ের পোশাক! কিন্তু ব্যাপারটা কি বরাবরই এ রকম, নাকি অতীতের দলিল-দস্তাবেজে মিলবে ভিন্ন আখ্যান। সে কোন অন্তঃপুর, যার অনুপ্রেরণায় আজও সেজে ওঠেন আধুনিক বর-কনেরা। ডিজাইনাররা সাজান তাদের মুড বোর্ড। উত্তরের খোঁজে পূর্বতনের পথে হেঁটেছেন জাহেরা শিরীন
মধ্যযুগ। মুসলমান শাসকদের সমকালীন ভারতবর্ষ। সে সময় সবকিছুতেই বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি হয় সবচেয়ে বেশি। বাদ পড়েনি বস্ত্রশিল্পও। চরম উৎকর্ষ দেখা দিয়েছিল। সাধারণত সব দেশেই বিজিত বিজয়ীর অনুকরণ করে। আর সব দেশেই দেশের রাজা-রানির সাজসজ্জা থেকে অনুপ্রাণিত হন অভিজাতেরা, তাদের দেখাদেখি সাধারণ মানুষ। ভারতে এসে ভিনদেশি রাজারা যখন এ দেশেই শাসক হয়ে বসলেন, তারাও বর্ণাঢ্য ভারতীয় সাজসজ্জায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসকেরা ভারতে আসার আগেই চীন আর পারস্যের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। আর এ দুটি দেশের বস্ত্রশিল্প চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল বহু আগেই। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন মেনে মুসলমান শাসকেরা যে পোশাক পরতেন, তা ছিল সাদাসিধে। ঘোর রঙের, মোটা সুতি কাপড়ের। তাতে না ছিল নকশা, না ছিল রং। যুদ্ধক্ষেত্রে পরার উপযোগী করে তৈরি। মেয়েরাও পরতেন একরঙা পেশওয়াজ আর পাজামা। ভারতে এসে রাজস্থানের মেয়েদের দেখে তারা ওড়নার ব্যবহার শুরু করেন। প্রথমে আকারে খুব ছোট ছিল, পরে ক্রমশ বড় হয় ওড়না বা দোপাট্টা। বলা হয়, ওড়নার এই ক্রমবিবর্তনই হয়তো ভারতীয় পোশাকের জগতে সবচেয়ে বড় বিস্ময়।
মুসলমানদের রাজ-অন্তঃপুর বা হারেমে কড়াকড়ি কিংবা পাহারা দেওয়ার কঠোর ব্যবস্থার চল ছিল। রাজপুত রাজাদের অন্তঃপুর বা রাওলার পর্দা এবং কড়াকড়িও ছিল মোগল হারেমের মতোই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, মোগল হারেমে রাজপুত রাজকন্যারা আসতেন বেগম হয়ে—ভিন্ন ভিন্ন রুচি আর সংস্কৃতি নিয়ে। হারেমে তারা সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন রাওলার রং আর ঔজ্জ্বল্য। তাদের বর্ণাঢ্য ঘাগরা, কাঁচুলি, ওড়না সে সময় নিশ্চয়ই মুগ্ধ করেছিল একরঙা পেশওয়াজ আর পাজামা পরা বেগমদের। প্রচলিত আছে, রাজস্থানের প্রকৃতি এত রুক্ষ বলেই রাজপুতানির অঙ্গে এত রং। রাজপুত রাজাদের পোশাকের মধ্যে কোমরবন্ধ বা পটকার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন মোগল বাদশাহ ও শাহজাদারা। দেখাদেখি তারাও সূক্ষ্ম জরির কাজ করা পটকা ব্যবহার শুরু করেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে রকমারি নকশার কোমরবন্ধ পাওয়া যায়। এই পটকা রাজপুত মেয়েরাও ব্যবহার করতেন ঘাগরার সঙ্গে। এটি যে শুধু বেল্টের কাজ করত তা নয়, কোমর সরু রাখতেও সাহায্য করত।
মুসলিম সমাজে চিত্রিত পোশাক পরার ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ছিল। তার বদলে কোরআনের হরফগুলো সুন্দর করে বিচিত্র উপায়ে বোনা হতো কাপড়ে। অন্যদিকে চীনে ছিল কাপড়ের ওপর সুতা বা জরি দিয়ে ছবি আঁকার চল। নানা রকম ডোরা দেওয়া কাপড়ের প্রচলনও ছিল। পারস্যের বিভিন্ন অঞ্চলে ডোরা কাপড়ের জামা, পাজামা আর পাগড়ি জাতীয় শিরস্ত্রাণও তৈরি করা হতো। এই দুই দেশ থেকে প্রভাবিত হয়ে মোগল আমলের আগে এবং পরে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বেগমদের পোশাকে ডোরাকাটা সিল্ক আর মসলিনের প্রাধান্য চোখে পড়ে। পুরোনো আমলের আঁকা ছবিতে দেখা যায় হারেমের মেয়েরা সাদা পাজামা আর আঁটসাঁট কুর্তা পরনে। একই কুর্তার নিচের দিকটা আধুনিক কামিজের মতো সমান নয়। চারটা বা ছয়টা কোণ থাকত তাতে, অনেকটা ত্রিভুজের মতো দেখাত সেগুলো। কুর্তায় থাকত ভি-শেপের গলা, সেখানে জরি বা সামান্য সুতার কাজ। মুসলমান শাসকদের পোশাকে বহুদিন কোনো নকশা ছিল না। পরে বেগমদের পোশাকে দ্রুত পরিবর্তন ঘটে এবং সে সময় থেকেই বস্ত্রশিল্পের বিশেষ করে কিংখাবের প্রভূত উন্নতি দেখা দেয়। সেই খানদানি ব্যাপার আজও চলে আসছে বেনারসির জগতে। তাই এখনো তসবীর, লহরিয়া, চারখানা, খানজুরি, ডোরিয়া, সালাইদার, মোটরা, ইলায়েচা, সঙ্গী, বুলবুলচশম, চশমানকশা, আড়িবেল, খাজুরিবেল, পানবুটি, ফুলবুটি, কলগাবুটা, শিকারগাহ, গুলদাউদি, চিনিয়াপট, মখমলী, বুটি মানাতাশি, জামেয়ার বুটি, ফর্দি বুটি, পাংখা বুটি, আসরফি বুটি, জালি কি তুরঞ্চ বুটি, বুটা ঝাড়দার, মেহরাব, তনছই, ভাসকট, আড়াগুড়র, গুলবদন, বেলদার, কাঙ্গুরী, ফুলোয়ার প্রভৃতি নামের ছড়াছড়ি। এই নামগুলো মনে করিয়ে দেয় বেনারসিশিল্পের বিশেষ জগৎকে। যে জগৎ শুধু নকশার নয়, বস্ত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহীদের জগৎ। তেমনই দুজন শিল্পপ্রেমী ছিলেন সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহান। এর মধ্যে নূরজাহান নিজেই ছিলেন শিল্পী; সূক্ষ্ম কারুকাজ করতে পারতেন কাপড়ের ওপর। এর মধ্যে অনেক নকশাই তার আবিষ্কার। এই মোগল সম্রাজ্ঞী ভারতীয় নারীর পোশাকে নতুনত্ব নিয়ে এসেছিলেন। তার কারণেই হারেমে পারসি প্রভাব বজায় ছিল, কিন্তু বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
মোগল হারেমের মেয়েরা কিংখাব ব্যবহার করতেন না। একরঙা বা ডোরাকাটা জামা ও পাজামার ওপরে সূক্ষ্ম মাকড়সার জালের মতো মসলিনের পেশওয়াজ পরার প্রচলন ছিল। কিংখাব নারীদের পোশাক হিসেবে উপযোগীও ছিল না। ভারী জরির কাজের জন্য কিছুটা কর্কশ থাকায়। এ ছাড়া সে সময় গা ভর্তি সোনা-রুপার অলংকার পরার চল থাকায় দুইয়ে মিলে রূপ খুলত না। তাই পুরুষেরা পরতেন কিংখাবের আংরাখা। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীর, শাহজাহান আর আওরঙ্গজেব—তিনজনই ছিলেন কিংখাবের সমঝদার। আওরঙ্গজেবের পছন্দ ছিল নানা ধরনের মসলিন, বিশেষ করে কাজ করা জামদানি মসলিন। আবরোঁয়া নয়নসুখ ও জামদানি তখন উৎকর্ষের চরম শিখরে ওঠে। চিকন কাপড়েও দেখা যায় নানা বৈচিত্র্য।
ভারতীয় নারীদের মধ্যে জুতা পরার চল খুব একটা ছিল না। যদিও বেলুরের দু-একজন মদনিকার পায়ে তখন দেখা গিয়েছিল হাই হিল হাওয়াই চটির মতো পাদুকা। তবে মোগল হারেমে জুতার প্রচলন ছিল। সামনেরটুকু কারুকাজ করা, ঢাকা। পেছনে কখনো ঢাকা, কখনো চটির মতো খোলা। তখন জুতার কারুকাজ করা অংশে কিংখাবের ব্যবহার শুরু। মাথায় টুপি পরার চলও ছিল। বেগমদের টুপি তৈরি হতো মহার্ঘ জরির কিংখাব দিয়ে, তাতে বসানো হতো দামি জহরত আর মুক্তা। মোগল হারেমে টুপির ওপরে বাঁ দিকে বসানো হতো বোতাম।
ভারতে এসে মোগল অন্তঃপুরের নারীদের নজর পড়ে কাঁচুলি, ঘাগরা আর ওড়নায় সুবেশা রাজপুতানিদের ওপর। তারা মুগ্ধ হন এই পোশাকের সৌন্দর্য, সাবলীলতায়। প্রথমে রাজপুতানিদের, বিশেষ করে কাংড়া অঞ্চলের মেয়েদের পটকা এবং পরে তাদের কাঁচুলি আর ওড়না আপন করে নেন হারেমবাসিনীরা। নূরজাহানের ছবিতে তার পরনে দেখা যায় ডোরাকাটা পাজামার ওপর খাটো জামা, যা কাঁচুলি আর কুর্তার সমন্বয়ে তৈরি। সঙ্গে মসলিনের পেশওয়াজ।
মোগল আমলে আবিষ্কৃত হয় পাঁচতোলিয়া ওড়না, দুদামী পেশওয়াজ, বাদল বা একধরনের কম দামি জরি, কিনারী বা লেস, আতর ই জাহাঙ্গিরী, নূরমহালী কিংখাব; আরও কত কী। পোশাকে সূক্ষ্ম কাজের প্রচলনও সে সময়কার। ধারণা করা হয় চিকেনকারীর নকশাও সে সময়ের করা। যদি তা না-ও হয়; সে সময় যে এই শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়, তাতে সন্দেহ নেই। বেগমদের বিয়ের সাজ তৈরি হতো জমকালো কিংখাব দিয়ে। নূরজাহান সে সময় স্থির করেন, বিয়ের সময় সবাই জমকালো জরির পোশাক পরবে। কিন্তু কিংখাবের পোশাক ছিল ব্যয়বহুল। গরিবেরা পরবে কী করে? ভেবেচিন্তে নূরজাহান নিজেই নকশা তৈরি করে ফেললেন। ফাঁকার ওপর জমকালো। সেসব নকশা খুব সূক্ষ্ম নয়, অথচ পুরো জমিটা ভরে থাকবে, তাকে বলা হয় ফাঁকার কাজ। বুনতে সময় কম লাগে, পরিশ্রম কম, তাই দামও সাধ্যের মধ্যে। দেখতে ঝলমলে জরির এই নতুন পোশাকের নাম দেওয়া হয় নূরমহালী। নূরজাহানের এই কাপড় ভারতীয় নারীর বিয়ের পোশাকের ভোলই পাল্টে দিয়েছিল। এরপর থেকেই বিয়ের কনের সাজ মানেই জমকালো জড়োয়ার প্রাচুর্য। এ প্রসঙ্গে অভিজাত মুসলমান মেয়েরা বিয়ের সাজে কেমন সাজতেন, তার নিখুঁত বিবরণ মেলে অ্যানা হ্যারিয়েট লিউনাউসের বর্ণনা থেকে। তিনি ভারতে এসেছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তখন খানদানি পরিবারগুলোতে সাবেকি ধারা পুরো মাত্রায় বজায় রয়েছে। নারীসুলভ আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে লিউনাউস লিখেছিলেন বধূসাজের বর্ণনা। লেখিকার পর্যবেক্ষণে সবার আগে যা চোখে পড়ে, তা ছিল জাঁকজমকের প্রাচুর্য। মোগল যুগের আড়ম্বর তাতে সুস্পষ্ট। একই সঙ্গে সবকিছুকে সোনাদানা, রং, কারুকাজ দিয়ে ভরিয়ে দেবার প্রবণতা নজর কাড়ে। তিনি যে কনের বর্ণনা দিয়েছিলেন, তার পরনে ছিল বেগুনে-লাল ঘাগরা। কুর্তা বা কাঁচুলিতে জরির সঙ্গে জড়োয়া পাথর বসানো। ছিল মুক্তার সারিও। চুলে, কপালে এমনকি জুতাতেও ছিল সোনার উপস্থিতি। আর সঙ্গে সোনারঙের ওড়নার ঘোমটা। সব মিলিয়ে যা সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে এতটুকুও অবসর মিলবে না চোখের। সে সময় নারীর সাজসজ্জায় প্রাচুর্যের ভূমিকা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল? বিশেষজ্ঞদের মত, অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব, স্বামীকে অপত্নীদের হাত থেকে রক্ষা করে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার প্রবল বাসনা থেকে হারেমে এর বাড়াবাড়ি শুরু হয়েছিল। তা ছাড়া মোগলরা এমনিতেই আড়ম্বরপ্রিয় ছিলেন। তাদের সাজসজ্জার জমকালো ভাব তৎকালীন অভিজাত সমাজে গৃহীত হয়েছিল ফ্যাশন হিসেবে।
মোগল আমলে আড়ম্বরের মধ্যেও নারীর সাজকে রুচিসম্মত করে তোলার প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালাতেন অনেক সম্রাজ্ঞী। কিন্তু সে সময় সাজ প্রসাধনে ফুলের কোনো জায়গা ছিল না। তার বদলে ব্যবহৃত হতো সোনা, হীরা কিংবা দামি পাথর বসানো রুপা আর জরির ফুল। মোগলেরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন রাজপুত রাজা আর রাজকন্যাদের সাজপোশাকে। পোশাকের অনুকরণ অব্যাহত থাকত সর্বক্ষণই। কাংড়ার মেয়েদের মতো কবজি ছোঁয়া আস্তিনের লম্বা চোলি মোগল অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে বেশি সময় নেয়নি। সে সময় আরও প্রচলন ছিল জাঙ্গুলি নামের একধরনের জামার। লম্বায় হাঁটু অব্দি, সামনে-পেছনে হীরা-জহরতের ছড়াছড়ি। জামাকাপড়ে জহরত বসানোর চল শুরু করেন জাহাঙ্গীর। তার আগে মুসলমান শাসক বা আমির-ওমরাহ জামায় হীরা, মুক্তা বসাতেন না; নিজেরাও গয়না পরতেন না। কিন্তু রাজপুত রাজাদের দেখে কত দিন আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়! মোগল মেয়েদের গয়নাপ্রীতির অনেক গল্প শোনা যায়। সেসব গল্পে প্রায়ই লোভ শোভনতার সীমা অতিক্রম করে। পুরুষদের গয়নাপ্রেমও কম ছিল না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ জাহাঙ্গীর। বেশবাস সম্বন্ধে অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন বলেই তিনি দুই কান বিঁধিয়ে দুটো উজ্জ্বল মুক্তা পরে ফেলেন। তার দেখাদেখি আমির-ওমরাহরাও কানে গয়না পরা শুরু করেন।
মোগল আমলে গয়নাগাটির চল ছিল ভালোমতোই। ছিল সোনা-রুপা-হীরা-জহরতের ছড়াছড়ি। সে সময় ভাস্কর্যের উদাহরণ নেই। আছে ছবি। যাতে দেখা যায় হারেম কন্যাদের নানা রকম সাজ। ডোরাকাটা বা ছাপা কাপড়ের আঁটসাঁট পাজামা, তার ওপরে মসলিনের অঙ্গাবরণ আর ওড়না প্রায় সবাইকে ঘিরে রয়েছে। অনেক সময় পাজামার ওপরে তারা পরতেন মসলিনের স্বচ্ছ ঘাগরা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা লম্বা হাতাওয়ালা চোলি পরতেন। আর সর্বাঙ্গে থাকত অজস্র গয়না। মোগল আমলে অজস্র নতুন ধরনের গয়নার চল শুরু হয়। তার কোনোটা পুরোনো গয়নার নতুন সংস্করণ, কোনোটা আবার একেবারে নতুন। পারসিদের মিনাকারী অলংকার এ সময় প্রচুর চোখে পড়ে। ছিল কুন্দনের কদর। সে সময় তাজ আর ঝাপটাও এসেছিল নতুন করে। মেয়েরা মাথায় পরতে শুরু করেন টায়রা, টিকলি, চেঙ্কি, শিসফুল, ছোটি আর মৌলি। কপালে পরতেন দমনি, কুটবি, তাওইট, চাঁদটিকা, ঝুমুর, গুছই, বারওয়াট ও বিন্দলি। এগুলো সবই কপাল অলংকরণের অলংকার। প্রাচীন ভারতীয় সাজসজ্জায় এসব একেবারেই ছিল না। মোগলরা এগুলো যোগ করেন। সে সময় কানেও ওঠে নানা রকম গয়না। গোসওয়াড়া, বাহাদুরি ঝুমকা, বারা, খুরিংদার, মছলিয়ান, পতং, তানদুর এবং মোর ফুনওয়ার। এমনকি এখন যে কানবালা, কানপাশা পরা হয়, তা-ও মোগল ঘরানার গয়না। নাকের অলংকার হিসেবে নতুনভাবে পাওয়া গেল নথ, বুলক, লটকান, লং, নোলক প্রভৃতি। মোগল হারেমের ছবিতে বড় নথ চোখে পড়ে না। নথ সবাই যে পরতেন, তা-ও নয়। স্বামীর সম্মান অনুযায়ী স্ত্রীর নথ পরার অধিকার জন্মাত। এমনকি রাজপরিবারের মেয়েরা ছাড়া কেউ পায়ে সোনার নূপুর বা অন্য গয়নাও পরতেন না। মাথায় মুকুট পরা নিয়েও ছিল বিধিনিষেধ। মোগল হারেমে আঁটসাঁট গলাবন্ধ জামা পরার চল ছিল বিধায় বিশেষ হার পরার সুযোগ ছিল না। তবু মুক্তার মালা, চিক ও গুলবন্ধের ব্যবহার দেখা যায়। হাতের গয়নায় মোগলদের বিশেষ সংযোজন মানতাশা আর রতনচূড়। রতনচূড় পরা হতো হাত আর হাতের পাঁচ আঙুল মিলিয়ে। খুব সুন্দর অলংকার। মূলত বাইজিদের জন্য তৈরি, কিন্তু রাজপুত ঘরানার ছাপ রয়েছে এতে। মোগল যুগের অলংকারে রাজস্থান আর গুজরাটের নারীদের অলংকারের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আবার তারাই মোগল অলংকারের অনুকরণ করেছেন অন্যদের চেয়ে বেশি। তাই এদের শিল্পরুচি অভিন্ন মনে হতে পারে। আসলে মোগল অন্তঃপুরের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে ছিল। কারণ, রাজপুত ললনারা মোগল হারেমে বেগম হয়ে প্রবেশ করতেন। অপরদিকে বেগম আর শাহজাদীদের সাজ ছিল সম্ভ্রান্তবংশীয় বধূ-বিবিদের অনুকরণীয়। মোগল যুগে আরীশ আর ছল্লা আঙুলের অলংকার হিসেবে পরিচিত ছিল। আকারে বড় এই আংটিগুলো পরা হতো তর্জনীতে। আরশিতে মুখ দেখাও চলত। অনেক সময় আংটির পাথরের নিচে লুকানো থাকত বিষ; পান করে মৃত্যুবরণের জন্য। বলা বাহুল্য, এসব আয়োজন ছিল রাজা আর রাজপরিবারের জন্য। প্রচলিত মতে সাধারণ মানুষের তো হঠাৎ আত্মহননের প্রয়োজন পড়ে না, তাই তাদের নাগালের বাইরেই থাকত এসব আংটি। কোমরের জন্য ছিল পাহজেব, বঞ্জর, জিঞ্জির ও ঘুংরু। আগেকার মেখলা, চন্দ্রহার ও কিঙ্গিনীই নাম বদল করল বলা চলে। পায়ে মল, ছানলা, চুটকি—এসব তো ছিলই। মোগল শাহজাদী অর্থাৎ রাজকুমারীরা ব্যবহার করতেন মুক্তার জালের চাদর। ওড়নার মতো সেই মুক্তার চাদর তাদের দুই কাঁধের দুপাশে ঝুলত।
আজ অবধি বিয়ের পোশাকে মোগল প্রবণতা প্রবল। সে সময়কার নয়নমোহন অলংকার থেকে শুরু করে নিখুঁত সূচিকর্ম, সূক্ষ্ম বুননের কারিগরি, মনোরম নকশা ও রং আর অভিজাত কাট-প্যাটার্নের পোশাকের কদর আজও রয়েছে, বিশেষ করে ব্রাইডাল ওয়্যার হিসেবে। জীবনের নতুন অধ্যায়ের শুভসূচনাকে আরও জমকালো করে তুলতে।
তথ্যসূত্র: আবরণে আভরণে ভারতীয় নারী: চিত্রা দেব
মডেল: আফসানা ও নিহাদ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: নাবিলা ও উমাব
ছবি: কৌশিক ইকবাল