মনোজাল I রেজল্যুশন রিয়েলিটি
নতুন বছরে নিজেকে বদলে নেওয়ার তাগিদ। এই মনস্তত্ত্বের প্রভাব ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কতটুকু প্রবল? নাকি পুরোটাই আবেগের তাড়না
নতুন বছর নিয়ে হাজার রকম পরিকল্পনা পাখা মেলে। পুরোনোকে সরিয়ে নতুনে বাঁচার আগ্রহ দেখা যায় অনেকের মাঝে। যেন নতুন বছরে জন্ম হবে ‘নতুন আমি’র! নিউ ইয়ার রেজল্যুশনের ধারণা এসেছে সেখান থেকেই। ফানুশে-আলোতে বরণ করে নেওয়া হয় নতুন বছরকে। শত আশা মুড়োনো মোড়ক খুলে বেরিয়ে আসে আনকোরা ৩৬৫ দিন (এবার লিপ ইয়ার বলে বাড়তি আরও একটি দিন)। বেঁচে থাকার সঙ্গে যা কিছু সম্পর্কিত, তার সব নিয়েই অনেকে করেন পরিকল্পনা। যাকে আমরা বলি নিউ ইয়ার রেজল্যুশন।
জর্জিয়ার নন-প্রফিট হেলথ সার্ভিস কোম্পানি ‘পাইডিমন্ট’-এর তথ্যমতে, একজন ব্যক্তি যখন নতুন বছর উপলক্ষে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তখন তার ব্রেনের শক্তিশালী নিউরো-হরমোন ডোপামিন উত্তেজিত হয়। এই প্রাণরস মানব মনে পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং আনন্দিত হওয়ার অনুভূতি আর আশা তৈরি করে। নিউ ইয়ার রেজল্যুশনের ক্ষেত্রে ডোপামিন মনকে দেয় পুরোনোকে পেছনে ফেলে নিজেকে প্রকাশের উৎসাহ। যেখানে ফ্যাশন সেন্সও প্রভাবিত হয়। এ কারণে বছরের প্রথম দিকে পোশাকের আমূল পরিবর্তনের আগ্রহ দেখা যায় অনেকের মাঝে। কেউ কেউ বদল করেন অনুষঙ্গ। সর্বোপরি ট্রেন্ডি অথবা সিগনেচার স্টাইল তৈরির প্রচেষ্টা। কখনো ট্র্যাডিশনালের প্রতিজ্ঞা, কখনোবা চৌকস করপোরেট। কারও আবার ওয়ার্ক ওয়্যার রিমিক্স! চাহিদা যেটাই হোক না কেন, শপিং বাকেটে ড্রেস-অ্যাকসেসরিজের এক্সপেরিমেন্টেশন সুস্পষ্ট দেখা যায়।
ফ্যাশন যেহেতু জীবনের সঙ্গে জড়িত, নিউইয়ার রেজল্যুশন প্রভাব রাখে সেখানেও। মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে লিখিত দুটি বই ‘কাম’ ও ‘ইন্সপায়ারড’-এর লেখক ডেনিশ বুটিম লিখেছিলেন, ‘নিউ ইয়ার মানুষের মনে একটি খালি স্লেট পাওয়ার অনুভূতি তৈরি করে। যেখানে নতুন করে নিজের মতো সবকিছু লেখার সুযোগ তৈরি হয়। আর নিউ ইয়ার রেজল্যুশন দেয় নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণের অনুভূতি।’
ডোপামিনের প্রভাব প্রবল কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী নয়। ক্রেতা এ সময়ে নিজের শখ পূরণের উদ্দেশ্যে পরিকল্পনাহীন কেনাকাটা করেন। পণ্যটি প্রয়োজনীয় কি না, তা নিয়ে খুব বেশি ভাবেন না। আকর্ষণীয় মনে হলে কেনার সিদ্ধান্ত দ্রুত নিয়ে ফেলেন অনেক সময়। তাৎক্ষণিক চাহিদা এ সময় গুরুত্ব পায়। ফ্যাশন-সচেতন ব্র্যান্ড মানেই ক্রেতা আচরণ গুরুত্ব পায়। নিউ ইয়ার রেজল্যুশনে ‘ইমপালস পারচেজ’ অর্থাৎ আবেগের বশে কেনাকাটার সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিক্রেতারা এটা জানেন বলেই ক্রেতা আকর্ষণে বিভিন্ন ধরনের ‘অফার’ নিয়ে হাজির হতে দেখা যায় তাদের। এর মধ্যে বহুল প্রচলিত বোগো অর্থাৎ বাই ওয়ান গেট ওয়ান, ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ অবধি মূল্যছাড়, ফ্রি গিফট হ্যাম্পার ইত্যাদি। বছরের প্রথমে নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের আকাঙ্ক্ষায় ক্রেতাদের এসব আয়োজনে আকর্ষিত হতে দেখা যায়। এতে ফ্যাশন লেবেলগুলো বছরের প্রথমেই ক্রেতাদের আগ্রহী করতে সক্ষম হয়। ফলাফল—লাভের দেখা মেলে শুরুতেই। সফলতায় ব্যবসার উৎসাহ বৃদ্ধি হয়। নিজেকে বদলে নেওয়ার তাগিদে দীর্ঘ তালিকার শপিং করতে দেখা যায় অনেককে। পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে জুতা, ব্যাগ, অলংকার কেনার তাগিদ সমানতালে বাড়তে থাকে।
বিশ্বের স্বনামধন্য পাবলিশার কোম্পানি ‘দ্য ড্রাম’ ‘ই-বে অ্যাডভারটাইজিং’-এর সহায়তায় সম্পন্ন একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল বছর শুরুর এই চাহিদা নিয়ে। সেখান থেকে পাওয়া তথ্যমতে, হ্যাপেনিং ডিসেম্বরের পরে জানুয়ারি শপিংয়ের ক্ষেত্রে ‘স্লো মান্থ’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও আদতে তা নয়। ২০১৫ সালের প্রথম সপ্তাহে করা একটি জরিপে এ বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সপ্তাহে মেয়েরা অনলাইনে পছন্দমতো হীরার আংটি কেনার জন্য প্রতিদিন ২ হাজার ৪০০ বারের বেশি ‘সার্চ’ করেছেন। এর আগের মাসে অর্থাৎ ডিসেম্বরে একই পণ্য দিনে ৮৫ বার খোঁজা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায়, জানুয়ারি মাসে শপিংয়ে বেশ ভালো আগ্রহ দেখান ক্রেতারা।
নিউ ইয়ার রেজল্যুশনকে ক্রেতা যতটা গুরুত্ব দেন, ঠিক তেমনই গুরুত্ব দেন বিক্রেতারা। বলা যেতে পারে, ক্রেতাদের তুলনায় বিক্রেতাদের কাছেই এই দর্শন বেশি গুরুত্ব পায়। কেননা, নতুন বছরে নতুন আমিকে খুঁজে বেড়ান যারা, তাদের মাঝেই আছেন সম্ভাব্য ক্রেতা। ব্র্যান্ডগুলোর ‘অফার প্ল্যান’-এর উদ্দেশ্য সেসব ক্রেতা আকর্ষণ। হাই-ভ্যালু কাস্টমারের খোঁজে বিক্রয় কৌশল পরিকল্পনা করেন ফ্যাশনবাজারের কর্তাব্যক্তিরা। সঙ্গে থাকে পুরোনো ক্রেতাদের ধরে রাখার চেষ্টা। আবার তাদের ফ্যাশন আইটেমগুলো যেন একঘেয়ে না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয় প্রতিনিয়ত। নতুন কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা তো থাকেই, সঙ্গে আকর্ষণীয় মূল্যছাড়, মিনি ইভেন্ট, ডেকোরেশনের মাধ্যমে ক্রেতা আকর্ষণের নানা উপায় খুঁজে বেড়ান বিক্রেতারা। একাধিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, এসব অফারে ক্রেতা মনে করেন তিনি ‘জিতেছেন’। অর্থাৎ কম দামে আকর্ষণীয় পণ্য পেয়েছেন। আবার পণ্যের সঙ্গে উপহারস্বরূপ কিছু থাকলে ক্রেতা নিজেকে বিশেষ মনে করতে শুরু করেন। মনে করেন, টাকা খরচ করে তিনি ঠকে যাননি; বরং প্রিয় ব্র্যান্ড তাকে পুরস্কৃত করেছে। অর্থাৎ ‘নিউ ইয়ার রেজল্যুশন’ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে লাভবান করে। ক্রেতার আনাগোনা, বিক্রেতার লাভ—এসবে ইতিবাচকভাবেই শুরু হয় নতুন বছর।
সারাহ্ দীনা
মডেল: তানজিদা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: র নেশন
ছবি: তানভীর খান