পাতে পরিমিতি I আন্ডারওয়েট?
ওজনজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা বলতে অনেকে ওবেসিটি বা স্থূলতাকে বুঝি। অথচ কেউ কেউ আছেন, যাদের ওজন কাঙ্ক্ষিত সূচকের চেয়ে কম। তাদের জন্য রইল পুষ্টিবিদ নিশাত শারমিন নিশির পরামর্শ
কাঙ্ক্ষিত সূচকের চেয়ে ওজন কম বা বেশি যা-ই হোক, তা সুস্থতা নির্দেশ করে না। সাধারণত একজন ব্যক্তির আদর্শ ওজন কত হবে, তা বয়স ও উচ্চতাভেদে নির্ধারণ করা হয়। একে বলে বডি ম্যাস ইনডেক্স (বিএমআই)। এর মান ১৮-এর নিচে হলে ওই ব্যক্তি মারাত্মক অপুষ্টি বা ম্যালনিউট্রিশনে ভুগছেন বলে গণ্য করা হয়। কাঙ্ক্ষিতের চেয়ে ওজন যত কম থাকবে, শারীরিক দুর্বলতা তত বাড়বে; রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি সাধারণ জীবনযাপনও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ার শঙ্কা থাকবে।
কেউ কেউ হরদম বলেন, ‘প্রচুর খাওয়াদাওয়া করি, তবু কিছুতেই আমার ওজন বাড়ে না।’ তাদের বলছি, প্রত্যেক মানুষের বিএমআই ভিন্ন। তাই হিসাব কষে বের করা চাই, আপনার মেটাবলিক রেট কম নাকি বেশি। এর ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হয়, আপনার ক্যালরি কত হওয়া উচিত। যাদের ওজন অনেক কম, তারা সাধারণত মুখে রুচি কম, ক্ষুধামান্দ্য, পেট ভরা লাগা…এ ধরনের সমস্যায় ভোগেন। এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে খাদ্যতালিকায় রাখতে পারেন যেসব খাবার:
আমলকী: আমলকীতে ভিটামিন সি-এর পরিমাণ কমলা কিংবা আপেলের চেয়ে অনেক বেশি। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দেহে প্রাত্যহিক অন্তত ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি প্রয়োজন। তাই যাদের খাবারের রুচি বেশ কম, তারা প্রতিদিন কমপক্ষে দুটি আমলকী গ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যা কাটাতে পারেন।
লাইম জুস: যারা প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে দু-এক টুকরো লেমন গ্রহণ করেন, তাদের দেহে সাধারণত ভিটামিন সি-এর ঘাটতি থাকে না। তবে খাদ্যরুচি কম থাকলে বানিয়ে নিতে পারেন লাইম জুস বা লেবুর শরবত। এটি মুখের রুচি ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
ব্ল্যাক পিপার: খাবারের সঙ্গে কালো কিংবা সাদা গোলমরিচ গ্রহণ করলে শুধু বাড়তি স্বাদই যোগ হয় না; রুচি বাড়াতেও কাজে দেয়। কোনো অ্যাসিডিটি কিংবা অ্যালার্জির সমস্যা না থাকলে সবজি কিংবা জুসে ছড়িয়ে দিতে পারেন সামান্য ব্ল্যাক পিপার।
ওজন কম থাকলে শারীরিক ফিটনেস ও সৌন্দর্য—দুটোই ধীরে ধীরে কমে যেতে থাকে। সে ক্ষেত্রে এখনো আমাদের সমাজে পারিপার্শ্বিক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় অনেককে; বিশেষত মেয়েদের। কাঙ্ক্ষিত সূচক অনুসারে ওজন বাড়াতে এবং সৌন্দর্য ধরে রাখতে চাই পুষ্টিকর কিছু খাবার। সাধারণত অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও সবজিগুলোই ত্বকের সৌন্দর্য বাড়াতে সাহায্য করে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ধরে রাখতেও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জুড়ি নেই। এ ধরনের ফল দিয়ে ঘরে বসেই যদি বানিয়ে নেওয়া যায় জুস কিংবা স্মোদি, তাহলে ক্যালরি বাড়ার পাশাপাশি ত্বকের উজ্জ্বলতা এবং ফিটনেস—উভয়ই লাভ করা যাবে দারুণভাবে। এ ক্ষেত্রে খাদ্যতালিকায় যা রাখতে পারেন:
অরেঞ্জ জুস: সাধারণত প্যাকেটজাত যেসব জুস বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলোতে নানা ভেজাল উপাদান মিশ্রণের ঝুঁকি থাকায় পুষ্টি উপাদান নিয়ে কমবেশি সবাই সন্দিহান। এ ক্ষেত্রে নিজেই ঝটপট বাসায় তিন-চারটি অরেঞ্জ নিয়ে, সেগুলোর জুস বের করে, পরিমাণমতো সুগার যোগ করে নিলে উচ্চ ক্যালরির অরেঞ্জ জুস পাওয়া সম্ভব।
হাই ক্যালরিক প্রোটিন স্যুপ: চিকেন ও ডিমসমৃদ্ধ স্যুপে বাটার কিংবা তেল দিয়ে তৈরি করা যেতে পারে হাই ক্যালরি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ স্যুপ। একে কিছু গাজর, পটেটো ম্যাশ ও কর্নফ্লাওয়ার সমৃদ্ধ করে দিলেই উচ্চমানের কার্বোহাইড্রেট পাওয়া সম্ভব। তা ওজন ও স্ট্যামিনা বাড়াতে এবং সৌন্দর্য রক্ষায় বেশ কাজে দেবে।
মজার ব্যাপার হলো, ওজন কমাতে যে খাবারগুলো সাধারণত খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দরকার পড়ে, ওজন বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেগুলোই গুরুত্ব পায় বেশি। এ ক্ষেত্রে ডায়েটে যুক্ত করতে পারেন এ ধরনের খাবার:
খেজুর: মিষ্টি স্বাদের এই অসাধারণ ফল খেতে যেমন দারুণ, ওজন বাড়াতেও কাজে দেয়। এটি খাবারে বাড়তি স্বাদ প্রদান করে। এ ছাড়া এতে রয়েছে আয়রন, প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ডায়েটারি ফাইবার। ওজন বাড়াতে তাই সারা দিনে অন্তত চারটি খেজুর খেতে পারেন। তাতে প্রায় ৯০ ক্যালরি যুক্ত হবে আপনার ডায়েটে। এ ক্ষেত্রে স্বাদ নিতে পারেন খেজুরের বরফির। ঘি, খেজুর, মিক্সড বাদাম আর সিসিমি সিডের মিশ্রণে তা খুব সহজেই বানিয়ে নেওয়া সম্ভব।
কলা: আমাদের দেশে সারা বছর পাওয়া যায়—এমন কোনো ফলের কথা এলে অনেকের মাথায় সবার আগে চলে আসে কলা। বেশ মিষ্টি স্বাদের এবং উচ্চ ক্যালরিসমৃদ্ধ এই ফল। প্রতি বেলায় না হলেও অন্তত ব্রেকফাস্টের সঙ্গে ছোট একটি বা দুটি কলা আপনার বাড়তি ক্যালরি চাহিদা পূরণে সাহায্য করবে। এ ছাড়া বিকেলে স্ন্যাকস হিসেবে দুধ-কলা দিয়ে সহজে প্যানকেক তৈরি করে খেয়ে নিতে পারেন।
মিল্ক প্রোডাক্ট: শুধু দুধ খাওয়ার চেয়ে দুধে তৈরি যেকোনো খাবার খেলে বাড়তি ক্যালরি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। আর যেকোনো ডেজার্ট গ্রহণের ফলে দুধে থাকা ক্যালসিয়াম ও প্রোটিনের পরিমাণও বেড়ে যায়। ওজন কম থাকলে অনেকের অতিরিক্ত খাবার গ্রহণে অসুবিধা হয়। তাদের ক্ষেত্রে পুডিং, ঘন পায়েস বা ফিরনি হতে পারে বেস্ট চয়েস।
ডিম: ওজন বাড়াতে প্রোটিনের গুরুত্ব অনেক। এর পরিমাণ কম থাকলে মাসল বিল্ডআপ করা কঠিন। সে ক্ষেত্রে যাদের আন্ডারওয়েট, অবশ্যই ডিম বা ডিমে তৈরি যেকোনো খাবার গ্রহণ দরকার। সারা দিনে অন্তত দুই থেকে তিনটি ডিম রাখুন প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায়। মেইন মিলের সঙ্গে দুটি ডিমের সাদা অংশ যোগ করে নিলেই বাড়তি প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এ ছাড়া খেতে পারেন ডিমের জর্দা, ডিম চপ, ফ্রেঞ্চ টোস্ট ইত্যাদি।
আরও আছে! প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় মিষ্টিজাতীয় খাবারের পাশাপাশি রাখুন কিছু অতিরিক্ত ক্যালরি সমৃদ্ধ খাবার। সে ক্ষেত্রে রাখতে পারেন বাসায় তৈরি চিকেন শর্মা, ঘি বা বাটার দিয়ে তৈরি বিভিন্ন ধরনের হালুয়া, মিষ্টি আলুর ওয়েজেজ, লুচির সঙ্গে ছোলার ডাল ইত্যাদি। তা ছাড়া স্ন্যাকস হিসেবে খেতে পারেন প্রোটিন বার, প্রোটিন শেক ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে তৈরি করে নিতে পারেন ঝটপট এই প্রোটিন শেক, যা দ্রুত ওজন বাড়াতে এবং স্ট্যামিনা তৈরিতে সাহায্য করবে:
উপকরণ: এক গ্লাস দুধ, পিনাট বাটার, কলা দুটি, খেজুর তিন-চারটি, কিশমিশ ইচ্ছেমতো, মধু অথবা ব্রাউন সুগার।
প্রণালি: সব কটি উপকরণ খুব ভালোভাবে ব্লেন্ড করলেই এক গ্লাস প্রোটিন শেক রেডি!
যারা ওজন বাড়াতে চান, খাদ্যতালিকা থেকে কিছু খাবার বাদ দেওয়া চাই তাদের। যেমন চা, কফি, চিপস ইত্যাদি। এগুলো দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে ভূমিকা রাখে; যার ফলে স্ট্যামিনা হারানোর পাশাপাশি পেট ভরা থাকায় তেমন ক্ষুধা অনুভব হয় না।
সাধারণত সঠিকভাবে খাওয়াদাওয়া করলে ওজন কম ব্যক্তিদের স্বাভাবিক ওজনে ফিরে আসা সম্ভব। তবে কেউ যদি ডায়াবেটিস, হজম ক্ষমতা কম, আইবিএস প্রভৃতি নানা অসুখে ভুগে থাকেন, তাদের ক্ষেত্রে ওজন বাড়ানো বেশ মুশকিল। যেহেতু প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব লাইফস্টাইল রয়েছে, তাই সব ধরনের ডায়েটারি মডিফিকেশন নিজে নিজে অনেক সময় করা সম্ভব হয় না। সে ক্ষেত্রে আপনার কতটুকু ওজন বাড়াতে হবে, তা নির্ধারণ করে ক্যালরি ব্যালেন্স করার জন্য পুষ্টিবিদের শরণাপন্ন হওয়াই শ্রেয়।
লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট