বিশেষ ফিচার I ভুলবি কিরে হায়!
গ্ল্যামারের সঙ্গে ফ্যাশনের সম্পর্ক নিবিড়। ফলে রুপালি পর্দার সোনালি সময়ের ফ্যাশনই হয়ে ওঠে চিরকালীন। ডিজাইনাররা ফিরে যেতে চান গোল্ডেন এজ অব ফ্যাশনে। লিখেছেন ফারজানা ইউসুফ
গ্ল্যামারের সোনালি যুগ বলতে গেলে তাকাতে হয় এখন থেকে প্রায় শতবর্ষ আগে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটতে থাকে। দ্রুততার সঙ্গে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি তথা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ছোঁয়া লাগে জনজীবনের সর্বক্ষেত্রে। কুড়ির দশকে তাই ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষও ফ্যাশনেবল পোশাক-আশাক এবং নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের দিকে মনোযোগ দেয়। তাই এই সময়পর্বকে বলা হয় ফ্যাশনের ঊষালগ্ন। কুড়ির দশকে এর যাত্রা শুরু হলেও ফ্যাশন আর গ্ল্যামারের উৎকর্ষে পৌঁছতে বেশ চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আসতে হয়।
নতুন নতুন ধরনের কাপড় আর পোশাক তৈরির উপকরণ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পোশাক পরার ধরন-ধারণে চলে আসে আমূল পরিবর্তন। মহিলারা সানন্দে প্রথমবারের মতো করসেট আর বডি রেস্ট্রিকটিং পোশাক থেকে বেরিয়ে এসে স্কার্ট এবং ড্রেসে নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়িয়ে নেয়। ১৯২০ দশকের আগে বোতাম বা দড়ির শক্ত আঁটুনি ছাড়া পোশাক তৈরি ছিল অসম্ভব। হুক, জিপ, টিপ বোতামের মতো নতুন পোশাকের আনুষঙ্গিক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পোশাকের নকশা আর পরার স্টাইল- সবকিছুই বদলে যায়। নাইলন আর আর্টিফিশিয়াল সিল্ক আবিষ্কারের ফলে ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক তন্তু যেমন সুতি, রেশম এসবের পোশাক ছেড়ে নিত্যনতুন সব ড্রেস ম্যাটেরিয়ালে সবাই আগ্রহী হয়ে ওঠে। কুড়ির দশকে পোশাকের সিলুয়েট ছিল সোজাসাপ্টা, কোমরবন্ধনীর অনুপস্থিতি ছিল এ দশকের ফ্যাশনের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। কোকো শ্যানেল এ দশককে তার ‘বয় লুক’ আর বব ছাঁট চুলে এক স্বতন্ত্র অবয়ব দিয়েছে। ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজের মধ্যে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত ‘আর্ট নুভ’ স্টাইলের জুয়েলারি আর লম্বা রোপ চেইন বা পেঁচিয়ে পরা লম্বা মুক্তার মালা ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মেয়েদের পাদুকা সবার গোচরীভূত হয় এই দশকেই! এর আগে পোশাক এত লম্বা হতো যে মেয়েদের জুতা কারও নজরেই পড়ত না। এ দশকে যেখানে মেয়েদের পোশাকে এত পরিবর্তন, সেখানে পুরুষের পোশাক প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। ফরমাল লম্বা কোট আর স্যুট-হ্যাট ছিল বিগত বছরগুলোর মতো। পুরুষের পোশাকে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগে আরও অনেক পরে।
কুড়ির দশকের ‘ফ্ল্যাপার লুক’ ত্রিশের দশকে এসে কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। সোজাসাপ্টা শিলুয়েট বদলে ‘বডি শেপিং’। ড্রপিং ও শেপিংয়ের মাধ্যমে কাঁধ আর কোমর ঘিরে ফ্যাশন আবর্তিত হতে থাকে। মেয়েদের পোশাকে শক্তপোক্ত, ছড়ানো কাঁধ- কিছুটা পুরুষালি এই শিলুয়েট কর্মক্ষেত্র ও জীবনযাত্রায় নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ আর সামাজিক পরিবর্তনেরই ইঙ্গিতবহ। স্যুট বা ফরমাল জ্যাকেট এ সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় পোশাকে পরিণত হয়। বেটি ডেভিস, ক্যাথরিন হেপবার্ন আর মার্লিন দিয়াত্রিচের মতো অভিনেত্রীরা হলিউডের পর্দায় ঝড় তুললে সাধারণ ফ্যাশন-সচেতন মেয়েরাও এই ট্রেন্ডকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। কোকো শ্যানেলের কুড়ির দশকের সোজাসাপ্টা শিলুয়েটের পরিবর্তে ফ্যাশন, গ্ল্যামার আর কমনীয়তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ত্রিশের দশকের অন্তিমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই সমীকরণ পুরোপুরি পাল্টে যায়। পুরুষদের পোশাক যদিও তাদের ফরমাল হ্যাট-কোট আর জ্যাকেটে সীমাবদ্ধ থাকে, কিন্তু মেয়েদের পোশাকে স্কার্ট আর ড্রেসের আধিপত্য থাকে অপরিবর্তিত। পোশাকের আনুষঙ্গিক হিসেবে চামড়ার ও ফারের ব্যবহার ছিল সেকালের বিত্তবৈভবের পরিচায়ক।
চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন অর্থনৈতিক মন্দা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোকে প্রভাবিত করে। যুদ্ধের জের কেউ এড়াতে পারে না। কাপড়ের উৎপাদন কমে যায়, ফলে মেয়েদের স্কার্টের দৈর্ঘ্য কমে আসে। এমনকি যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের শার্ট কীভাবে মেয়েরা পরতে পারে, সেই অনুশীলনও চলতে থাকে। এ সময় মেয়েরা শিল্পকারখানায় কাজ শুরু করে। কঠিন বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রথমবারের মতো মেয়েদের মাঝে ট্রাউজার বা প্যান্ট পরার প্রচলন শুরু হয়। কর্মস্থলে মাথার পরিধেয় স্কার্ফ পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠে ফ্যাশন অ্যাকসেসরিজ। এ সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে জনজীবনে কষ্ট আর ভোগান্তি থাকলেও বাস্তবতা থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রায় সবাই সিনেমা হলে ঢুকতে শুরু করে। হলিউডের সিনেমা জগৎ তখন সাফল্যের তুঙ্গে। ফরাসি ডিজাইনাররা এ সময়কাল পর্যন্ত হলিউড তারকাদের নিত্যনতুন গ্ল্যামারাস পোশাকের রসদ জোগান। হলিউড তারকারা তাই সাধারণ মানুষের অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন। দিনে পরার পোশাকে তাই বাস্তবতার ছোঁয়া থাকলেও রাতের পোশাক বা ইভনিং ড্রেসে স্বপ্নিল, হলিউডি রোম্যান্টিকতার কমতি হয় না। সান্ধ্য কিংবা রাতের পোশাক আর সাজসজ্জা বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। হয়ে ওঠে মোহময়। সাধারণ মানুষের জীবনেও নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপনের বাসনা জাগে। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি থেকে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় নতুন এক ভোক্তাগোষ্ঠী, যারা ফ্যাশনেবল; নিত্যনতুন সাজপোশাকে নিজেদের সাজাতে আগ্রহী আর ফ্যাশন আইকনদের একনিষ্ঠ পূজারি। মেকআপ, কেশবিন্যাশ, ফ্যাশনে কেতাদুরস্ত এক শ্রেণির জন্ম নেয়, যারা পরবর্তী এক শ বছর ধরে ফ্যাশন জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করে। হলিউডে নতুন ধারার আমেরিকান কস্টিউম ডিজাইনাররাও পিছিয়ে থাকেননি। চল্লিশের দশকের গোড়া থেকেই তাদের নিজস্ব ধরন-ধারণের পোশাকের চর্চা ও প্রচলন হতে থাকে। উইজার্ড অব অজ, গন উইথ দ্য উইন্ডের মতো সাড়া জাগানো সব সিনেমায় তারকাদের আজানুলম্বিত চেক ড্রেস, কোমরে আঁটসাঁট আর ফুলানো ছোট হাতা তৎকালীন ফ্যাশন ম্যাগাজিন উইমেন্সওয়্যার ডেইলি, হার্পারস বাজার আর ভোগ-এর মতো ফ্যাশন পত্রিকাগুলোর রসদ হয়ে ওঠে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের ‘ফ্যাশনেবল’ হওয়ার ধুম পড়ে যায়।
এদিকে ফ্যাশনের এই ঢেউ ভারতীয় উপমহাদেশেও আছড়ে পড়ে। স্বাধীনতার আগে ইউরোপীয় ফ্যাশনে ভারতীয় অভিজাত মহিলারা প্যারিস থেকে তাদের নিত্যনতুন শাড়ি, গয়না সংগ্রহ করতেন। ব্রিটিশ আর ইউরোপীয় শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই সময়কার রাজপুত রানি ও রাজকন্যারা তাই ‘কার্টিয়ের’-এর গয়না, ফ্রেঞ্চ শিফন আর লেইসের শাড়িতে নিজেদের সাজাতেন। সাতচল্লিশ-পরবর্তী বলিউড তারকারা এঁদের স্থান দখল করে নেন। সিনেমাপাগল ভারতীয়দের কাছে নার্গিস, মধুবালা, মীনা কুমারী, গুরু দত্ত, দেব আনন্দ-এর মতো তারকারা ফ্যাশন আইকনে পরিণত হন। রুপালি পর্দায় উত্তম-সুচিত্রার পোশাক, এমনকি বাচনভঙ্গি বাঙালি তরুণ-তরুণীদের পরবর্তী কয়েক দশক আচ্ছন্ন করে রাখে!
পরবর্তী দশকটি ফ্যাশনের সেরা এক কালপর্ব হিসেবে চিহ্নিত হলেও এর শুরু চল্লিশের শেষের দিকেই। ১৯৪৭-এ ফরাসি ফ্যাশন ডিজাইনার ক্রিস্তিয়ঁ দিওরের ‘নিউ লুক’ পরবর্তী এক দশকের বেশি সময়ে সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ফ্যাশন লুক হিসেবে পরিগণিত হয়। পঞ্চাশের দশকটি ফ্যাশনে নতুন আর পুরোনো অনেক রীতিরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। দিওরের এই নতুন শিলুয়েট কোমর আঁটা বড় ঘেরের ফুল স্কার্ট যেমন সবার নজর কাড়ে, তেমনি কুড়ির দশকের মতো কোমরে বন্ধনহীন, এক ছাঁটের সোজা পোশাকের ধরনে অনেকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। এই দশকেই ব্রিজিত বার্দো, মেরিলিন মনরো আর অড্রে হেপবার্নের মতো তারকারা ফ্যাশন জগৎকে বৈপ্লবিকভাবে বদলে দেন। ১৯৫৩ সালে মেরিলিন মনরো রুপালি পর্দায় ঝড় তোলেন। ‘সেক্স সিম্বল’ শব্দটি প্রথমবারের মতো পরিপূর্ণ অর্থসহ দর্শকদের কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে তারই গুণে। পঞ্চাশের দশকের হলিউড ফিল্ম সম্পর্কে বলতে গেলে আলফ্রেড হিচককের কথা না বললেই নয়। তাঁর ছবিতে ফ্যাশন দুরস্ত তারকারা আলোড়ন সৃষ্টি করে। গ্রেস কেলি অভিনীত ‘টু ক্যাচ আ থিফ’ সিনেমায় একটি দামি হাতব্যাগ ব্যবহার করলে পরবর্তীকালে তা ‘কেলি ব্যাগ’ নামে চালু হয়ে যায়। এদিকে ব্রিজিত বার্দো ১৯৫৩ তে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সময় টু পিস বিকিনি পরে দক্ষিণ ফ্রান্সের সমুদ্রতটে আবির্ভূত হলে তাকে ‘ফ্যাশন বম্বশেল’ আখ্যা দেওয়া হয়। সাঁতারের পোশাক হিসেবে বিকিনিকে সবার কাছে সমাদৃত ও গ্রহণযোগ্য করার পেছনে মিস বার্দোর এই অবদান অনস্বীকার্য।
পঞ্চাশের দশক উজ্জ্বল রোদেলা দিনের মতোই সতেজ, প্রাণবন্ত, গ্ল্যামারাস। তার রং-বেরঙের প্রিন্ট আর বাড়াবাড়ি রকমের আঁটসাঁট কোমর, ছড়ানো কাঁধ আর ফোলানো ফুল স্কার্ট। তবে পঞ্চাশের দশকে ফোলানো স্কার্টের যেমন প্রচলন ছিল, তেমনি লম্বা পেন্সিল স্কার্টও ছিল জনপ্রিয়। ছেলেদের ফ্যাশনে জেমস ডিন, মার্লোন ব্রান্ডো, এলভিস প্রিসলি, ফ্রাঙ্ক সিনাত্রারা পুরো দশকজুড়েই ‘ক্লিন কাট লুক’-এ সবাইকে বিমোহিত করেছেন। পঞ্চাশের দশক পুরুষের ফ্যাশনের মূলধারাকে উপস্থাপন করে, যা আজও ছেলেদের পোশাকের মূলমন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হয়। এসব ফ্যাশন আইকন এখনো ফ্যাশন জগতে অবিরাম অনুপ্রেরণা জুগিয়ে চলেছেন।
ফ্যাশনে সৃষ্টিশীলতার জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্তের খোঁজে আজও ডিজাইনার, স্টাইলিস্ট ও তারকারা ফিরে যেতে চান পঞ্চাশের দশকে। এখনো তাই গ্রেস কেলির বিয়ের পোশাকের আদলে তৈরি হয় যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিয়ের পোশাক। ডিটা ভন টিসের মতো সেলিব্রিটিরা ফিফটিজ ফ্যাশন আর গ্ল্যামারকে অনুসরণ করে নিজেকে ফ্যাশন আইকন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। শুধু তা-ই নয়, নিজস্ব এই ‘রেট্রো লুক’-এর আদলে গড়ে তুলেছেন ফ্যাশন ব্র্যান্ডও। এবং তা সফল। বর্তমানেও পঞ্চাশের দশকের এই লুক দাপটের সঙ্গে ফ্যাশন জগতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। ফ্যাশন ‘গালা’ আর ‘রেড কার্পেট ইভেন্ট’গুলোতে তাই তারকারা সেকালের গ্ল্যামার আর ক্ল্যাসিক লুকেই স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এই রেট্রো ফ্যাশন স্টাইল এখন একটি নতুনধারা হিসেবে মোটামুটি পাকাপোক্ত স্থান করে নিয়েছে। আর তাই পঞ্চাশের স্বর্ণালি দিনগুলো শুধু আজ নয়, বরং অনাগত আগামীতেও ফ্যাশন আর গ্ল্যামার জগৎকে অনুপ্রাণিত করবে বলেই ফ্যাশন বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
ছবি: সংগ্রহ