ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I কালচারাল ক্রসরোড
বিশ্বায়নের প্রভাব থেকে বাদ পড়েনি এই শিল্প। বহুসংস্কৃতিবাদের উত্থান আর ঐতিহ্যের সংমিশ্রণ প্রতিনিয়ত পাল্টে দিচ্ছে ট্রেন্ডচার্ট আর ফ্যাশন ল্যান্ডস্কেপ। আরও গভীরে জানার চেষ্টা সারাহ্ দীনার
ফ্যাশন। একটি দেশকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরতে সক্ষম। এর মাধ্যমে সহজে প্রকাশিত হয় সমাজের রীতিনীতি, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও বিশ্বাস। বিশ্বায়ন বিভিন্ন দেশের ফ্যাশনকে একই প্ল্যাটফর্মে নিয়ে এসেছে। পরিণত করেছে মিলিয়ন ডলারের শিল্পে; যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। প্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে পৃথিবীর এক প্রান্তের ডিজাইন অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে মুহূর্তে। বাজার বড় হচ্ছে, ক্রেতা চাহিদা বাড়ছে। নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন দেশের আন্তসংযোগে ভূমিকা রাখছে ফ্যাশন। সীমাহীন এর বিচরণ। যা কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আটকে নেই। ওয়েস্টার্নে সেজে উঠছে ইন্ডিয়ানরা। আবার আরব ফ্যাশন পৌঁছে যাচ্ছে আমেরিকায়। আফ্রিকার রংবাহারে একাত্ম সংযুক্ত আরব আমিরাত। একের সঙ্গে অপরের এই মিলমিশ তৈরি করছে ইতিবাচকতা।
পশ্চিমা ফ্যাশন
পশ্চিমা বিশ্বের প্রভাব ফ্যাশন বাজারে সর্বাধিক। এর পেছনে সেখানকার অঞ্চলভিত্তিক বিভিন্নতার ভূমিকা আছে। নাগরিকদের জীবনযাপনের বিচিত্রতাও পেয়েছে গুরুত্ব। পশ্চিমা বিশ্বে মানুষ নিজস্বতার দৃপ্ত প্রকাশ চায়। তাই সিগনেচার ফ্যাশন তাদের কাছে জরুরি। এই অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাটাগরির পোশাক দেখা গেলেও তার মাঝে ক্যাজুয়াল ও ফরমাল ওয়্যারের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। ক্যাজুয়ালে বটমের জন্য ডেনিম তাদের তালিকার সবার ওপরে। এর সঙ্গে টি-শার্ট এবং পায়ে স্নিকার পছন্দের জোড়। ডেইলি ওয়্যার হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় এই তিনটি ক্লদিং আইটেম। ইউনিসেক্স ফ্যাশনেরও চমৎকার উদাহরণ এগুলো। পশ্চিমা ফ্যাশনের জিনস, টি-শার্ট দারুণভাবে জায়গা করে নিয়েছে বৈশ্বিক ফ্যাশনে। তারুণ্যের পছন্দের পোশাক হিসেবে অবস্থান দৃঢ় করেছে। একই সঙ্গে, সেসব দেশের বৈচিত্র্যময় জলবায়ু ক্লদিং লাইনের বিভিন্নতার অন্যতম কারণ। আবার আমেরিকান ওয়ার্ক কালচার থেকে এসেছে স্যুট-টাই। অফিশিয়াল পোশাক হিসেবে দুনিয়াব্যাপী এর বিকল্প নেই বললেই চলে। করপোরেট এনভায়রনমেন্টে স্যুট, ফরমাল শার্ট ও টাইয়ের ব্যবহার দেখা যায় বেশির ভাগ দেশে। সব সময় এই পোশাক ইন ট্রেন্ড। আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে শুরু হয়েছিল স্ট্রিট ওয়্যার এবং হিপহপ কালচার। সেখান থেকে এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে।
যুক্তরাজ্যের ফ্যাশন
যুক্তরাজ্য বিখ্যাত তার ক্ল্যাসিক, টাইমলেস ফ্যাশনের জন্য। টেইলরড ফিট ধারণাটি এসেছে এই দেশ থেকে। যাতে এখন অভ্যস্ত বহু দেশের মানুষ। লাক্সারি প্রোডাক্ট হিসেবে অনেক আগেই নাম কুড়িয়েছে এই পোশাক। লন্ডনের সেভিল রো অঞ্চলটি বেসপোক টেইলরিংয়ের জন্য বিশ্বখ্যাত। এই ধারা ইউনাইটেড কিংডম থেকে ছড়িয়ে পড়েছে। হাই এন্ড ফ্যাশন হিসেবে পেয়েছে সমাদর। ভৌগোলিক সীমারেখা পেরিয়েছে সৃজনশীল এই টেইলরিং টেকনিকের। প্রভাব এশিয়া মহাদেশেও শক্তিশালী। দেশের করপোরেট ওয়ার্ল্ড যুক্তরাজ্যের ওয়ার্ক ও ওয়্যার কালচার অনুসরণ করে।
আরব ফ্যাশন
মডেস্ট ক্লদিংয়ের আলাদা ফ্যান বেইজ তৈরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। এই ফ্যাশন-ফিলোসফির জন্ম আরবে। ৩০০ মিলিয়নের বেশি মানুষ বসবাস করে এই অঞ্চলে। ইউএই, সৌদি আরব, মরক্কো, মিসর ও কাতারের ফ্যাশনে মিলেমিশে গেছে। ধর্মীয় মনোভাব এখানে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। ফ্যাশন ফিলোসফির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তানে। লুজ ফিটেড পোশাকের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। আবায়া, গাউন, হিজাবের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। আবার সালোয়ার-কামিজেও দেখা যাচ্ছে ঢিলেঢালা কাট। বডি হাগিং পোশাকের প্রতি আগ্রহ কমেছে। কালার প্যালেটেও দেখা যাচ্ছে নতুনের জয়জয়কার। প্যাস্টেল শেডগুলোর ব্যবহার বেড়েছে। অলংকরণের ক্ষেত্রেও সুতা ব্যবহারে এমব্রয়ডারি গুরুত্ব পাচ্ছে।
ইন্ডিয়ান ফ্যাশন
ইন্ডিয়ায় তৈরি পোশাকের বিশেষত্ব এর অলংকরণ। ওয়েডিং ফ্যাশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে ভারতের বিয়ের পোশাকের জমকালো নকশা। শাড়ির পাশাপাশি লেহেঙ্গা হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। ডিজাইনার ওয়্যারগুলোতে বিশ্বব্যাপী মানুষকে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য দেশেও পৌঁছে গেছে ভারতীয় ফ্যাশন ডিজাইনারদের লেবেলগুলো।
আফ্রিকান ফ্যাশন
আফ্রিকান ফ্যাশনের জয়জয়কার দেখা গেছে গত দশকে। আফ্রো ইন্সপায়ারড প্রিন্ট, প্যাটার্নস ও মোটিফ মনোযোগ কেড়েছে। হাই এন্ড এবং ফাস্ট ফ্যাশন—দুই জায়গাতেই এই অঞ্চলকে বেশ গুরুত্ব পেতে দেখা গেছে।
এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে পড়ছে ফ্যাশন ধারা। এক জাতি আপন করে নিচ্ছে অন্যের গঠনগত এবং আলংকারিক নকশা। ভ্রমণ সংস্কৃতি, বৈশ্বিক বাজারে ব্র্যান্ড পরিচিতি, অনলাইন শপিং, যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহারের সফলতায় এগিয়েছে ফ্যাশন।
ফ্যাশনের অবাধ আসা-যাওয়া বিভিন্নভাবে পৃথিবীর উন্নয়নে ভূমিকা রাখে। সংস্কৃতি একে অপরকে ঐশ্বর্যময় করে তোলে। অর্থনীতি, সামাজিক অগ্রসরতা এমনকি কূটনীতির মতো জটিল বিষয়েও ভূমিকা রাখে।
অর্থনৈতিক বিকাশের মূল চালক
সংস্কৃতির আদান-প্রদান সহজলভ্য হওয়ার কারণে দেশগুলো একে অন্যের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে। রেডিমেড পোশাকের বাজারের দিকে তাকালে দেখা যায়, বিশ্বজুড়ে পরিচিত ব্র্যান্ডগুলোর পণ্য তৈরি হয়েছে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের কারখানায়। এই দুই দেশের জিডিপিতে ভূমিকা রাখছে এই শিল্প। বার্ষিক আয় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার উদাহরণ ভূরি ভূরি! তাই বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ফ্যাশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের ৮৩ শতাংশ রপ্তানি আয় পোশাকশিল্প থেকে আসে; যা দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে।
সামাজিক পরিবর্তনে সক্রিয়
ফ্যাশন ভূমিকা রেখেছে মতাদর্শ এবং নতুন দর্শন তৈরি করতে। সামাজিক পরিবর্তনসংশ্লিষ্ট আন্দোলনের ক্ষেত্রেও ফ্যাশন শক্তিশালী অস্ত্র। বর্তমান সময়ে সমাজের ও পরিবেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রতিবাদের ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। টেকসই তত্ত্ব, ফেয়ার ট্রেড ও অ্যানিমেল রাইট নিয়ে সচেতনতা, নতুন ধারণা প্রতিষ্ঠা এবং নীতিনির্ধারণের মতো বিষয়ে ফ্যাশনকে খুঁজে পাওয়া যায় সামনের সারিতে। এথিক্যাল ফ্যাশন মুভমেন্টে এ ধরনের বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনৈতিক সম্পর্কে
ফ্যাশন প্রভাব ফেলে কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কেও। ২০১৮ সালে সাউথ কোরিয়ায় আয়োজিত উইন্টার অলিম্পিকে পাওয়া যায় এর প্রমাণ। বিশাল সেই আয়োজনের একটি সেগমেন্ট ছিল ফ্যাশন শো। দেশটির ট্র্যাডিশনাল ক্লদিং উপস্থাপন করা হয় সেখানে।
একাত্মতা-বন্ধুতা
পোশাকে প্রকাশিত হয় ব্যক্তিত্ব। ফ্যাশনের শক্তি এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সন্ধিতে ভূমিকা রাখে। সমমনা মানুষকে একত্র করতে পারে। একাত্মবোধের বিকাশ ঘটায়।
বর্তমান পৃথিবীর পুরোটাই রানওয়ে। ফ্যাশনকে বলা যায় সর্বজনীন। ফিজিক্যাল ইভেন্টের পাশাপাশি এখন ভার্চুয়াল ফ্যাশন শো আয়োজন করা হচ্ছে; যেখানে দর্শক পুরো দুনিয়া। ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডে অগমেন্টেড রিয়ালিটির চাহিদাও বাড়ছে। এমন সব আধুনিকায়ন বিশ্বসংস্কৃতিতে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়াবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ছবি: ইন্টারনেট