মনোযতন I আত্মপীড়নের প্রেত
সেলফ হার্ম বা আত্মপীড়ন। সরাসরি মানসিক ব্যাধি না হলেও ভয়ানক প্রবণতা। এ থেকে মুক্তির উপায় জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা
এই যে শীত তাড়িয়ে নিচ্ছে আমাদের। দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে শৈশবের নস্টালজিক এক নদীর পাড়ে। যেখানে বসে আনমনা হয়ে আছেন আপনি। স্মৃতিকাতরতা কিংবা স্মৃতিমেদুরতা আপনার দৃষ্টি স্থির করে দিয়েছে নদীর টলটলে জলে। দেখছেন কোনো রোগা হাঁসের ডুবসাঁতার। অথচ এই হাঁসের গায়েও ২৫ হাজার পালক। যেসব পালক দেহরক্ষীর মতো তার শরীরের নিরাপত্তা দিচ্ছে। কিন্তু একটা মনে কটা পালক থাকে? বলবেন, একটাও না! তবু মন আমাদের কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে এগিয়ে নেয়। কিন্তু এই ভোকাট্টা মন মাঝেমধ্যে মানে না শাসন-বারণ। যা ইচ্ছা করে যায়। আর টিনএজারদের মন তো আরও উড়াধুরা! এই দেড়েল মন কখন কী চেয়ে বসে, তা দক্ষ জ্যোতিষীর পক্ষেও বলা মুশকিল!
এই যে প্রবাহিত হচ্ছে শরীর, প্রবহমান মন, তা মাঝেমধ্যে সরলরেখায় না গিয়ে এগোয় বক্ররেখা হয়ে। আপনি বুঝতেও পারেন না, কী দক্ষতার সঙ্গে মন আপনাকে ফাঁকি দিয়ে আগায় সে পথে! মনের এই দক্ষতা আর আপনার লাইনচ্যুত এই কিঞ্চিৎ অদক্ষতাকে পুঁজি বানিয়ে একসময় মনই আপনাকে চোখ রাঙায়। নিজেকে নিজের কাছে অনিরাপদ করে তোলে। মাঝে দাঁড় করিয়ে দেয় দূরত্বের দেয়াল। সেই দেয়াল আপনাকে শেখায় নানান ছুতোয় নিজের ক্ষতি করতে। আপনি তখন শরীরের বিভিন্ন স্থান ধারালো কিছু দিয়ে কেটে রক্তাক্ত করেন। কিংবা দীর্ঘদিন গর্ব করা নিজের চুলেই কাঁচি চালিয়ে দেন। নিজেকে আহত করা আপনার অভ্যাসে দাঁড়ায়। পরিবার, দাম্পত্য জীবন কিংবা প্রেমের সম্পর্কে সামান্য মানসিক আঘাত পেলে অথবা কোনো আকাঙ্ক্ষা পূরণ না হলে কিংবা অপরকে ম্যানিপুলেট করতে আপনি এই হাত কাটছেন তো এই দেয়ালে ঘুষি মারছেন নয়তো পুড়িয়ে ফেলছেন শরীরের অংশবিশেষ অথবা মুঠো ভর্তি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিজেকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
এমন আচরণের কারণে সমাজ আপনার গায়ে ইমোশনাল ফুল, পাগল কিংবা অ্যাটেনশন সিকারের তকমা ঝুলিয়ে দিয়েছে। আর চিকিৎসকেরা বলছেন, আপনি ভুগছেন সেলফ হার্ম নামক এক আবেগী রোগে! পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি পাঁচজন নারীতে একজন এবং সাতজন পুরুষে একজন কমবেশি এ সমস্যায় ভোগেন; যাদের বয়স সাধারণত ১৪ থেকে ২১-এর মধ্যে।
কারে বলে
নিজেকে আঘাত করার মাধ্যমে মানসিক শান্তি আনার অপচেষ্টাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে সেলফ হার্ম। একে সরাসরি মানসিক রোগ না বলা হলেও এর সঙ্গে যে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা সম্পৃক্ত, তা মোটাদাগে ওই বিজ্ঞান স্বীকার করে নেয়। এই রোগ যার মধ্যে বাসা বাঁধে, তিনি চাইলেও অনেক সময় নিজেকে আঘাত করা রুখতে পারেন না।
সেলফ হার্ম হতে পারে বিভিন্ন রকমের; এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চামড়া কেটে কিংবা নিজেকে খামচে রক্তাক্ত করা; শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক আঘাত করা; মাথা শক্ত কিছুর সঙ্গে আঘাত করা; হাত-পা আগুনে পুড়িয়ে ফেলা; চুল কেটে কিংবা ছিঁড়ে ফেলা ইত্যাদি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমন কাণ্ডের নেপথ্যে আত্মহননের উদ্দেশ্য থাকে না। তবে খুবই বিপজ্জনক হতে পারে এই সব আঘাত। ডেকে আনতে পারে মৃত্যুও। সেলফ হার্মের পর আপাতদৃষ্টে কিছুক্ষণের জন্য মনের কষ্ট কমলেও পরবর্তীকালে এ জন্য অপরাধবোধ জেঁকে বসে। মন বিষণ্ন হয়ে যায় এবং দিনে দিনে কমতে থাকে আত্মমর্যাদা।
গবেষণা বলে, আত্মপীড়নকারীদের প্রায় প্রতি ছয়জনে একজন পরবর্তী এক বছরের মধ্যে আবারও সেলফ হার্ম করেন এবং প্রায় প্রতি ১৫ জনে একজন পরবর্তীকালে বেছে নেন আত্মহননের মতো জঘন্য পথ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু কৈশোর বা তারুণ্যেই নয়, মধ্যবয়সেও দেখা দিতে পারে এমন প্রবণতা। আর তার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়ে শরীরের সঙ্গে মনের দূরত্ব।
কারণ সন্ধান
প্রচণ্ড মানসিক চাপ, অতি আবেগ কিংবা পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে অক্ষমতা থাকলে এ ধরনের সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দেয়। খুব রাগ থেকে কিংবা কোনো কারণে নিজের কাছে নিজেকে দোষী মনে হলে অথবা নিজেকেই শাস্তি দিতে চাইলে মানুষ এমনটা করে। হতে পারে তা ছোটবেলার কোনো ঘটনার প্রভাব, বাবা-মায়ের ওপর রাগ অথবা বাবা-মায়ের সম্পর্কে কোনো রকম সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এ ছাড়া সেলফ হার্মের মাধ্যমে একজন মানুষ নিজের কষ্ট ভুলে যেতে, মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে, যন্ত্রণাদায়ক পরিবেশ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে, নিজের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে, অন্যের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে, অন্যের আচরণে পরিবর্তন ঘটাতে কিংবা নিজের বেপরোয়া ভাব অন্যদের দেখাতে চায়। কারণ আছে আরও; যেমন ব্যক্তিত্বের অসুখ বা ব্যক্তিত্বজনিত সমস্যা, সম্পর্কজনিত জটিলতা, অতিরিক্ত মানসিক চাপ এবং তা নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা কম থাকা, বিষণ্নতা, মাদকাসক্তি, বাবা-মায়ের কলহ প্রভৃতি।
গবেষণার খেরোখাতা
আত্মপীড়ন প্রবণতা যেকোনো সময়ে, যেকোনো স্থানে, যেকোনো বয়সেই দেখা দিতে পারে। অথচ এই সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা কিংবা সচেতনতার অভাব রয়েছে প্রায় সব ক্ষেত্রে। গবেষণা বলছে, যারা নিজেদের ক্ষতি করেন, তারা অন্যদেরও ক্ষতির কারণ হতে পারেন। সুইডেনের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষকেরা এই বিষয়ে ১৮ লাখ ৫০ হাজার ৫২৫ জনের ওপর একটি গবেষণা পরিচালনা করেছিলেন। ১৫ বছর বয়স থেকে তাদের রাখা হয়েছিল পর্যবেক্ষণে। গবেষণা চলাকালে এদের মধ্যে ৫৫ হাজার ১৮৫ জন নিজেকে আঘাত করেছেন, ৬৬ হাজার ৬৫১ জন জড়িয়েছেন কোনো না কোনো ভয়াবহ অপরাধে এবং ৮ হাজার ১৫৫ জন একই সঙ্গে নিজেকে আঘাতও করেছেন আবার ভয়াবহ অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছেন। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, যারা জীবনের কোনো সময় নিজেকে গুরুতর আঘাত করার জন্য চিকিৎসার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে পরবর্তীকালে অন্যদের ক্ষতি করার প্রবণতা বেড়েছে ৫ গুণ পর্যন্ত। আর এই প্রবণতা নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই সমানভাবে দেখা যায়।
কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের গবেষক অ্যানা সাহলিন বলেন, ‘যে কারণে কেউ নিজেকে আঘাত করেন, অন্যদের আঘাত করার পেছনেও একই কারণ কাজ করে। সাধারণত রাগ ও মানসিক অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এভাবে। তাই নিজেকে আঘাত করেছেন—এমন কারও চিকিৎসা আমরা যখন করি, অন্যদের প্রতি তিনি কতটা আগ্রাসী মনোভাব রাখেন, সেটিও তখনই পরীক্ষা করে দেখা উচিত। একই সঙ্গে উচিত প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করা। এতে সম্ভাব্য অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা যাবে।’
সমাধানের সহজ পাঠ
আত্মপীড়ন যারা করেন, তাদের অধিকাংশের জানা থাকে না—এর মাধ্যমে নিজের কতটুকু ক্ষতি করছেন কিংবা এ থেকে বের হওয়ার কী উপায়। যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য নিবন্ধকার ডা. সজল আশফাক বলেন, ‘নিউইয়র্কে মেন্টাল হেলথ এডুকেশন ইন স্কুলস ল নামে একটি আইন পাস করা হয়েছে। এই আইনে কিন্ডারগার্টেন থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত নিউইয়র্কের সব স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে শিক্ষাদান বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আমাদের দেশেও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে স্থান দেওয়া দরকার। স্কুল-কলেজে সোশ্যাল ইমোশনাল লার্নিং শেখানো প্রয়োজন। এতে আত্মসচেতনতা বাড়ার পাশাপাশি নিজেকে সামলানোর কৌশল রপ্ত করা; সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, সম্পর্ক ও যোগাযোগ দক্ষতা; দায়িত্বশীল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বাড়বে। তা ছাড়া তরুণদের সঙ্গে পরিবারের অকপট, খোলামেলা ও সৎ যোগাযোগ রাখা চাই। তাদের ক্ষমতায়িত করতে হবে যেন নিজ দায়িত্বে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে এবং পরিবারে একটি প্রযুক্তিমুক্ত বা টেক-ফ্রি সময় থাকে; এই সময়টায় পরিবারের সবাই একসঙ্গে নিজেদের মতো সময় কাটাতে পারেন।’
এ সমস্যায় যারা ভোগেন, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করলে এবং পাশে দাঁড়ালে সাধারণ পর্যায়ের আত্মপীড়ন প্রবণতা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারবেন বলে মত এই বিশেষজ্ঞের। তবে যদি কোনো মানসিক রোগের কারণে এমনটা হয়ে থাকে, অবশ্যই তা চিহ্নিত করে চিকিৎসা নেওয়া চাই। অন্যদিকে, নিজের মধ্যে এই প্রবণতা অনুভব করলে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধে কিছু কর্মযজ্ঞের পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সজল আশফাক। যেমন কারও সঙ্গে অনুভূতি ভাগাভাগি করে নেওয়া; তাৎক্ষণিক ঠান্ডা পানিতে গোসল করা; কাগজে লেখালেখি করা; লাল কালি কিংবা লাল রং দিয়ে ছবি আঁকা; দৌড়ানো, লাফ দেওয়া কিংবা কোনো কায়িক পরিশ্রম করা; পাঞ্চিং ব্যাগে আঘাত করা; স্কুইজ বল প্রেস করা; চামচ কিংবা কোনো কিছু দিয়ে ধাতব বস্তুকে আঘাত করে শব্দ করা অথবা বাদ্যযন্ত্র বাজানো; হাঁটু বা কনুইয়ে বরফের টুকরো চেপে ধরা; ভীষণ ঝাল কিংবা তেতো স্বাদের কিছু খাওয়া ইত্যাদি।
এ ছাড়া যা করতে পারেন—
পরিবেশ বদল: এমন পরিবেশে থাকুন, যেখানে আপনার মন ভালো থাকবে, যেখান থেকে পজিটিভ এনার্জি পেতে পারবেন। যদি মনে হয় কাজ হচ্ছে না, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
সৃজনশীলতা উপভোগ: পছন্দের শিল্পীর গান শুনুন, ছবি আঁকুন, ঘর সাজিয়ে তুলুন মনের মতো। দরকার পড়লে গানের ক্লাসে ভর্তি হয়ে নিন।
পোষা প্রাণীর সঙ্গ: বাড়িতে কোনো পোষা প্রাণী থাকলে তার সঙ্গে খেলাধুলা করে সময় কাটাতে পারেন।
নিয়ম মেনে চলা: খুব বেশি রাত জাগবেন না। অতিরিক্ত দেরি করে রাতের খাবার খাবেন না। একটি রুটিন মেনে চলুন। খাওয়া, ঘুম ঠিক সময়ে হলে আপনাআপনি অনেক সমস্যার সমাধান ঘটে যায়।
মর্নিং ওয়াক: সকালে হাঁটতে বের হোন। সম্ভব হলে সময় কাটান জিমে।
মোটকথা, আত্মপীড়ন থেকে বেরিয়ে এসে নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। দেখবেন, একসময় এই ভালোবাসার জাদুবলে, পথের পাশে অযত্নে ফোটা ফুলও আপনাকে দেবে নির্মল আনন্দ।
ছবি: ইন্টারনেট