দেহযতন I ধ্যান-ধন্য
মেডিটেশন বা ধ্যান। মানসিক চাপ দূর করার পাশাপাশি মনে প্রশান্তি আনার বিশেষ শরীরচর্চা। রয়েছে আরও অনেক উপকার
যদি মানসিক চাপের কারণে আপনি উদ্বিগ্ন ও বিষাদগ্রস্ত হয়ে থাকেন, নিতে পারেন ধ্যানের আশ্রয়। এমনকি ধ্যানে কয়েক মিনিট ব্যয় করলে শান্ত ভাব ও প্রশান্তি পুনরুদ্ধার করতে পারবেন। ধ্যানচর্চা করতে পারেন যে কেউ। এটি করা যেমন সহজ, তেমনি ব্যয়সাপেক্ষ নয়। বিশেষ কোনো সরঞ্জামেরও নেই প্রয়োজন। আপনি হাঁটার জন্য বাইরে আছেন, বাসে চড়েছেন, ডাক্তারের জন্য অপেক্ষা করছেন কিংবা রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়িক মিটিংয়ের বিরতিতে—সবখানেই সব সময় ধ্যান অনুশীলন করা সম্ভব।
হাজার বছর ধরে চলে আসছে মেডিটেশনের অনুশীলন। এটি মূলত জীবনের পবিত্র ও রহস্যময় বিষয় গভীরভাবে অনুধাবন করতে সাহায্য করে। আজকাল ধ্যান সাধারণত শিথিলকরণ ও মানসিক চাপ কমানোর ক্ষেত্রে অনুশীলন করা হয়। ধ্যানকে মনে করা হয় মন ও শরীরের পরিপূরক ওষুধ। ধ্যানের সময় একজন মানুষ তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করেন এবং মনোজগৎকে আক্রান্ত করা এলোমেলো চিন্তাগুলোকে দূরে সরিয়ে দেন। এই প্রক্রিয়ায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে। সাহায্য করে কোনো কিছুতে ফোকাস করতে এবং স্ট্রেস সামাল দিতে। পাশাপাশি কিছু মেডিকেল কমপ্লিকেশন কমাতেও কাজে দেয়।
ইন্টারন্যশনাল সার্টিফাইড ইয়োগা অ্যান্ড মেডিটেশন কোচ এবং নাতজেন ইয়োগার প্রতিষ্ঠাতা নাতাশা সানজিদা বলেন, ‘আপনি যখন ধ্যান করেন, তখন যেসব তথ্য মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে, সেগুলো অনেকাংশে কমে যায়। ধ্যানের মানসিক ও শারীরিক সুবিধাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—মানসিক চাপ থেকে বের হয়ে এসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন, মানসিক চাপ কীভাবে কমানো যায় সেই সক্ষমতা তৈরি, আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি, বর্তমানের দিকে মনোনিবেশ বৃদ্ধি, নেতিবাচক আবেগ হ্রাস, কল্পনাশক্তি ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি, ধৈর্য ও সহনশীলতা বৃদ্ধি, হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিককরণ, রক্তচাপ কমানো এবং মানসম্পন্ন ঘুমের নিশ্চয়তা প্রদান।’
নাতাশা আরও জানান, মানসিক চাপের কারণে কারও যদি কোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যার অবনতি হওয়ার ঝুঁকি থাকে, তাহলে ধ্যান হতে পারে দারুণ সহায়ক এক পন্থা। যেমন দুশ্চিন্তা, হাঁপানি, ক্যানসার, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা, বিষণ্নতা, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, পেটের সমস্যা, ঘুমের সমস্যা, টেনশন থেকে সৃষ্ট মাথাব্যথা ইত্যাদি। তবে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে নিজের চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কেননা, কিছু বিরল ক্ষেত্রে, ধ্যানের কারণে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার আরও অবনতি হওয়ার নজির রয়েছে। তা ছাড়া ধ্যান কোনো ঐতিহ্যগত ও প্রচলিত চিকিৎসার বিকল্প নয়। তবে এটি আপনার অন্যান্য চিকিৎসার জন্য একটি দরকারি সংযোজন হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।
নাতাশার মতে, মেডিটেশন হলো একটি ছাতার মতো, যার অধীনে রয়েছে নানা উপায়। অনেক ধরনের ধ্যান ও শিথিলকরণ কৌশলে রয়েছে ধ্যানের উপাদান। আর সব কটির লক্ষ্যই মানসিক প্রশান্তি অর্জন। চলুন, এমন কয়েকটি উপায়ের ওপর বোলানো যাক নজর:
গাইডেড মেডিটেশন: একে কখনো কখনো গাইডেড ইমাজিনারি বা ভিজ্যুয়ালাইজেশনও বলা হয়। ধ্যানের এই পদ্ধতির সাহায্যে আপনি এমন স্থান বা পরিস্থিতিগুলো কল্পনা করবেন, যেগুলো আপনাকে স্বস্তি দেয়। যতটা সম্ভব ঘ্রাণ, দৃশ্য, শব্দ ও টেক্সচার অনুভব করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিকে কোনো পেশাদার গাইডের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন।
মন্ত্র মেডিটেশন: এ ধরনের ধ্যানের মাধ্যমে বিক্ষিপ্ত চিন্তাভাবনা দূর করতে শান্তভাবে কিছু শব্দ বা বাক্যাংশ পুনরাবৃত্তি করুন
মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন: মননশীল হওয়া বা বর্তমান মুহূর্তে বেঁচে থাকার সচেতনতা ও গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে এটি। মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশনে আত্মসচেতনতা বাড়ানো সম্ভব। ধ্যানের সময় আপনি যা অনুভব করেন, তার ওপর ফোকাস করা চাই; যেমন নিজের শ্বাস প্রবাহ। এর মাধ্যমে চিন্তাভাবনা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
চি গাং: এই অনুশীলন সাধারণত ভারসাম্য পুনরুদ্ধার ও বজায় রাখতে ধ্যান, শিথিলকরণ, শারীরিক মুভমেন্ট ও শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়ামকে একত্র করে। এটি একটি ঐতিহ্যগত চীনা চিকিৎসাপদ্ধতির অন্তর্গত।
ট্রানসেনডেন্টাল মেডিটেশন: একটি সহজ ও প্রাকৃতিক কৌশল। এ ধরনের ধ্যানে আপনি নিঃশব্দে একটি ব্যক্তিগতভাবে নির্ধারিত মন্ত্র, যেমন কোনো শব্দ বা বাক্যাংশ নির্দিষ্ট উপায়ে পুনরাবৃত্তি করুন। এই ধ্যান আপনার শরীরকে গভীর বিশ্রাম নিতে এবং শিথিলতার অবস্থায় স্থির হতে সাহায্য করবে। এ ছাড়া আপনার মনে একাগ্রতা এনে মানসিক প্রশান্তি পেতে কাজে দেবে।
ইয়োগা: ইয়োগা হলো শরীর, মন ও আত্মার সংযোগ। এটি বিভিন্ন ভঙ্গি নিয়ে গঠিত। এই ভঙ্গি বা আসনগুলোর প্রতিটি আসলে আমাদের ধ্যানের জন্য প্রস্তুত করে। কিছু আসন আমাদের এনার্জি তৈরি করতে সাহায্য করে, আবার কিছু নমনীয়তা বাড়ানোর জন্য উপকারী। বাকি ভঙ্গিগুলো কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করে। যোগব্যায়ামের কিছু ভঙ্গি আমাদের অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলোকে ডিটক্সিফাই করতেও কাজে দেয়।
‘আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যোগ আসনগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যেন মন ও দেহকে স্থিরভাবে বসানোর শক্তি ও নমনীয়তা পাওয়া যায়,’ অভিমত নাতাশা সানজিদার। তিনি আরও জানান, স্থির থাকলে বাড়তি দুশ্চিতা কমে এবং ‘এই আসনগুলো আপনাকে সেই স্থিরতা অর্জন করতে সাহায্য করবে।’
নাতাশা বলেন, ধ্যান করতে সাহায্য করার জন্য এ-বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। আপনি কার নির্দেশিকা অনুসরণ করেন কিংবা কে আপনাকে শেখাচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করে এগুলোতে আসতে পারে সংযোজন, বিয়োজন বা পরিবর্তন। ধ্যানের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে:
মনোযোগ: মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা সাধারণত ধ্যানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মনকে স্ট্রেস ও উদ্বেগ তৈরিকারী নানা বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। নির্দিষ্ট বস্তু, চিত্র, মন্ত্র, এমনকি শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো বিষয়গুলো মনোযোগ কেন্দ্রীভূতকরণে ভূমিকা রাখতে পারে।
আরামদায়ক শ্বাস-প্রশ্বাস: সমান গতির শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার এই কৌশল আপনার ফুসফুসকে প্রসারিত এবং ডায়াফ্রাম পেশিকে সক্রিয় করে। এর উদ্দেশ্য, শ্বাস-প্রশ্বাস ধীর করা, আরও অক্সিজেন গ্রহণ করা এবং শ্বাস নেওয়ার সময় কাঁধ, ঘাড় ও বুকের ওপরের দিকের পেশিগুলোর ব্যবহার কমানো, যেন আপনি আরও স্বচ্ছন্দে শ্বাস নিতে পারেন।
শান্ত পরিবেশ: ধ্যানে শিক্ষানবিশ হয়ে থাকলে আপনি টেলিভিশন, রেডিও অথবা সেলফোনের মতো ডিভাইস দূরে রেখে, শান্ত জায়গায় অনুশীলন করলে কাজটি আপনার পক্ষে তুলনামূলক সহজ হতে পারে। অবশ্য মেডিটেশনে আরও দক্ষ হয়ে উঠলে ট্রাফিক জ্যাম, মিটিং, সুপারশপের দীর্ঘ লাইন—যেকোনো জায়গায় যেকোনো মুহূর্তে এর চর্চা করতে পারবেন।
আরামদায়ক অবস্থান: শুয়ে, বসে কিংবা দাঁড়িয়ে—যেকোনোভাবেই ধ্যানচর্চা করা সম্ভব। শুধু আরামবোধ করার চেষ্টা করুন, যেন আপনি আপনার ধ্যান থেকে সর্বাধিক সুবিধা পেতে পারেন।
উদার মনোভাব: ধ্যানে বসে জাজমেন্টাল না হয়ে বরং নিজেকে পরিণত করতে হবে উদারমনা ব্যক্তিত্বে। তাহলে সুফল মেলার সম্ভাবনা বাড়বে।
ধ্যান আপনার জীবনে বয়ে আনতে পারে এক অতুলনীয় সুফল। তবে মন-মর্জিমতো নয়; নিয়ম মেনে ধ্যান করা চাই। প্রয়োজনের যোগাযোগ রাখা চাই কোনো বিশেষজ্ঞের সঙ্গে।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: ইন্টারনেট