ছুটিরঘণ্টা I মাসাই মিথ
আফ্রিকান ঐতিহ্যবাহী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মাসাই সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশের বাস কেনিয়ায়। নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার জন্য তারা বরাবরই কৌতূহলের কেন্দ্রে। অনেকের কাছে তা রূপকথা আর মিথের মতো। তাদের পল্লিতে ঘুরে এসে গল্প শোনাচ্ছেন এলিজা বিনতে এলাহী
নাইরোবি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ভোর পাঁচটায় নেমেই মোম্বাসা শহরের উদ্দেশে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ধরেছি। মোম্বাসা ঘুরে আবার এসেছি নাইরোবিতে। কেনিয়ার এই রাজধানীতে পৌঁছে সকাল সকাল রওনা করেছি মাসাইমারার উদ্দেশে। পথে যেতে যেতে আজকের পরিকল্পনা জানালেন গাইড জিসুকি। পথে কোথাও মধ্যাহ্নভোজ সেরে নেব। রাতে থাকার স্থান ঠিক হয়েছে নিভৃত এক পল্লিতে। কিছুটা তাঁবুবাসের মতো। সেখানে বাক্সপেটরা রেখে যাব আদিবাসী মাসাই পল্লিতে।
আমার চোখে কিছুটা ঘুম লেগে আছে। কারণ, কেনিয়ায় পা ফেলা অবধি ছুটছি। নাইরোবি শহর পেরিয়ে সবুজের আধিক্য চোখে পড়তেই অবাক হয়ে ভাবলাম, এই ভূখণ্ডকে কেন অন্ধকারাচ্ছন্ন বলা হতো। লিখিত দলিল ও সঠিক তথ্য-উপাত্ত না থাকায় ভূখণ্ডটির প্রাচীন জনগোষ্ঠীর অভিবাসন সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য মেলে না। মাসাই সম্প্রদায় সম্পর্কে আগ্রহ থেকে জিসুকির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, কেনিয়ায় ঠিক কতগুলো জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তিনি সঠিক করে বলতে পারেননি। জানালেন, ৪০ থেকে ৪৫টি। এসব আলাপ চলাকালেই খেয়াল করলাম, আচমকা গাড়ির গতি ধীর করে দিয়েছেন জিসুকি। বললেন, ‘ওই যে দেখুন, বেবুন।’ রাস্তার দুপাশে সারি ধরে বসে আছে বানরগোত্রের ওই স্তন্যপায়ী প্রাণীর দল। জিসুকি জানালেন, খাবারের খোঁজে বেরিয়েছে ওরা। সত্যি দেখলাম, গাড়ির দিকে অপলক তাকিয়ে রয়েছে বেবুনগুলো। আমিও সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিলাম। ওদের দেওয়ার মতো খাবার আমাদের গাড়িতে ছিল না বলে একটু মন খারাপ হলো। যেতে যেতে আরও চোখে পড়ল জেব্রার দল। এত কাছ থেকে জেব্রার ডোরাকাটা দেহ আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছিল, আসলেই কোনো শিল্পী যেন নিখুঁতভাবে এঁকে রেখেছেন এই দাগগুলো। জেব্রাগুলো তখন আপনমনে ঘাস চিবুচ্ছে। এই না হলে আফ্রিকা! যেখানে প্রাণী, উদ্ভিদ আর মানুষের মিতালি।
ঘন বনের পথ পেরিয়ে গাড়ি এলো কিছুটা পাহাড়ি রাস্তায়। চারদিকে উপত্যকা আর পথের পাশে দেখলাম স্যুভেনির দোকানে ঝুলছে ভেড়ার চামড়ার চাদর, কোট ও টুপি। বোঝা গেল, এই অঞ্চলে ভেড়ার আধিক্য রয়েছে আর অপেক্ষাকৃত শীতাঞ্চল। কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার জন্য থামলাম স্যুভেনির দোকানগুলোর সামনে। পাহাড়ি পথটি দেখিয়ে জিসুকি জানালেন, এই রাস্তা বিশ শতকে তৈরি হয়েছে ইতালির প্রকৌশলী আর শ্রমিক দলের হাতে। পথের পাশেই একটি গির্জা; ইতালির অধিবাসীদের উপাসনা করার তাগিদ থেকেই। ১৯৪৫/৪৬ সালের দিকে নির্মিত।
পাহাড়ি পথ পেরিয়ে তারপর এলাম বিস্তীর্ণ খোলা এক প্রান্তরে। দূরে দেখা যাচ্ছে পাহাড়গুলো। ভাবলাম, মাসাই অঞ্চল না জানি কেমন হবে! পথ এগোতে এগোতে তো দেখলাম ৬০-৭০ কিলোমিটার পর পর পরিবেশের নাটকীয় পরিবর্তন। নাইরোবি থেকে মাসাই রাজ্যে যাবার পথ প্রায় ২২০ কিলোমিটার। কাঙ্ক্ষিত স্থানে যখন পৌঁছলাম, ততক্ষণে দুপুর পেরিয়ে গেছে। মূল রাস্তা ছেড়ে এবার আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথ ধরলেন জিসুকি। মনে হলো, লোকালয় ফেলে গহিন থেকে গহিনতর পরিবেশে প্রবেশ করছি। এভাবে তিন-চার কিলোমিটার চলার পর এসে থামলাম জিঅ্যান্ডজি ক্যাম্পের সামনে। চারদিকে কোনো জনমানবের দেখা নেই। দূরে নারকেল পাতায় ছাওয়া দু-একটি মাটির বাড়ি চোখে পড়ল শুধু।
ক্যাম্প-সাইটে বাক্সপেটরা রেখে তখনই রওনা দিলাম মাসাই পল্লি দেখতে। আমরা রয়েছি মাসাইমারা অঞ্চলের স্যাকানানি এলাকার একটি মাসাই গ্রামে। সেখানে প্রবেশ করতেই হাতে লাঠি আর চেক প্রিন্টের রঙিন চাদর গায়ে জড়ানো এক যুবক এগিয়ে এলেন। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে, হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘মাই নেম ইজ ওবিলিও…ওয়েলকাম টু আওয়ার ভিলেজ।’ এত পরিষ্কার ইংরেজি শুনে আমি অভিভূত। কেনিয়াজুড়ে দেখেছি, সবাই ইংরেজি জানে। পথের পাশের সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে গ্রামের নারীরাও। আসলে এখানে এত ভাষাভাষীর সম্প্রদায় রয়েছে, এক গ্রামের ভাষা পাশের গ্রামের সম্প্রদায় বলতে পারে না। তাই ইংরেজি এদের যোগাযোগের কমন মাধ্যম। অবশ্য একুশ শতকের আগে এসব অঞ্চলের চিত্র কেমন ছিল, জানি না। ২০২৩ সালে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই বিষয়টি বয়ান করলাম।
যাহোক, ওবিলিও ও জিসুকি নিজেদের ভাষায় কী যেন বললেন। তারপর একদল নারী-পুরুষ, দারুণ সব পোশাক পরিহিত অবস্থায় এসে ঘিরে ধরল আমাকে। ওবিলিও বললেন, ‘এলিজা, এখন আমরা তোমাদের জন্য স্বাগত সংগীত আর নাচ পরিবেশন করব।’ পাঁচ-সাত মিনিট ধরে চলল সেই গান আর নাচ। শেষ হওয়ার পর আমাকে অন্য একটি নাচে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানাল দলটি। নাচটিকে তারা বলছিল জাম্পিং ড্যান্স। যদিও সেটি পুরুষদের জন্য। প্রেমিকা অর্জনের জন্য দিতে হয় এই লম্ফ। যে যত উঁচুতে লাফিয়ে উঠতে পারবে, সে তত বেশিসংখ্যক প্রেমিকার দাবি তুলতে পারবে। এই লম্ফ নৃত্যকে মাসাই ভাষায় বলে আডুমু। সেই নাচ শেষে ওবিলিও আমাকে নিয়ে গেলেন তাদের গ্রামের ভেতর।
গ্রামটির চারপাশ ক্রাল (বেড়াবিশেষ) দিয়ে ঘেরা। স্থানীয় একধরনের ঝোপজাতীয় কাঁটা গাছকে ঘনভাবে বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রামের মানুষ নিজেদের ও গবাদিপশুকে বিভিন্ন ধরনের হিংস্র প্রাণী, বিশেষত সিংহ, লেপার্ড, চিতার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ক্রাল তৈরি করে। সেটি পেরিয়ে, একটি গোল বৃত্তের মাঝে প্রবেশ করলাম। চারদিকে মাটির বাড়ি। ওবিলিও জানালেন, বেড়া দেওয়ার দায়িত্ব ছেলেরাই সামলায়, আর তাদের ঘরগুলো তৈরি করে নারীরা। এদের ঘরের আকৃতি আয়তাকার, তবে সব ঘর মিলে একটি বৃত্তের আকার নেয়। এই ঘরগুলোকে বলে মাইয়াটা। গাছের ডাল দিয়ে চাটাইয়ের মতো দেয়াল তৈরি করে তার ওপর কাদামাটি, গোবর ও কাঠের ছাইয়ের মিশ্রণ ধাপে ধাপে প্রলেপ দেওয়ার পর প্রস্তুত হয় একেকটি জলনিরোধক ঘর। একটি ঘর নির্মাণ সম্পন্ন করতে লেগে যায় প্রায় তিন মাস। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে থাকে একটি ছোট রান্নাঘর; আর শিকার করা কাঁচা মাংস সংরক্ষণের জন্য একটি ভান্ডারঘর। সহজ করে বললে স্টোর রুম। মাসাই ভাষায় বলে এনকাজি। প্রতিটি ঘরে থাকে একটি ছোট দরজা। জানালা হিসেবে ব্যবহার করা হয় একটি করে খুব ছোট গোলাকার ছিদ্র।
ওবিলিও এ রকম কয়েকটি ঘরে নিয়ে আমাকে দেখালেন সেগুলোর অন্দরমহল। উঠানের একধারে চোখে পড়ল গবাদিপশুগুলোকে রাতে নিরাপদে রাখার জন্য কাঁটা গাছের ডাল দিয়ে ঘেরা গোলাকার গোয়ালঘর। গ্রামের সবার গবাদিপশু একই স্থানে থাকে। রাতে ওদের পাহারা দেয় কুকুর। গবাদিপশুর সংখ্যার ভিত্তিতে সাধারণত এদের ধনী-দরিদ্রের মাপকাঠি নির্ধারিত হয়। মাসাই পুরুষেরা বিয়ের সময় কনের বাড়িতে যৌতুক হিসেবে দান করে গবাদিপশু। বহুবিবাহ এই সমাজে প্রচলিত একটি বিষয় এবং সমাজস্বীকৃত। জানা গেল, ওবিলিওর বাবা বিয়ে করেছেন ছয়টি; তার সন্তান ৫৪ জন। তাদের সন্তান, নাতিপুতি আর পরিজন নিয়েই গড়ে উঠেছে এই গ্রাম।
ওবিলিওর সঙ্গে কথা বলতে বলতে চারদিকে যত মাসাই নারী-পুরুষ চোখে পড়ছিল, প্রায় সবাই বেশ লম্বা ও ছিপছিপে গড়নের। এই জনগোষ্ঠী ভীষণ উজ্জ্বল ও রঙিন পোশাক পরে। একটি রঙিন থান প্যাঁচ দিয়ে ব্যবহার করে। তবে নারীদের এই প্যাঁচের রয়েছে ভিন্নতা। পুরুষদের ধরনকে কিকি আর নারীদের ধরনকে কাঙ্গা বলে। পোশাকের প্রতিটি রংই বহন করে পৃথক অর্থ। লাল রং এদের কাছে বিশেষ গুরুত্ববহ। এ রঙের প্রতি আকর্ষণ এবং একে প্রাধান্য দেওয়ার কারণ, লাল রং যোদ্ধার প্রতীক। মাসাইরা মনে করে, উজ্জ্বল লাল রং সিংহদের ভয় দেখাতে কাজে দেয়। নারী-পুরুষ—সবাই ব্যবহার করে রঙিন গয়না। হাতে কাঠের ও পুঁতির গয়না পরতে দেখা যায়। মাসাইদের কানের লতির অংশটি কাটা থাকে; তবে সবার নয়। এই সম্প্রদায়ের কাছে এটিও একটি প্রথা, যা দেখে সহজেই তাদের শনাক্ত করা যায়। দলপতির মুকুট সিংহের চামড়া দিয়ে বানানো। গ্রামে প্রবেশের আগেই সেই মুকুট আমাকে দেখিয়েছেন ওবিলিও। মুকুট পরে আমি ছবিও তুলেছি!
ওবিলিওর সঙ্গে গ্রামের উঠোনে দাঁড়িয়ে এই সব গল্প চলছিল। একপর্যায়ে জানতে চাইলাম ওদের খাদ্যাভ্যাসের কথা। জানালেন, মাসাইদের প্রিয় খাবার মাংস। তবে খুব অল্পসংখ্যক মাসাইয়ের মধ্যে প্রধান খাদ্য হিসেবে শাকসবজির চল রয়েছে। অবশ্য গরু, মহিষ ও ছাগলের দুধ রয়েছে তাদের সবারই পছন্দের খাদ্যতালিকায়। বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষে গৃহপালিত প্রাণীদের রক্ত পান করারও রেওয়াজ রয়েছে। তারা মনে করে, রক্তপান তাদের শারীরিক শক্তিবর্ধনে কাজে দেয়। তাই অসুস্থ হলে কিংবা নারীরা সন্তান জন্মদানের পরে রক্তপান করে।
আগুন জ্বালানোর জন্য দেশলাই ব্যবহার করে মাসাই সম্প্রদায়। সে জন্য অ্যাকাশিয়া ও অলিভ গাছের ডাল থেকে বিশেষ আকৃতির ড্রিল তৈরি করে নেয়, যার মধ্য থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে বারবার ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন হয় আগুন। পাথরে পাথর ঘষে আগুন জ্বালাবার গল্প কতই পড়েছি ও শুনেছি, এ তার আরেক ধরনের উদাহরণ। ওবিলিও এবং চারজন মাসাই মিলে এই পদ্ধতি উঠোনে বসেই আমাদের দেখালেন। জানা গেল, মাসাই সম্প্রদায় দিনের শেষে নাচ-গান করে বিশ্রামে যায়। বাইসনের শিংয়ে তৈরি শিঙা এদের প্রধান বাদ্যযন্ত্র।
সূর্য যখন পশ্চিমে হেলে পড়ছে, আমাদের মাসাই পল্লি ভ্রমণের সময় ফুরিয়ে এলো। ফেরার কালে সংক্ষেপে মাসাই সম্প্রদায়ের ইতিহাস জানতে চেয়েছিলাম ওবিলিওর কাছে। জানালেন, কেনিয়া ও তানজানিয়ার বিশাল অংশজুড়ে তাদের বসবাস। এই সম্প্রদায়ের উৎপত্তি কবে, তা নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব। ইতিহাস বলছে, মাসাইরা আগে বাস করত দক্ষিণ সুদানে। ষোড়শ শতাব্দীতে উর্বর জমির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে তারা বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থানে পৌঁছায় অষ্টাদশ কিংবা ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে। তাদের জীবনধারণ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ঘরবাড়ি, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশুর প্রচলন, গানবাজনা, ধর্মবিশ্বাস এবং এদের ভেতরের প্রচলিত মিথ—সবই মাসাই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত এবং ভীষণ স্বতন্ত্র!
ফেরার পথে ওবিলিও নিয়ে গেলেন তাদের গ্রামের স্যুভেনির দোকানগুলো দেখাতে। গ্রামের নারী-পুরুষেরা মিলে তৈরি করে এসব দোকানের সব জিনিসপত্র। প্রতিটি দোকান এত রঙিন! পছন্দমতো অল্প কয়েকটি মাসাই গয়না কিনে নিলাম, স্মারক হিসেবে। গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাদের বিদায় দিলেন ওবিলিও।
ক্যাম্পে ফিরছি, কিন্তু মন রয়ে গেছে মাসাই পল্লিতে। জিসুকির কথায় বর্তমানে ফিরে এলাম। পরের দিনের গন্তব্য মাসাইমারা ন্যাশনাল পার্ক। সেই গল্প অন্য কোনো দিন; হয়তো অন্য কোথাও!
ছবি: লেখক